দুনিয়া একদিকে আর কটকটিওয়ালা একদিকে। মূহুর্তে সব গুটি চালাচালি শেষ। খাটের নীচে, আলমারির পেছনে, ময়লার ঝুড়িতে খোঁজ-খোঁজ রব! ফেলে দেয়া জং ধরা লোহা, পুরনো ঔষধের বোতল, ফেলে আসা বছরের বেঁচে যাওয়া বই-খাতা, ছেঁড়া স্যান্ডেল - যাই হাতের কাছে পাই তাই নিয়ে এক দৌড়ে কটকটিওয়ালার কাছে।
কটকটিওয়ালা তার জিনিসপত্রের বস্তা আর সেই আরাধ্য কটকটি রাখা ঢাকনা দেয়া ডিব্বা মাথা হতে নামায়। ছেঁড়া-ফাটা জিনিসগুলো নিক্তিতে ওজন করে। তারপর, আস্তে করে আধময়লা ঢাকনাটা সরিয়ে ছেনী দিয়ে কেটে ছোট্ট একটুকরা-দুইটুকরা চিটচিটে কটকটি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বলতো, “আর কিছু নাই?” তার সেই আকূল আহবান শুনে (আসলে আরো কটকটির লোভে) প্রানটা ছিঁড়ে যেত। মনে হোত, রান্নাঘরের অ্যালুমিনিয়ামের কলসিটার বয়স হয়েছে; ইট দিয়ে দুইটা বাড়ি দিয়ে ঐটার চেহারা বদলিয়ে কটকটিওয়ালাকে দিয়ে দিই। নিদেনপক্ষে, মায়ের ঔষুধের শিশির ঔষধ ফেলে কয়েকটা খালি করে নিয়ে আসি! বলা বাহুল্য, মা’য়ের রামধোলাইয়ের ভয়ে এসবের কিছুই কাজে রূপান্তরিত হোত না। কটকটিওয়ালা মন খারাপ করে চলে যেত। সাথে করে নিয়ে যেত সেই মন কেমন করা ডাক-“কড্কডীঈঈঈঈঈঈ, আছে ভাং-গা চু-রা হা-ড়ি পাতিইইইইইইল; কড্কডীঈঈঈঈঈঈ.....”। ’৮০ আর ’৯০ এর দশকের সব বাঙালী বাচ্চার জীবনেই এটি সাধারন ঘটনা। আগের আর পরের দশকের বাচ্চাদের কথা জানি না।
রবীন্দ্রনাথের সময়ে নিশ্চয়ই কটকটিওয়ালা ছিল না! নইলে ‘ডাকঘর’ নাটকের অসুস্থ অমলের সাথে দইওয়ালার বদলে কটকটিওয়ালারই দেখা হয়ে যেত- আমি নিশ্চিত।
যাই হোক, সে সময়ের সেই পরম আরাধ্য কটকটি সম্পর্কে এখন জানি। মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। আখের গুড়ের তলানিতে স্যাকারিন দেয়া পোড়া তেলে ভাজা এই জিনিস আমাদের পেট খারাপের জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল। অথচ, কী দারুন নেশাই না ছিল! পারলে ঘরের আসবাবপত্র সব দিয়ে হলেও কটকটি খেতে মন চাইতো। ঘরের বাতিল জিনিসপত্রগুলোও মা’ অনেক সময় দিতে চাইতেন না। মেজাজ ভীষন খারাপ হয়ে যেত। এখন বুঝি। একটু একটু করে টাকা জমিয়ে যেগুলো সংসারের জন্য কেনা হয়েছিল, সেসব তখন বাতিল হয়ে গেলেও সেগুলো এক নিমিষে ফেলে দিতে মা’য়ের মন চাইতো না! ওদিকে, কটকটিওয়ালারও কটকটি দেবার বেলায় কোন নির্দিষ্ট পরিমাপ ছিল না। হাতের আন্দাজে যাই দিতো, তাই নীরবে মেনে নিতে হোত! কখনো-সখনো বেশী গাঁই-গুঁই করলে আরো এক চিমটি ভেঙ্গে হাতে দিয়ে দিতো! আমরা তাতেই খুশি!
