এমন একটা দেশ চাই না আমি!
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আচ্ছা,মানুষ সবচেয়ে ভালবাসে কোন জিনিসটা?
তার জীবন? সম্মান?
এখন,ওগুলোরই যখন কোন নিরাপত্তা থাকে না, তখন থাকেটা কী?
চিটাগাঙ নিউমার্কেটের পাশেই আমার অফিস। প্রতিদিন বের হয়ে মার্কেটের সামনের ফুটপাথ ধরে কদ্দুর এসেই তবে বাসায় ফেরার গাড়ি ধরি। কালও ব্যতিক্রম হয় নি।
টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করতে গিয়ে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। রাত নয়টা করে ফিরছিলাম। হঠাৎ জটলা দেখে একটু থমকালাম। দেখি,মার্কেটের সামনে দোস্ত বিল্ডিঙের অপর পারে একটা সিএনজি ট্যাক্সিকে ঘিরে কিছু উৎসাহী তরুণের চেঁচামেচি- এর সাথে উৎসুক জনতার কমতি নেই। কমদামে ভাল ক্যামেরার এই যুগে কিছু সৌখিন ক্যামেরাম্যানও জুটে গিয়েছে। সিএনজি-এর ভেতরে থাকা লোকজন(ক’জন বুঝতে পারছিলাম না) দরজা আটকে বসে আছে আর ২২-২৫ বছরের ছেলেগুলো অশ্রাব্য গালিগালাজের সাথে ওদের বের করার চেষ্টা করছে। কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ আর হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে ভীড়ের মাঝে যাওয়ার সাহস-উৎসাহ কোনটাই পেলাম না। একটু দূরে আইল্যান্ডের উপর দাঁড়িয়ে সমস্যা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
আচানক, সিএনজি-এর উপরের কভার ছিঁড়ে ফেলে সে অবস্থাতেই ভেতরে থাকা মানুষগুলোকে হাতের কাছে যা আছে তাই নিয়েই পেটানো শুরু হয়ে গেল। একজন ট্রাফিক পুলিশ কিছুতেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিল না। এর মধ্যে ধাক্কাধাক্কিতে সিএনজিটা কাত হয়ে পড়েই গেল আর তার ভেতর থেকে একজনকে বের করে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে সে কী ধুন্ধুমার মার! মেরেই ফেলবে মনে হচ্ছিল। আর থাকতে না পেরে এক দৌড়ে রাস্তা পার হতে হতে দেখি মানুষটা ইতিমধ্যে সম্ভবতঃ সেন্সলেস হয়ে গেছে আর বীর পুঙ্গবেরা উধাও। বাকি দর্শকেরা গোল হয়ে তামাশা দেখছে।
তাড়াতাড়ি দৌড়ে কাত হয়ে থাকা সিএনজিটার কাছে গিয়ে দেখি ভেতরে একজন নারী, পিটিয়ে বিবস্ত্র করে ফেলা হয়েছে-প্রানভয়ে বাইরে বেরুচ্ছে না। এর মধ্যে আমার পেছনে দাঁড়ানো একজন প্রস্তাব দিয়ে বসল, “জ্বালিয়ে দে”। তাকিয়ে দেখি- এই লোক আমার মতই ঘটনার আগ-পাশ কিছুই জানে না, অথচ, কী মহা উল্লাস আর আক্রোশে জ্বালিয়ে দিতে চাইছে আর জনতার কী উল্লসিত সায়!! যে দুই-একজন(এর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের চিটাগাঙ নগরের সভাপতি ছেলেটাও ছিল, নাম জানি না) মহিলাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে- তারাও রোষের শিকার!
আমার গা’ কাঁপতে শুরু করল। নিজের সাহসহীনতা-কাপুরুষতা আর মানুষের উদগ্র মনুষত্বহীনতায় বোধশক্তিহীন আমি আস্তে করে ভীড় ছেড়ে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে একটা টুলে বসে পড়লাম।
কপাল ভাল, মাত্র তিনশ গজ দূরে থাকা কোতোয়ালী থানা থেকে পুলিশ ফোর্স ততক্ষনে এসে পড়ল( তিনশ গজ পেরুতে আধঘণ্টার বেশি লাগল-তাও তো এলো)! এবং পুলিশ আসার সাথে সাথে শুধু যারা বাঁচাতে চাইছিল তারা ছাড়া বাদ বাকি তামাশা দেখনেওয়ালারা চোখের পলকে উধাও- মারপিটকরনেওয়ালারা তো নাইই। আসলে কী ঘটেছিল- কোথা হতে সূত্রপাত কিছুই নিশ্চিতভাবে জানা গেল না। যদ্দুর জানা গেল, তা হচ্ছে- রাতে ঐ সময়ে নিউ মার্কেটের ওখানে দেহপশারিনীরা খদ্দেরের জন্য দাঁড়ায়। মেয়েটা এমনই একজন আর লোকটা তার দালাল। দু’জনে মিলে কাঊকে ফাঁসাবার চেষ্টা করছিল- তাও নিশ্চিত না। আহতদের থানায় কিংবা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আপন কর্তব্য সম্পাদন করলেন।
জন্মদিনের শেষবেলাটা এমন হবে ভাবতেই পারি নি আমি।
আচ্ছা, যারা কিছু না জেনে, না বুঝে মানুষ দু’টোকে পেটালেন, তারা কি কাল রাতে অন্য দিনের মতই বাসায় ফিরে স্ত্রী-সন্তানের সাথে বসে ভাত খেতে পেরেছেন? ঘুমন্ত সন্তানের কপালে চুমু খেয়ে স্ত্রী সাথে শুয়ে ভাব-ভালবাসা করেছেন? মানুষের ভেতরে ঠিক কোন জিনিসটার অভাব হলে- এমন দ্বৈত জীবনযাপন করা সম্ভব? আমি তো ঘুমাতে পারি নি অনেকক্ষন। ঠিকমত গলা দিয়ে ভাত নামে নি!
আচ্ছা, আমি কি পেছনে পড়ে যাচ্ছি। ব্যাকডেটেড থেকে যাচ্ছি। শহুরে হতে পারছি না!
সব মিলিয়ে কী দাঁড়ালো?
১। একটু ভীড়ের মাঝে দুই-চারজন মিলে আমাকে কোনদিন চোর বলে চিৎকার দিলে আমার আর বাঁচার উপায় নেই- আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও আমি পাবো না!
২। একজন মানুষ দালাল হতে পারে- দেহপশারিণী হতে পারে। কিন্তু, তার জীবনের, তার সম্মানের কোন দাম নেই! বিবস্ত্র করে পেটাতে হবে? জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলতে হবে?
৩। ৩০০ গজ দূর থেকে আমাদের আইনের রক্ষকদের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অকুস্থলে আসতে আধা ঘন্টা লেগে গেলে, আমার ট্যাক্সের টাকায় এই অথর্বদের পুষে লাভটা কার?
৪। গনপিটুনির সময় আমি জনতার যে আক্রোশ দেখি- তার সিকি ভাগ যদি এদেশের সত্যিকারের চোর-বাটপারদের উপর, অধিকার হরণকারীদের উপর দেখানো যেত- দেশটা বহুদুর এগিয়ে যেত। কিন্তু, না। আমরা এদের পেছনেই ‘জয়-জিন্দা-নারায়ে’ ধ্বনি তুলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি!
৫। ঐ দেহপশারিনী-দালালের চাইতেও নিকৃষ্ট আমি-আমরা। জঠরজ্বালা নেভাতে আর দেহের ক্ষুধা মেটাতে এরা অর্থের বিমিময়ে সম্মান বিক্রি করে। আর আমরা কোন দায়িত্ব না নিয়েই হাতের সুখ মিটিয়ে- নগ্ন নারী দেহ উপভোগ করে পুলিশ আসার আগমূহুর্তে সটকে পড়ি।
এমন একটা রাষ্ট্র কেমন করে চাইতে পারি আমি?
রাষ্ট্রদ্রোহিতা হলে হোক, আদালতে দাঁর করিয়ে রাখলে রাখুক, তবু বলছি- এ ব্যবস্থা উলটে দিতে হবে- নপুংসক এই আমাদের ভেতরের নষ্ট বীজটাকে দিনের পর দিন বাড়তে দিয়ে যে বিষবৃক্ষের চাষ আমরা করেছি, এর জাড়সুদ্ধ উপড়ে দিতে হবে।
আর নয়তো পালাতে হবে- বহুদুরে।
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর


আলোচিত ব্লগ
বাংলাদেশ, চীন ও ভারত: বিনিয়োগ, কূটনীতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
প্রতিকী ছবি
বাংলাদেশের বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। চীন সফরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরছেন, যা দেশের অর্থনীতির জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
অদৃশ্য দোলনায়
ভোরের রোদ্র এসে ঘাসের শিশিরে মেঘের দেশে চলে যেতে বলে
শিশির মেঘের দেশে গিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঘাসের মাঝে ফিরে আসে-
বৃষ্টি হাসে শিশিরের কথায়। তাহলে আমরা দু’জন কেন প্রিয়?
এক জুটিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ড. ইউনূসকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান....
ড. ইউনূসকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান....
বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। শনিবার (২৯ মার্চ) এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্রঋণ ও... ...বাকিটুকু পড়ুন
ড. ইউনুস: এক নতুন স্টেটসম্যানের উত্থান
ড. মুহাম্মদ ইউনুস ধীরে ধীরে রাজনীতির এক নতুন স্তরে পদার্পণ করছেন—একজন স্টেটসম্যান হিসেবে। তার রাজনৈতিক যাত্রা হয়তো এখনও পূর্ণতা পায়নি, তবে গতিপথ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তার প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে মেপে নেয়া,... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর কেমন হলো ?
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এখনো চীন সফরে রয়েছেন। চীন সফর কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এক শ্রেনীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক হাইপ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সাসেক্সফুল সফর আর কোনো দলের... ...বাকিটুকু পড়ুন