ভ্রমণের ক্ষেত্রে আমি বরাবরই বিমানকে এগিয়ে রাখি, সময় বাচানোটাই মেইন টার্গেট। তার ওপর পথের ক্লান্তি কম হওয়াতে মজা করেই ভ্রমণ উপভোগ করা যায়।
এবারও আমার চিন্তা ছিলো বিমানেই যাবো, একেবারেই নতুন যায়গা তাই ইন্টারনেটে একটু খুজ খবর নিচ্ছিলাম কিভাবে শুরু করবো। এক পরিচিত ভাই জানালেন ভ্রমনের আগেই সব ঠিক করে রাখতে, তাতে খরচ কম লাগবে আবার রাস্তার ঝামেলাও কমে আসবে।
বিয়ের পর বউকে নিয়ে এটা আমার প্রথম দেশের বাহিরে ভ্রমণ তাই বউয়ের মাতামতটাই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি, বেশিরভাগ প্লানটাই নিশির মত করে সাজাচ্ছি। হঠাৎ করেই জানালো আমরা বাসে ইন্ডিয়া যাবো, ইন্ডিয়ার ট্রেন ভ্রমন নাকি নিশির অনেক দিনের ইচ্ছা। বিষয়টা দেশে ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও খেয়াল করেছি, বিমান বা বাসের চেয়ে ট্রেন ভ্রমণটাকেই সে সাচ্ছন্দ মনে করে।
আমি শুরুতেই বিমানে যাওয়ার পক্ষে থাকলেও যেহেতু নিশির ইচ্ছা ট্রেন ভ্রমণটা এন্জয় করার তাই আমি প্লান চেইন্জ করলাম, ঢাকা থেকে কলকাতার বাসের জন্য তেমন একটা ঝাক্কি ঝামেলা করতে হয়না কিন্তু ইন্ডিয়ার ট্রেনের টিকেট কাটতে অনেক প্যারাই পরতে হয়। মনমতো সিট পাওয়া যায়না তার উপর দুজন যাচ্ছি সুতরাং ছোট্ট একটা কেবিন না হলে সমস্যাই হবে। এটাতো আর ৩/৫ ঘন্টার জার্নিনা যা কোন রকম হলেই হবে, ৩৪/৩৬ ঘন্টার জার্নি একটু আরাম করতে না পারলে আমার মতো দূর্বল মানুষ হোটেলে ঘুমিয়েই ফিরে আসতে আসতে হবে। ইন্ডিয়া দেখার স্বাধটা থেকেই যাবে।
কলকাতায় আমার ফ্রেন্ড এর সাথে কথা বল্লাম, উনার পরামর্শে আমাদের প্লানটা একটু চেইন্জ করলাম। যেহেতু বউ নিয়ে যাচ্ছি তাই কলকাতা থাকে দিল্লি হয়ে তাজমহল দেখে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, তাতে করে ২/৩ দিন আরও সময় বাড়াতে হবে। তাজমহল দেখার কথা বলাতে বউ একবাক্যে রাজি, আর কোন প্রশ্ন করার অপশন রাখলনা।
কি আর করার, বউয়ের মত করে এবারের ভ্রমণটা হবে তাই আমি কোন কিছুই না করতে পারলাম না।
ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার বেষ্ট সার্ভিস নাকি শ্যামলী পরিবহন, যদিও দেশের বাসে এই প্রথম আমার ভ্রমন। শ্যামলী পরিবহনের কলাবাগান কাউন্টারে এক বন্ধু জব করে, উরে বলে দুইটা টিকিট ম্যানেজ করলাম, সাধানরত এইসব বাসের টিকিট ১৫/২০ আগেই নাকি করতে হয় আজকে ভাগ্যগুনে দুইটা টিকিট পেলাম একজন তাদের টিকেট ফেরত দিতে এসেছিলো। বেনাপুল বর্ডার দিয়ে আমরা ইন্ডয়া প্রবেশ করবো, স্থল বন্ধরে দেশ ত্যাগ এটাই আমার প্রথমবার তাই অনেক কিছুই অজানা ছিল।
