আমাদের প্রজন্মের বেশীরভাগেরই মানিকের সাথে পরিচয় উচ্চ মাধ্যমিকে "পদ্মা নদীর মাঝি" দিয়ে। আর সাহিত্যকে বড়-ছোট প্রশ্ন আর ব্যাখ্যা-টীকা-টিপ্পনীর যাঁতাকলে ফেলে এর মূল মজা নষ্ট করে দিয়ে পাঠক সত্ত্বাটিকে মেরে ফেলতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কোন জুড়ি নেই (অবশ্য নটরডেমের মুখতার স্যারের ছাত্রদের কথা আলাদা) । আমার সৌভাগ্য পদ্মা নদীর মাঝির আগেই আমি পুতুল নাচের ইতিকথা পড়তে পেরেছিলাম। আর মানিকের অসাধারণত্বকে তখনই ধরতে পেরেছিলাম।
সেই টিনএজ বয়সে শশীডাক্তার আর বন্ধু পত্নীর মাঝে গড়ে ওঠা ঘরভাঙা প্রেমের অমন পরিণতি মনের উপরে সত্যিই কেমন একটা ছাপ ফেলেছিল। মানিকের প্রায় সব উপন্যাসেই যে প্রেমগুলো উঠে আসে সেগুলো কেন যেন সামাজিকভাবে সমর্থনযোগ্য হয় না। অথচ, মানবপ্রেমের গহীন প্রদেশের কোণায় কোণায় আলো ফেলে এত দারুনভাবে চিত্রকল্প তৈরী করেন মানিক যে, সে প্রেমগুলোকেও অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। এখানেই বোধ করি মানিকের সাফল্য!
পুতুল নাচের ইতিকথার গল্প আবর্তিত হয়েছে গাওদিয়া গ্রাম ও এর আশেপাশের জনপদকে ঘিরে। গ্রামের সুদী মহাজন গোপালের একমাত্র ছেলে শশী কোলকাতা থেকে পাশ করা ডাক্তার। পিতার কাজে অসন্তুষ্ট শশী যেন পিতৃপাপের প্রায়শ্চিত্য করতেই যেন গ্রামের গরীব-দুঃখীর সেবায় আত্ননিয়োগ করে। অন্যদিকে, পরান ঘোষের স্ত্রী কুসুম। সুখে-অসুখে শশী পরানের পারিবারিক পরামর্শদাতা-বন্ধু। এভাবেই কখন যে কুসুমের মন জুড়ে শশীর রাজত্ব শুরু হয়ে গেল কুসুম নিজেই টের পেল না। গাঁয়ের মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট সাহসী কুসুম। তাই, নিজের ভালোলাগাটুকু জানিয়ে দিতে কুসুমের কোন জড়তা নেই। বাড়ির পাশে তালবন; সেখানেই তাদের গোপ্ন অভিসার। কখনো আকারে-ইঙ্গিতে, কখনো সরাসরি, কখনো বা মান-অভিমানের ছলে শশীর বাগানের চারা গাছটাকে মাড়িয়ে আবার কখনো চরম মমতায় দীর্ঘ নয় বছর সে শশীর ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করে। এদিকে, সামাজিক দায়ভার আর সিদ্ধান্তহীনতায় শশী বুঝেও না বোঝার ভা করে এড়িয়ে চলে। কুসুমের আত্ননিবেদন যখন "সইতে পারি না ছোটবাবু", -এই সংলাপ আকারে বেরিয়ে আসে, তখন শশীই তাকে বাস্তবে ফেরায়। বলে, "আমরা ছেলেমানুষ নই। ইচ্ছে হলেই একটা কাজ কি আমরা করতে পারি? বুঝে-সুঝে কাজ করা দরকার।" এ দীর্ঘ সময়ে সে যে কতভাবে শশীকে জাগিয়ে তুলতে চায়! বলে, "এমনি চাঁদনী রাতে আপনার সাথে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু।.......আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শশীর এমন করে কেন ছোটবাবু?"। কিন্তু, শশী অবিচল। ভাবে, "শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?"
মৃত যাদবকাকার উইল করে যাওয়া সম্পত্তি দিয়ে হাসপাতাল তৈরীর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে শশী। যামিণী কবিরাজের অল্পবয়স্কা শ্ত্রী সেন্দিদির বসন্ত রোগের সময় দিনরাত সেবা করে শশী। এভাবে গাঁয়ের লোকের মাঝে তৈরী হয় তাঁর একটি বিশিষ্ট স্থান। ঠিক তখনি যেন সে আবিষ্কার করে যে, অনেক লোকের ভীড়ে থেকেও আসলে সে বড়ো একা। সকলের চোখে সম্মানিত; সকলেই ভাল-মন্দ সব বিষয়ে তার মতামত প্রত্যাশী। তবু সে একা।
তাইতো, এতদিন যে শশী নিঠুর পায়ে দলেছিল প্রেমের অর্ঘ্য, একদিন সেই শশীই কাঙালের মত ছুটে যায় কুসুমের কাছে। বলে, "যেখানে হোক। যেখানে হোক চলে যাই, চল আজ রাত্রে।" কিন্তু, এবার কুসুমই তাকে ফিরিয়ে দেয়! বলে, "কেন যাব?...... আপনি বুঝি ভেবেছিলেন যেদিন আপনার সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি অমনি সুড়সুড় করে আপনার সঙ্গে চলে যাব? কেউ তা যায়?"। শশীর রক্তাক্ত হৃদয় যখন অনুযোগে শুধোয়, "একদিন কিন্তু যেতে.", তখন আহত বাঘিনীর মত কুসুম বলে ওঠে, "স্পষ্ট করে ডাকা দূরে থাক, ইশারা করে ডাকলে ছুটে যেতাম।....আজ হাত ধরে টানলে ও আমি যাব না।" নিজেকে কুসুম সেই তাতানো লোহার সাথে তুলনা করে যা অবহেলায় ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে! তারপর, গাওদিয়ার পাঠ চুকিয়ে কুসুম স্বামীসহ চলে যায় বাপের বাড়ি।
মন ভাঙা শশীও ছেড়ে দিতে চায় গাওদিয়া। প্রথমে কোলকাতা, সেখান হতে বিলেত- এই চিন্তায় সবকিছু গুছিয়ে নিতে থাকে সে। কিন্তু, এবার, খেল দেখায় তার পিতা গোপাল। আজন্ম সংসারী-অর্থগৃধু গোপাল সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করে। সাথে করে নিয়ে যায় সেন্দিদির মা’হারা সন্তান্টিকে যার পিতৃত্বের ব্যাপারে শশীর সন্দেহের আঙুল সবসময়ই তাক করা ছিল পিতা গোপালের দিকেই! অতএব, শশী আর কী করে! "এ ভার তো ফেলিবার নয়"।
শশী-কুসুম ছাড়াও উপন্যাসে কুমুদ-মতির ছন্নছাড়া জীবন আর বিন্দু-নন্দলালের অস্বাভাবিক দাম্পত্যজীবনের কথকতাও উঠে এসেছে পুরোপুরি। এছাড়া উপন্যাস জুড়ে নির্বিকারভাবে ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো মৃত্যু-বর্ণনা। আকাশের দেবতার কটাক্ষে (বজ্রপাতে) হারু ঘোষের মৃত্যু দিয়ে শুরু। গাছ হতে পড়ে ভুতো, সন্তান জন্মাতে গিয়ে সেনদিদি আর রথের দিন মরবেন এই কথা রাখতে গিয়ে যাদব-পাগলাদিদি- সবারই মৃত্যু যেন নিয়তির খেল। সবই যেন কোন এক বিরাট শিশুর পুতুল খেলা!
প্রাসঙ্গিক তথ্যঃ ১৯৩৬ সালে প্রথম বাজারে আসার পর এই অসাধারণ উপন্যাস ইংরেজী(১৯৬৮), হিন্দী, কানাড়ি, চেক, সুইডিশ, গুজরাটি(১৯৫৩), তেলেগু প্রভৃতি ভাষায় রুপান্তরিত হয়। এছাড়া ১৯৪৯ সালে এটি অসিত বন্ধ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় চলচ্চিত্রে রুপায়িত হয়। একমাসও চলেনি! ভাল জিনিসের কদর বোধহয় চিরকালই কম।
মানিক এবং পুতুল নাচের ইতিকথা নিয়ে আরো কয়েকটি লেখার লিঙ্ক।
১. সুমন আজাদের সামহ্যোয়ারইনব্লগ
২. দরিদ্রের মানিক, মানিকের দারিদ্র
৩. মানিকের পুত্র সুকান্ত বন্ধ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার
৪. গাওদিয়া নিয়ে একটি রিপোর্ট
……………………………………………………………………………………………..
আগের লেখা।
জীবনে যা পড়েছি-৪ (তারাশংকরের কবি)
জীবনে যা পড়েছি-৩ (পথের পাঁচালী)
জীবনে যা পড়েছি-২ (লোটাকম্বল)
জীবনে যা পড়েছি-১ (লা মিজারেবল)
................................................
পুতুলের ছবিটা অপ্সরার ব্লগ থেকে বিনা অনুমতিতে নেয়া হয়েছে!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০০৯ সকাল ১১:১১