অনেক দিন পর আজকে দেশে আসব, তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার তাড়া নাই। যদিও অনেক বছর যাবত অফিস থেকে সরাসরি দেশে চলে আসি, সবসময় কাধের ব্যাগ নিয়েই ট্রাভেল করি তাই বাসায় গিয়ে ব্যাগপত্র গোছানোর প্রয়োজন পরেনা।
এবার ভাবলাম নিয়মটা চেইন্জ হওয়া দরকার, দেশে যাওয়ার দিন অফিসে যাবনা। সারাদিন রেষ্ট নেবো রাতের ফ্লাইটে দেশে যাব।
সকালের ঘুম ভাঙ্গছে নুপুরের শব্দে, উপরের ফ্ল্যাটে একটা ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি থাকে উনাদের ছোট মেয়ে নৃত্য শিখছে তাই প্রতিদিনই নুপুরের ঝনঝন শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এতে একটা উপকারও আছে এলার্ম ছাড়াই ঘুম থেকে উঠতে পারি। যদিও শুরুতে একবার এই শব্দের জন্য ম্যানেজমেন্ট অফিসে কমপ্লিন করে ছিলাম, তারাও বিষয়টা সিরিয়াস ভাবে নিয়ে ঐ ফ্যামিলিকে নোটিশ পাঠিয়েছে। পরে জানতে পারলাম ৬/৭ বছরের একটা ছোট্ট মেয়ে নাচ শিখতেছে, বাচ্চা টার শখের বিষয়টা বন্ধ করে দিয়ে কেমন জানি অপরাধি মনে হচ্ছে নিজেকে। পরে আমার কমপ্লিন উঠিয়ে নিলাম এবং নিজে গিয়ে বলে আসলাম আবার পিচ্চিটার নাচ প্যাক্টিস করার জন্য। সবার সাথে সব কিছু করা যায় কিন্তু বাচ্চাদের কোন শখের বিষয়ে কখনো বাধা দেয়াটা আমি পছন্দ করিনা, যার বাচ্চাই হোক। বাচ্চাদের বিষয়ে আমার একটাই লজিক "এরা সব কিছুর উর্ধে"।
.
সকালেই যেহেতু ঘুম ভেঙ্গে গেছে সারাদিন কি করে কাটানো যায় এই বিষয়টা ভাবছি, যদিও আজকে শরিফ ভাই অফিসে আসতে চেয়েছিলেন। আমিই নিজ থেকে মানা করেছি। উনি আসলে ভালই লাগে, আসার সময় কাচ্চি নিয়ে আসে। কাচ্চির মাংসে কামড় দিতে দিতে গল্প করা যায়। মাঝে মাজে শরিফ ভাইকে বলি প্রতিদিন অফিসে আসবেন তাহলেইতো কাচ্চির আসর জামাতে পারি।
কি মনে করেযে বেচারা প্রতিদিন অফিসে আসেনা, আজও জানতে পারলাম না। যদিও উনার বাসা আর আমার অফিস অনেক দূরে তাই আসতে পারেনা।
.
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গোছাতে লাগলাম, ছোট্র একটা ট্রলি নিয়ে যাবো। সুযোগ পাইলে এক সপ্তাহ দেশে থাকবো, শীতে তেমন একটা দেশে আসা হয়না তাই দেশের শীত কেমন লাগে ভুলেই গেছি। ব্যাগ গোছানোর এক পর্যায়ে নিজে নিজেই হাসলাম, আসলেই কি আমি ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার মত এতগুলি দিন দেশে থাকবো। ১দিন পার হলেইতো হাপিয়ে উঠি ফিরে আসার জন্য।
ব্যাগপত্র গোছিয়ে বাহিরে গেলাম নাস্তা করতে, রাতেও খাওয়া হইনি, পেট চুচু করে সিগলান দিচ্ছে "কিছু খেয়ে নে পাগলা"
বাসারা পাশেই একটা রেষ্টুরেন্টে গেলাম নাস্তা করতে, ছিমছাম রেষ্টুরেন্ট। ভিতরে এসির ঠান্ডা বাতাসে গরম চা/কফি খাওয়া গেলেও নাস্তা একটু বাহির দিকটাতে করতে হয়, নতুবা খাবার শেষ করার আগেই ঠান্ডা হয়ে বেস্বাধ হয়ে যায়।
গরম গরম পরটার সাথে হাসির মাংস, এই কম্ভিনেশনটা আমার অনেক ভাল লাগে। ইন্ডিয়ান রেষ্টোরেন্ট দেখলেই এই খাবারটা খেতে ইচ্চে করে, কিন্তু সব রেষ্টুরেন্টেতো আর ভাল করে বানাতে পারেনা তাই বাসার পাশেই ভরসা।
যদিও বেলেষ্টিয়ার রোডে একটা দোকানের পরটা আজও মুখে স্বাদ লেগে আছে, অনেক দূরে বলে যাওয়া হইনা।
.
নাস্তা শেষে ছোটলাম মুস্তফা সেন্টারের দিকে, কিছু কেনাকাটা করতে হবে। অনেদিন পরে যাচ্ছি বাড়িতে বাচ্চা কাচ্চার জন্য চকলেট বাবার জন্য কফি আর বাসায় জন্য যা ভাল লাগে কিনতে হবে। বুকিং যেহেতু ৪০ কেজি আছে সুতরাং খালি হাতে যাওয়ার কি দরকার।
দেখতে দেখতে অনেক কিছুই কেনাকাটা করলাম, ৪০ কেজির বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এবারই মনেহয় প্রথমবার এতকিছু কিনলাম, যাওগ্গা অনেকদিন পর দেশে যাচ্ছি একটু বেশি কেনাকাটা না করলে চলে?
.
দেশে আসার খবরটা সবাইকে জানালাম, মারুফকে এয়ারপোর্টে থাকতে বল্লাম। যদিও আমি সাধারনত দেশে আসি কাওকে না জানিয়ে, বাসায় গেলে সবাই এমন একটা ভাব করে যেনো কিছুই হইনি। অথচ আস্ত একটা মানুষ হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে আসলাম, এতবেশি দেশে আসা হয় যে আমার আসার বিষয়টা একে বারেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তারপরও এবার সবাইকে জানালাম, একটা লিষ্ট করলাম কার কার সাথে দেখা করা যায়। অনেকের সাথেই দেখা করার ইচ্ছা, কথা দিয়েও দেখা করতে পারিনি। দেশে যেহেতু কোন কাজ নাই তাই ঘুরে ঘুরে সবার সাথে দেখা করাটাই আমার কাজ।
.
দুপুরের দিকে বাসায় এসে একটা ঘুম দিলাম, ৫টার দিকে ঘুম ভাঙ্গছে। গোসল করে রেডি হচ্ছি। সাধারনত আমি পারফিউম ইউজ করিনা, তারপরও আজকে পারফিউম দিলাম। বোতলটা লিপন ফ্রান্স থেকে নিয়ে এসেছিলো, পারফিউমের জন্য নাকি ফ্রান্স বিহ্যাত। ঘায়ে মাখার পর মনেহয় আসলেই এদের পারফিউম বিশ্ব বিহ্যাত।
জুতা চুজ করার কিছুই নাই, আমার আছেই একজোড়া জুতা তাও মুহিন ভাই কিনে দিছে অনেক দিন আগে। বেচারা সিঙ্গাপুর আসলে আবার ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে একজোড় নতুন জুতা কিনে নিতে পারতাম। কপাল খারাপ উনি জার্মানিতে বসে আছে।
মোজাগুলি একটু ছিড়ে গেছে, সমস্যা নাই তাতে। ২০ হাজার টাকা দামের জুতার ভিতর ছেড়া মুজা কেন মুজা না পরলেও সমস্যা হওয়ার কথা না।
.
আমি রেডি, একটু পরেই আকাশে উড়াল দেবো। নীল আকাশ, তুলার মত মেঘ উড়ছে। মাকে বলে দিয়েছি গরুর মাংস রান্না করে রাখতে, বাসার খাবার মজা করে খাওয়ার জন্য আজকে বিমানেও খাবনা ভাবছি।
.
ব্যাগপত্র নিয়ে বাসার নিজে আসতেই খলিল ভাই গাড়ি নিয়ে হাজির, এই মানুষটা সব সময় আমাকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসে আবার এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসে। বন্ধুত্বের মাঝে ঋণী থাকতে নাই নতুবা আমি উনার কাছে ঋণী থাকতে হতো।
এবার আমার ব্যাগ পত্র দেখে উনিও টাস্কি খাইছেন, এত কিছু কেমনে! আপনিতো দেশে যান শুধু কাধের ব্যাগ নিয়ে, এবার ২/৩ লাগেজ। কোন উত্তর দিলাম না, শুধু একটু হাসলাম।
.
খলিল ভাই ড্রাইভ করছে আমি পাশে বসে আছি, এয়ারপোর্টে এসে ব্যাগ মাপতেই ১০ কেজি বেশি। এখনতো এক ক্যাচাল, হইতো ফেলে যেতে হবে নতুনা টাকা দিতে হবে। এমন সময় মনে হলো "ইসমিকা কি এখনো এই এয়ারপোর্টে আছে?" পরিচিত কেউ থাকলে লাগেজ বেশি হলেও সমস্যা নাই সাথে একটা ভাল সিটও পাওয়া যায়।
ইসমিকার কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা, ঐযে বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে কলম আনতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিলো কাউন্টারে এবং হঠাৎ করেই একদিন সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে দেখা হয়ে গিয়েছিলো। রিজেন্ট এয়ারে জব করতো। পরক্ষনেই মনে হলো, রিজেন্ট এয়ারতো কবেই অপারেশন বন্ধ করে দিয়েছে। যেখানে বিমানই নেই সেখানে ইসমিকা থাকার প্রশ্নই আসেনা।
.
দেশে যেতে চাওয়া মানুষগুলি ব্যাগপত্র ঘুছিয়ে কাউন্টারের দিকে যাচ্ছে, বুকিং পাশ নিয়ে টুপ করে ভিতরে চলে যাচ্ছে। দেশের যাওয়া মানুষগুলির মাঝে একটা মায়া কাজ করে, আপন মানুষগুলিকে পাশে পাওয়ার মায়া। এরা দুনিয়ার সব ভুলে শুধুই দেশে যাওয়ার আনন্দে আত্বমগ্ন থাকে, ১০ টা কথা বল্লেও উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। ভাববেন না এরা অহংকার করছে, দেশে যাওয়া আনন্দে পাশের সবকিছুই ভুলে বসে আছে। কারও কথার উত্তরও দিতে পারছেনা।
.
অনেক ক্যাচাল করে বুকিং কার্ড হাতে পেলাম, খলিল ভাইয়ের মানুষকে কনভিন্স করার একটা বিশাল ক্ষমতা আছে। অফিসারের সাথে দুই মিনিট কথা বলার পর এক্সট্রা টাকা ছাড়াই ব্যাগেজ ছেড়ে দিল।
ঘড়িতে তখন ৭টার একটু বেশি, আমার ফ্লাইট ৮.৩০ মিনিটে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে অনেক বেশি যাত্রী হওয়াতে ফাইনাল চেক-ইন সময় বেশি লাগে, সুতরাং আমাকে আর দেড়ি করা যাবেনা। এখনি ছুটে চলতে হবে ইমিগ্রেশনের দিকে, যদিও খলিল ভাই বলতেছিলো একটা কফি খেয়ে যাওয়ার জন্য। ফিরে এসে খাবো বলেই চল্লাম ইমিগ্রেশনের দিকে।
.
ইমিগ্রেশন এবং ফাইনাল চেকিং শেষ করে বিমানে এসে বসলাম, আমার পাশের ছিটের মেয়েটাকে কেমন পরিচিত লাগছে। মনেমনে ভাবলাম আমার ভুলও হতে পারে, কিন্তু কেমন জানি লাগছে কোথায় যেনো দেখেছি। হঠাৎ মনে হল, করোনার আগে ঢাকা থেকে আসার সময় উনার সাথে পরিচয় হয়েছিল। ঠিক এমনই পাশপাশি সিটে বসে ছিলাম। তখন উনি কান্না করতে ছিলো, কারন জানতে জাইলে সুন্দর কেই বল্লা "বয়ফ্রেন্ড রেখে অষ্ট্রেলিয়া যাচ্ছে তাই মন খারাপ।
আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে ডাকলাম, কেমন আছে মিস. ডালিয়া? চিনতে পারছে? ঐযে ঢাকা..........
বাকি কথাটা শেষ করার আগেই উনি বল্ল, আরে আপনার সাথে এইভাবে দেখা হবে ভাবতেই পারিনি। আমি প্রথমবার দেশে যাচ্ছি, ভালই লাগছে। আপনি কেমন আছেন?
কথা প্রশংগে জানতে চাইলাম উনার বয়ফ্রেন্ডের কি খবর, কষ্ট পাওয়ার মত উত্তর "ছেলেটা নাকি বিয়ে করে ফেলেছে"
আমি শান্তনা মুলক কথা বলতে যাবো তখনি ডালিয়া মোবাইলে একটা ছবি দেখিয়ে বল্ল "উনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, এই জন্যই দেশে যাচ্ছি"
নিজে নিজেই বলতে শুরু করলো, লিমনের বিয়ের সংবাদ পেয়ে অনেক কান্না করেছিলাম কিন্তু এখন নুরের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর মনে হচ্ছে ভালই হইছে। নূর অনেক ভাল ছেলে, লিমনের চেয়েতো অবশ্যই ভাল।
হুট করেই ব্যাগ থেকে একটা কার্ড হাতে দিয়ে বল্লা, আপনার সাথে যেহেতু দেখা হয়ে গেছে সুতরাং একটা কার্ড আপনি পেতেই পারেন, বিয়ের দিন আসলে খুশি হবো। তবে শুধু লিমনের বিষয়ে বিয়ের দিন কোন কথা তুলবেন না, প্লিজ। হা হা হা.. অট্ট হাসিতে মেতে উঠলো।
আরও ৯দিন পর বিয়ে, আমি তারিখ দেখেই বল্লাম এতদিনতো দেশে থাকবনা তবে যদি কোন কারনে থেকে যায় তাহলে নিশ্চয় আসবো। অনেক বছর দেশের কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকিনা, আপনার বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকতে পারলে অনেকবছরের আফসোসটা শেষ হবে।
দুজনের টুকটাক কথার মাঝেই মেয়েটা তার বিয়ের শাড়ির ছবি দেখাচ্ছে, আরও কত কি। বিয়েতে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি এক্সাইটেট থাকে, এই বিষয়টা হাজার বার শুনলেও আজকে ডালিয়াকে দেখে প্রথম অনুভব করতে পারলাম।
.
বিমান চলতে শুরু করছে, আমিও কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আজকে নাকি ফুল মুন, মাঝ আকাশ থেকে দেখতে চেষ্টা করবো। যদিও এইসবের চেয়ে ঘুমিয়ে সময় কাটানো ভাল লাগে, তারপরও ৩৫/৪০ হাজার ফিট উপর থেকে চাঁদটা কেমন লাগবে একটু দেখে রাখা ভাল।
মাঝ আকাশে বিমান পৌছাতেই প্রচন্ড ঝাকুনি দিচ্ছে, বিমান বালারা খাবার দেয়া বন্ধ করে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। ক্যাপ্টেন বার বার যারযার সিটে বসে সিট বেল্ট বেধে নিতে বলছে। বিমান আকাশে এমন হয়ে থাকে তবে আজকের বিষয়টা কেমন জানি ভয়ংকর মনে হচ্ছে, বিমান শুধুই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। বিমান বালাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে কিছু একটা বিপদ সামনে আসছে। আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালাম, চাঁদটা কেমন রক্ত বর্ণ ধারন করেছে। এমন একটা ছবি মোবাইলে রাখতেই পারি, তবে বিমানের ঝাকুনির জন্য মোবাইলটা বের করতে পারলামনা। সুন্দর চাঁদের পাশদিয়ে অনেক অনেক তারা জ্বলজ্বল করছে, এযেনো চাঁদ তারার মিলন তিথী।
বিমানের ভিতরে কান্নাকাটি চলছে, আমি নির্বাক হয়ে বাহিরে চাঁদ দেখছি আর ভয়ে ভয়রে দোয়া দুরুদ পড়ছি। কেন জানি মনে হচ্ছে যাত্রাটা শেষ হবেনা। বিমান সুজা হয়ে নিজের দিকে নামছে অনেক দ্রুত গতিতে ...........................
.
.
একটু পরই ব্রেকিং নিউজ : সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকাগামি একটি বিমান দূর্ঘটনায় কেবিনক্রু এবং পাইলট সহ সবযাত্রী নিহত। একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ২:০৫