২০০৭ সালের ২ জুন রোজ শনিবার। সকাল থেকেই বাসায় আত্মীয় আর বন্ধুরা আসছিলো। আগের দিন বিকাল থেকেই অনেক আত্মীয় বন্ধুরা আসায় সবার সাথে ভালোই সময় কাটলো। কিন্তু আজকে যতোই সময় যাচ্ছিলো বাসার পরিস্থিতি ততই কেমন যেন শীতল থেকে শীতলতর হয়ে উঠছিলো। আমি বন্ধুদের সাথে আমার রুমে ব্যস্ত ছিলাম তাই সত্যি বলতে তখন কিছুই অনুভব করিনি। আমার ফ্লাইট ছিল পরের দিন রাত ১১ টা ৫৫ এ সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে। সকাল আনুমানিক ৮টার দিকে আব্বু এসে বল্ল বাড়ির সবাই কাছ থেকে দোয়া নিয়ে আস, মানুষের হায়াত মউতের কথা বলা যায়না।
একাই যাচ্ছিলাম কিন্তু পিছনে ফিরে দেখি মারুফ আমার সাথে (মারুফ আমার ফুফাতো ভাই, দীর্ঘ অনেক দিনের খুব ভাল একজন বন্ধু) আস্তে আস্তে এক ঘর দুই ঘর করে প্রায় ৫০/৬০ জনের সাথে দেখা করলাম। আসলেই গ্রামের মানুষের একটা নাড়ির টান থাকে, প্রায় সবাই অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় দিচ্ছে কেউ আবার পকেটে কিছু টাকাও দিয়ে দিল রাস্তায় খরচ করার জন্য। কারো কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে গেল, কেও হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
আমি নির্বাক, কিছুই বলার সামর্থ ছিলনা আমার।
আমাদের বাড়ির সর্বপশ্চিমের বাড়িটা জজ মিয়া কাক্কুর, উনি জড়িয়ে দরে একপ্রকার চিৎকার করেই বল্ল "বাবারে তরা সবাই দেশ ছেড়ে চলে গেলে, আমাদের কবর দিবে কে?" এই কাক্কুর ৫ ছেলের মধ্যে ৪জনই দেশের বাহিরে থাকে তাই উনি হয়ত এই বিদেশের কষ্টটা অনেক ভাল বুঝতে পারেন।
সকাল ১০টার সময় সবকিছু গোছিয়ে নিচ্ছি এবার বিদায় হয়ে যাব বাড়ি থেকে, হটাৎ করেই ঘর থেকে বাহিরে আসলাম সারাটা বাড়ি মমতা নিয়ে দেখতে লাগলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে এই বুঝি আমার শেষ দেখা, আর মনে হয় কখনো আসবনা। আমার আড্ডা দেওয়ার ঘড়টাতে কিছুটা সময় বসলাম, চেষ্টা করলাম কিছু কথা বলতে বন্ধুদের সাথে কিন্তু পারলামনা কেমন জানি বুকের ভিতর একটা চাপা কষ্ট অনুভব করতে লাগলাম।
পাশে বসা বন্ধুরা চোখের পানি মুছছে, তখনো আমি নির্বাক।
বাসা থেকে বাহির হবার সময় মাকে ছালাম করতে গেলাম, মায়ের কান্না সব কিছু উলট পালট করে দিল। বুকের ভিতরে কোন একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু কাউকে প্রকাশ করতে পারছিনা, নিরব হয়ে অনেক্ষন দাড়িয়ে থাকলাম মা কেঁদেই যাচ্ছে।
পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে মাকে একটু সান্তনা দেবার জন্য বল্লাম -
"আরে মা কান্না কাটি করার কি আছে? আমি কি মারা যাচ্ছি না কি? প্রতি বছরই তো আসবো। দেখো এক বছর পলকের মধ্যেই চলে যাবে।"
আম্মার কষ্টও একটু বুঝতে পারলাম । আসলে আমরা মাত্র দুই ভাই। আমার ছোট ভাইও ১২/১৩ বছর বয়সে ঘর ছেরেছে আমিও ঘর ছাড়ছি ১৮ বছর বয়সে। তবে এখন এতটুকু বুঝতে পারি যে, বাবা মা ছেড়ে থাকার কষ্ট যদি এত হয় তাহলে বাবা মার তাদের সন্তানকে ছেড়ে থাকার কষ্ট হয়তো এর চেয়ে হাজার গুণ। তখন আসলে এতো কিছু বুঝিনি। সত্যি বলতে কি, আমার দেশ ছেড়ে আসতে এতটুকু খারাপও লাগেনি। আমার পাথরের মত শক্ত আব্বু যখন আমাকে ইমিগ্রেশনের ভিতরে দিয়ে আমার চাচাতো ভাইয়ের কাধে কান্নায় ঢলে পরে, আর আমার সামনে কান্না চেপে হাসার অভিনয়ের কষ্ট আমি সেদিন বুঝিনি, আমাকে জড়িয়ে বন্ধুদের কান্না করাটা আমার ছেলেমানুষি মনে হয়েছে। আমার মনে ছিলো তখন অজানাকে জানার ক্ষুধা, চোখে ছিলো অদেখাকে দেখার তৃষ্ণা। রক্তে টগবক করা রোমাঞ্চ সেদিন আমাকে কোন দুঃখে দুঃখিত হতে দেয়নি।
আমি ছোটে চলেছি নতুন কিছু পাওয়া জন্য, ছোটে চলেছি বিশাল কিছু ছিনিয়ে আনার জন্য।
আমার ফ্লাইট ছিল সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে। সিঙ্গাপুরে আমার গন্তব্য ছিল অজানা অচেনা একটা শহরে। যথা সময়ে প্লেন ছাড়লো। প্রথম বিমান ভ্রমণ। একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম কিন্তু কিছু বোঝার আগেই দেখি কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা। কেমন যেন একটা অনুভুতি। যেন কান ভার হয়ে আছে। যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে সব ঠিক হয়ে গেল।
বিমান আকাশে উঠার সাথে সাথেই বিমানবালা একটা তোয়ালে দিল হাত মুখ মুছার জন্য, ভাবলাম হয়তো ঠন্ডা হবে, হাতে নিয়ে দেখলাম অনেক গরম মনে হয় হট ওভেন থেকে বাহির করেছে।
৫/৭ মিনিট পর অন্য একজন ভদ্র মহিলা এসে তোয়ালে গুলি কালেক্ট করল পিছনেই দুজন একটা ট্রলিতে করে জুস নিয়ে আসল, আমি বরাবরই যাত্রাপথে অরেন্জ জুসটা পছন্দ করি তাই হাত বাড়িয়ে অরেন্জ জুসের গ্লাসটা নিলাম।
ছিটের সামনের প্যাকেট থেকে এয়ার পিচ নিয়ে সেট করে টিভির চ্যানেল চেইন্জ করতে যাচ্ছি এমন সময় একজন এসে বল্ল কি খাব, গান শুনা আর টিভি দেখার চিন্তা বাধ দিয়ে এবার খাবারে মনোনিবেশ করলাম।
ভুনা খিচুরী সাথে খাশির মাংস আরো অনেক আইটেমের শবজি এবং সালাদ, একি সাথে দিল কিছু অচেনা আইটেমের ছোট ছোট প্যাকেট। অনেক কষ্টে পড়ে দেখলাম লবন চিনি পেপার বাটার এবং আরো হাবিজাবি কিছু।
ঘপাঘপ করে আমার প্যাকেটের খিচুরি শেষ করে দিলাম, পাশের বন্ধুর কাছে নাকি কেমন একটা অচেনা স্বাধ লাগল তাই খাবেনা। এই সুযোগে তারটাও মেরে দিলাম।
পিছন থেকে দুইজন এসে খালি প্যাকেট গুলি কালেক্ট করছে এবং তারও পিছনে দুইজন আসছে কফি নিয়ে, ততক্ষনে খেয়াল করে দেখাম খাবারের প্যাকেটের সাথে আরো একটা প্যাকেট আছে ঐখানে একটা ছোট্ট কাপ এবং চামচ দেয়া কফি খাওয়ার জন্য, আর চিনিসহ
অন্য কিছু দেওয়া ছিল আগেই।
আমি কাপটা বাড়িয়ে দিতেই এককাপ কফি দিল সাথে একটা টেনিস বলের সাইজের রুটি দিল, হাতে নিয়ে দেখি রুটিটা বলের চেয়েও শক্ত। পাশে তাকাতেই দেখি অনেকেই কফিতে চুবিয়ে এই রুটি হাচ্ছে আমিও তাই করলাম, কফিতে ভিজাতেই রুটিটা একেবারে নরম হয়ে গেল এবং বেশ ভাল একটা স্বাধ লাগল।
খাবারপর্ব শেষ করে ফ্রী কম্বল গায়ে দিয়ে কানে ইয়ারপিচ লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরলাম, যদিও মাঝে মাঝে চেয়ে জুস এবং আইসক্রিম খেয়েছি কয়েকবার।
সম্ভবত প্রায় ৪ ঘণ্টা ৫ মিনিট পর সিঙ্গাুপুর এসে পৌঁছলাম। বিমানের বাইরে বের হয়ে দেখি বিশাল বড় এয়ারপোর্ট। আমাদের এয়ারপোর্ট এর তুলনায় কিছুই না। আমরা বিমান থেকে নেমে সুজা ইমিগ্রেশনের দিকে হাটতে থাকলাম, দীর্ঘ লাইন শেষ করে আমার পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন স্ট্যাম্প দিল তার মানে আমি এখন সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করতে পারব।
ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে রাখা বক্স থেকে একটা চকলেট নিলাম তাতে চাঙ্গি এয়ারপোর্টের মনোগ্রাম দেওয়া ছিল স্বাদেও ছিল অতুলনিয়। আমি ফিরে এসে আরো দুইটা নিতে গেলে ইমিগ্রেশন অফিসার হাসি মুখে একটা প্যাকেট দড়িয়ে দিলেন তাতে প্রায় ১০০ চকলেট ছিল।
এদের ব্যবহার দেখলে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করবেন আমরা কোন জাতি? এদের ব্যবহার অতি নম্র ভদ্র যদিও আমরা সাধারন শ্রমিকের ভিসাতে সিঙ্গাপুরে এসেছি। অথচ আমাদের দেশের এয়ারর্পোটে কত খারাপ আচরনটাই না করা হল, তুই তুকারি ভাষা, অযথায় বিলম্ব করা।
ইমিগ্রেশন শেষ করে ব্যাগ নেয়ার জন্য ছোটলাম ব্যাগের বেল্টের দিকে, তারপর ৫/৭ মিনিট অপেক্ষা করে আমার ব্যাগ পেয়ে গেলাম এবং একটা ট্রলিতে করে নিয়ে সিকিউরিটি চেক করে বাহিরে চলে আসলাম।
আমরা চারজন এক কোম্পানির, তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম আমাদের কোম্পানির প্রতিনিধির জন্য, আর যাদের কোম্পানির লোক এসেছে তারা সবাই চলে যাচ্ছে। এক সময় আমরা চারজন বসে থাকলাম
আমার এক মামা সিঙ্গাপুরে থাকে প্রায় ১২ বছর, উনি এয়ারপোর্টে আসলেন আমাকে সময় দিতে।
সকাল প্রায় ১১টার দিকে একজন ইয়া বড় গোফওয়ালা তামিল এসে আমাদের কোম্পানির নাম বলছেন আমরা পাসপোর্ট দিতেই উনি আমাদের ইশারা করে সামনে হাটতে থাকলেন, আর আমরা উনার পিছনে পিছনে ছুটছি.................
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৮