শুরুটাই হল ফ্রিতে, বউ নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছি শুনে বন্ধু গিফট হিসাবে দুইটা টিকিট দিলো। রাত্র ১০.৪৫ মিনিটে আমাদের গাড়ি ছাড়বে।
হাতে একটু সময় নিয়েই বাসা থেকে বের হলাম, রাস্তাু যানজটের বিষয়টা মাথায় রেখে ৬টার দিকেই বের হলাম। নিশি সব সময় বোরকা পরে চলাচলা করাতে একটু সুভিধা আছে, রেডি হতে অন্যদের মতো ২/৩ ঘন্টা সময় লাগেনা। আমিও বিষয়টা ভালই উপভোগ করি, এই যেমন আমি রেডি হতে হতেই নিশিও রেডি। ব্যাগপত্র রাতেই গুছিয়ে রেখেছিলাম, আমি একা ভ্রমণে ব্যাগপত্র নিয়ে তেমন চিন্তা করতে হয়না। কাধের ব্যাগে একটা পেন্ট শার্ট লুঙ্গি গামছা আর ল্যাপটপ নিয়ে বেরিয়ে পরতে পারি, আমার লুঙ্গি নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার বিষয়ে অনেকেই হাসাহাসি করেন কিন্তু আমি রাতে লুঙ্গি না পরলে মনে হয় ঘুমাইনি ঘুমাইনি একটা ভাব কাজ করে। বাঙ্গালি মানুষ মনের সুখে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বিছানার এমাথা ঐমাথা করে ঘুমাতে না পারলে তৃপ্তি পাওয়া যায়না।
এবারের বিষয়টা ভিন্ন, সাথে অনেক কিছুই নিতে হচ্ছে। লাগেজে নিজের জামা কাপর দেখে নিজেই অবাক হলাম, এত কাপড় পরার সময় পাবো কখন!!!!!!!
বউ গুছিয়ে নিচ্ছে, আমি কিছুই বলতে পারলামনা।
বাসা থেকে একটা অটো নিয়ে ছুটলাম বিরোলিয়া ব্রীজের কাছে, ঐখানের মটকা চা না খেলে ভ্রমণে বড় রকমের অতৃপ্তি থেকে যাবে। দুজনে অটো থেকে নেমে দুইটা চা নিলাম, নিশি পাশে বসে কত রকমের ছবি তুলছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছবি তুলার কি আছে বিষয়টা বুঝিনা, কাপ হাতে নেব আর মনের সুখে খাব। এক কাপে তৃপ্তি না আসলে আরেক কাপ নেব, ছবি টবিতে সময় নষ্ট করার মানুষ আমি না। যদিও ট্যুর শেষে বাসায় এসে ছবি গুলি দেখে মনে হয়েছে, ভালই করেছে এইসবও একটা স্মৃতি হিসাবেই থাকবে। যখন বুড়ো হয়ে যাবো সোনালি দিনের খুঁজ এইসব ছবিতে পাব।
চায়ের পর্ব শেষ করে আমরা একটা "প্রাইভেট" লেখা সিএনজি নিয়ে কলাবাগান শ্যামলী কাউন্টারের দিকে ছুটছি, এত বছরেেও জানতে পারলাম না এই সিএনজি গুলিতে "প্রাইভেট" লেখা কেন। লেখা যাই থাকুক আমার গন্তব্যে পৌছাতে পারাটাই বড় কথা, যদিও একটু টেনশন হচ্ছিল নিশিকে নিয়ে। নিশি বাসে একেবারেই জার্নি করতে পারেনা, জানিনা এতটা পথ কিভাবে জার্নি করবে। যদিও বমির সকল প্রিপারেশন বাসা থেকেই নিয়ে বের হয়েছি।
ঢাকার ঐতিহ্য যানজট কাটিয়ে আমরা ৮.৩৫ মিনিটের দিকে কাউন্টারে এসে উপস্থিত হলাম, সেই লেংটা কালের বন্ধুর সাথে অনেক বছর পর দেখা। এত বছর দেখা না থাকলেও ফেইসবুকের মাধ্যমে টুকটাক কথা হতো, এসএসসির পরই সে পরিবহন সেক্টরের দিকে ঝুকে পরে। এখন ভালো অবস্থান তৈরী করেছে, শ্যামলী পরিবহনের বড় পদে আছে। বন্ধুদের এমন বড় জায়গাতে জব থাকলে মাঝে মাঝে ফ্রিতে টিকেট পাওয়া যায় আবার আড্ডার মাঝে দামি দামি খাবারও পাওয়া যায়।