ধান ভানতে গিয়ে অনেকক্ষন ধরে শিবের গীত গাইলাম। এবার, ধান ভানি। এদেশের কর্পোরেট কম্পানিগুলোকে আজ কেন জানি ঐ কটকটিওয়ালার মত মনে হচ্ছে আর নিজেদের সেই অবুঝ বালকের দল।
একথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, ইতিহাসের সঠিক পাঠ এবং জ্ঞান, একটি জাতির ভবিষ্যতের সোনালী রাজপথ নির্মান করে আর ভুল পাঠ জাতিকে পথ হতে ছিটকে ফেলে দেয়। ’৪৭ এর দেশ বিভাগের পর নতুন গঠিত বহুভাষাভাষী পাকিস্তান নামক জগাখিচুড়ি রাষ্ট্রের অনেকগুলো বড় বড় সমস্যার মধ্যে রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাঙলাকে পদদলিত করে মাত্র ৬ ভাগের মাতৃভাষা উর্দূকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহন করার পাঁয়তারা কষে শাসকগোষ্ঠী। এরই প্রতিরোধে ’৪৮ এ ‘তমদ্দুন মজলিস’, তারপরে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। শুরু হয়ে যায় বাংলা ভাষার স্বপক্ষে জনমত গঠন। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহরা লেখালেখির মাধ্যমে বাঙলার সপক্ষে জোরালো দাবী জানাতে থাকেন। ’৫২ আসে এরই ধারাবাহিকতায়। ২১ শে ফেব্রুয়ারির ঐ ৩০ মিনিটের মিছিল ছিল একটা স্ফুলিঙ্গ মাত্র। এর আগের চার বছরের নিরলস পরিশ্রমে গড়ে ওঠা জনমত যখন তাজা বারুদের মত তৈরী হয়ে বসেছিল তখনি ঐ স্ফুলিঙ্গ সেখানে বিস্ফোরন ঘটায়; ফলশ্রুতিতে অত্যাচারীরা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়। তাই, পূর্বেকার এই চার বছরের ইতিহাসই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, একুশে ফেব্রুয়ারি তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

আজ (একুশে ফেব্রুয়ারি ‘২০১০ খৃষ্টাব্দ-সবাই জানে; নয়ই ফাল্গুন ‘১৪১৬ বঙ্গাব্দ-বেশিরভাগই জানে না) বিকেল ৩টায় ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সী গেইটের সামনে হবে মিছিল, ভাষার মিছিল। মনে পড়ে যাবে, প্রায় ছয় দশক আগে ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তে ঝড় তোলা মিছিলের কথা, যার উপরে গুলিবর্ষনের ফলে শহীদ হন সালাম, বরকতেরা; আর বাঙলা পায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। শুনতেই গা শিউরে ওঠে, রোম খাড়া হয়ে যায়। আজকের প্রজন্মের তরুনেরা যাদের অনেকের পিতা-মাতারও জন্ম হয় নি সেদিন, কত অনায়াসে সেদিনের সেই রোমাঞ্চ (থ্রিলিং [Thrilling]-এর কোন ভাল বাঙলা পাচ্ছিলাম না; ‘উত্তেজনা’ শব্দ দিয়ে পুরোপুরি ভাবটা উঠে আসে না; সাঈফ শেরিফের কাছে কৃতজ্ঞতা) মূহুর্তগুলোকে অনুভব করার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের তো আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু, আমি পারছি না কেন?
পাঁচ-ছ’টা চ্যানেল পৃষ্ঠপোষক হয়েছে, সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিক বদলানোর শপথে সাথেই আছে, আর কাছে থাকার প্রত্যয়ে দেশের সবচেয়ে বড় টেলিযোগাযোগ সেবাপ্রদানকারী তো আছেই। মিডিয়াতে নিজের চেহারা, নিজের দেশপ্রেম আর আবেগ দেখানোর এত বড় মওকা হাতছাড়া করে কোন পাগলে! আমি জানি, উদার বিপণণের এই যুগে , হুজুগে বাঙালী কাতারে কাতারে ঐ ৩০ মিনিটের মিছিলে সামিল হবে। গলা ছেড়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দেবে আর সেই অন্তঃসারশুন্য স্লোগানের নিচে ছাপা পড়ে এদেশের অন্য সকল ঘটনার মত ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাসও কেঁদে মরবে। এটাই সবচেয়ে কষ্টের কথা। আরো কষ্টের কথা, আমরা কটকটিওয়ালাদের কাছে আমাদের অতীত বেচতে শিখে গিয়েছি, বর্তমানকেও পিটিয়ে বাঁকাত্যাড়া করে বিকিয়ে দিতে খুব বেশী সময় লাগার কথা নয়!
নজরুল তাঁর জীবনের শেষ অভিভাষনে বলেছিলেন, “যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়ত বা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে। দেশপ্রেমী, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী- বিশেষনের পর বিশেষন। টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পর মেরে। বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রার্থ্য দিনে বন্ধু তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ কোর। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বোল, ‘বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি’।” ভাষা মানুষের মুখে কথা হয়ে ধরা দেয় কিন্তু নিজে বলতে পারে না। বাংলা ভাষা যদি আজ কথা বলতে পারতো, তবে এভাবেই বোধহয় বলে উঠতো।
ইতিকথাঃ
কোন এক ফারসী কবি (শেখ সাদী কিংবা হাফিজ-মনে নেই) কবিতায় পড়েছিলাম, “গোয়ালা তার পণ্য (দুধ) বেচতে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে মরে, কেউ কেনে, কেউ কেনে না। আর মদওয়ালা মদের পিপে নিয়ে নিজের ঘরেই বসে থাকে; লোকেরা খুঁজে খুঁজে সে ঘরে এসে যায়!” আমরা আজো আমাদের দুধওয়ালাদের চিনতে পারি নি, মদের পিপেতেই সান্ত্বনা খুঁজে চলেছি।
সবাইকে ভাষা দিবসের শুভেচ্ছা।
..............................................................
ইতিকথার কথার পরের কথাঃ
১. কট্কটিঃ সিদ্ধ চালের সাথে আখের গুড় মিশিয়ে তেলে ভাজা এক প্রকার মিষ্টান্ন। কীভাবে কট্কটি বানাতে হয়, তা জানতে পারবেন এখান হতে।
২. কট্কটিওয়ালা স্মৃতি ফিরে পেতে সাহায্য করেছেন অকালে বিদায় নেয়া ব্লগার কেল্টূ দা। আহারে ! কটকটি খাইতে মনচায় ।
৩. ১৯৪১ সালের ৬ই এপ্রিল মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে "বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি"র রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি রূপে নজরুল একটি অভিভাষণ দান করেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাক্রুদ্ধ হয়ে যাবার পূর্বে “যদি আর বাঁশী না বাজে” শীর্ষক এই অভিভাষনই ছিল তাঁর জীবনের সর্বশেষ বক্তৃতা।
৪. ৩০ মিনিটের মিছিলের কাঁটাছেঁড়া করে ব্লগার দিনমজুর লিখেছেন, ৩০ মিনিটের ভাষা আন্দোলন এবং গ্রামীণ ফোনের ”কাছে থাকা”! তথ্য আর বক্তব্যে ওটা দূর্দান্ত হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:৫৭