বাস ছাড়ার আগমুহুর্ত পর্যন্ত আমরা ভালই আড্ডা দিলাম, এতদিন পর দেখা হবে তাই সে তার বউ বাচ্চাকেও নিয়ে আসছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। প্রায় দেড় ঘন্টা জমিয়ে আড্ডা দিয়ে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠতে গেলাম, সে নিজে দাড়িয়ে থেকে সুপারভাইজার ড্রাইভারের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলো। বাসের ফ্রি খাবার না দিয়ে নিজেই পাশের ক্যান্টিন থেকে দুই প্যাকেট খাবার হাতে দিলো সাথে ভ্রমণ সঙ্গি চিপস বাদাম চানাচুর পানি এইসবতো আছেই।
এই বাসের সার্ভিস কেমন জানিনা, তবে সময়ের এক মিনিটও দেড়ি করেনি দেখে ভালই লাগছে। আমদের সিট সামনের দিকেই ছিল, দুজন সুন্দর মতো বসে নিজেদের গল্প শুরু করতেই সুপারভাইজর কম্প্লিমেন্টরি প্যাকেট দিয়ে গেছে সবাইকে। আমার মনেহয় কেউ এই খাবার খাইনি, বক্সের ভিতর দুই পিছ রুটি একটা মিষ্টি আর সিদ্ধ ডিম। সন্ধ্যার দিকে প্যাকেট করাতে এক কথায় খাবারের অনুপযোগি সব কিছু শুধু পানির বোতলটা ছাড়া। বন্ধু মনে হয় বিষয়গুলি ভালই জানে তাই নিজেই আমাদের খাবার কিনে দিয়েছে।
শ্যামলী বাসে ফেরি পারাপারে ভিআইপি সুবিধা পেলেও রাস্তায় কোথাও খাবারের বিরতি না দেয়াতে যারা খাবার নিয়ে উঠেনি তারা একটু কষ্টই করতে হইছে, আমরা যে পরিমান খাবার নিয়ে উঠেছি তাতে আরো ৪/৫ জনের সাথে শেয়ার করতে পেরেছেি। সহজ কথায় ফ্রি খাবারে ভালই আপ্যায়ন করলাম কয়েক জনকে।
জার্নিতে আমার ঘুমের একটা ভাব থাকে, বিমানে উঠেই ঘুমিয়ে পরতাম যখন ঘুম ভাঙ্গতো তখন দেখতাম বিমানবালা খাবার নিয়ে আসছে। কখন বিমান টেকঅফ করছে বুজতেই পারিনি। নিশিকে পাশে নিয়ে এমনটা করা যাবেনা, তাখলে কপালে দুঃখই আছে। অনেক কষ্টে নিজের ঘুম কন্ট্রোল করে বউয়ের সাথে গল্প করছি।
অনেকদিনের স্বভাবতো আর দূর করা যায় না, গল্প করতে করতে কখনযে ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতেই পারিনি। যখন ঘুম ভাগছে ততক্ষনে বেনাপুলে পৌছে গেছি, ঘড়িতে তখন সময় ৬.১৫ মিনিট।
সিরিয়াল দিয়ে সবাই বাস থেকে নামছে, এখন নাকি নিজেদের ব্যাগপত্র নিজেরা কেরি করে ইমিগ্রেশনের লাইনের দাড়াতে হবে। নতুন এক অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য এক হাতে বউ আর একহাতে লাগেজ ধরে লাল রং এর ইমিগ্রেশন বিল্ডিং এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি......
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩২