পিতা-মাতাহারা বছর আষ্টেকের এক ছোট্ট বালক এতদিন পরম আদরেই প্রতিপালিত হচ্ছিলো পিতামহের কাছে। আজ তিনিও পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন। এ বিরাট পৃথিবীতে এখন এ শিশুর মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও চলে গেল। এমনি সময়ে, অসহায় শিশুটির মাথায় ছায়া দিতে এলেন পির্তৃব্য। দরিদ্র তিনি। ক্ষুদ ব্যবসাতে আয় খুবই সামান্য তাঁর। তার উপরে আছে পুত্র-কন্যা-পৌষ্য নিয়ে বিশাল পরিবারের ভার। তবু, হাসিমুখে ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে গেলেন আপন গৃহে। নিজের সন্তানদের চেয়ে বেশী প্রাধান্য দিয়ে, আক্ষরিক অর্থেই বুকের উপর রেখে প্রতিপালন করলেন এতীম এই শিশুকে; তাও একদিন দু'দিন নয় সুদীর্ঘ ১৭ বছর। ২৫ বছরের যুবক ভ্রাতুষ্পুত্রকে দেশের সবচাইতে ধনী মহিলার সাথে বিয়ে দিলেন। এরপর সুখে-দুঃখে ভালো-মন্দ মিলিয়েই কাটছিল দিন।
১৫ বছর পর। আবার এলো ঝড়। প্রচলিত সমাজের হাজার বছরের লালীত রীতিনীতিকে এক পলকে গুঁড়িয়ে দিতে ৪০ বছরের ভ্রাতুষ্পুত্র এক অনিবার্য বিপ্লবের ডাক দিলেন। সারা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। বন্যার মত বিরোধীতার ঢল নেমে এল। এমন সময়ে আবার অটল পর্বতের মত উঠে দাঁড়ালেন পির্তৃব্য। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ তখন তিনি। তবু, কী সাহস! সকল প্রকারের নিন্দা-উপেক্ষা-অত্যাচারের কালো মেঘ যখন ভ্রাতুষ্পুত্রের পথের উপর ঝড়ের পূর্বাভাসের মত ছায়া বিস্তার করে চলছিল, তখনও তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে সকল বাধা-বিঘ্ন বারেবারে থমকে যাচ্ছিলো। শুধু তাই নয়, কিছুদিন পরেই পুরো সমাজের কাছে ব্রাত্য হয়ে পড়া ঐ নিরীহ যুবক লোকালয় ছেড়ে দূরে এক সংকীর্ণ গিরিগুহার অন্তরালে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হলেন। তখনো, বৃদ্ধ তাঁর পরিবার পরিজন সহ একই পথের পথিক হলেন। একদিন দু'দিন নয়, সুদীর্ঘ তিন বছরের নির্বাসনে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে সকল প্রকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছেড়ে যান নি তাঁর স্নেহের পাত্রকে!
আবু তালিব! কেমন করে মুহাম্মাদকে(স) আপনি এতটা ভালোবাসতেন। কত বড় হৃদয় থাকলে এমন করে ভালোবাসা যায়?
আপনাকে আমি বুঝতে পারি না। এত ভালবেসেও কেমন করে মুহাম্মাদের(স) বাতলে দেয়া পথ অনুসরণে পিছিয়ে রইলেন। নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও যিনি মুহাম্মাদের(স) চলার পথকে মসৃন করেছেন, তাঁর সুরক্ষায় যিনি সকলের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অবিচল একজন হয়ে, সেই তিনিই সত্যকে বুঝতে পেরে, অনুভব করেও রয়ে গেলেন সকলের পেছনের সারিতে!
মনে পড়ে যায়, সেদিনের কথা। কুরাইশের নেতৃবর্গ আপনার কাছে নালিশ জানাতে এসেছিল। মুহাম্মাদের(স) দেখানো পথ তাদের চৌদ্দপুরুষের লালীত অহংকারের সিংহাসনকে টলিয়ে দিয়েছে, তাদের তৈরী করা উঁচু-নিচু ভেদ-বৈষম্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। তাদের সম্মিলিত অনুরোধে আপনি তাঁকে বলেছিলেন ও পথ হয়ে সরে দাঁড়াতেন। বিনিময়ে অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা-নারীর যে প্রস্তাব কুরাইশ নেতৃবর্গ দিয়েছিল, তাই তাঁর সামনে পেশ করলেন। উত্তরে মুহাম্মাদ(স) বললেন যে, সকলে মিলে তাঁকে পরিত্যাগ করলেও তিনি সত্যের পথ ছেড়ে যাবেন না। শুধু কী তাই? তিনি এও বললেন যে, তাঁর এক হাতে আকাশের সুর্য আর এক হাতে চন্দ্র এনে দিলেও এ পথ ছেড়ে দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
সেদিন কী আপনি সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত এক দৃঢ়পদ মানুষকে আবিষ্কার করেন নি? আপনি বোঝেন নি যে, আপনার এই সদা সত্যবাদী ভ্রাতুষ্পুত্রটি বরাবরের মতই এবারেও নিজের মত ও পথের ব্যাপারে সত্য বলেছে?
বোঝেন নি, তাই বা বলি কী করে? না হলে, নিজের আদরের দুই কিশোর পুত্রকে (আলী ও জাফর (রা)) সেই শ্বাপদসংকুল পথে যেতে দিতেন না। নিরস্ত করার বদলে বরং উৎসাহিত করতেন না!
আরো মনে পড়ে যায়, আপনার শেষ শয্যার কথা। মুহাম্মাদের(স) শত অনুরোধে ও আপনি বিশ্বাস বদল করলেন না, এই আশংকায়, পাছে অন্যেরা মনে যে, মৃত্যু যন্ত্রনা আপনাকে দূর্বল করে দিয়েছে। মুহাম্মাদের পথকে সত্য জেনে ও তাঁকে চোখের জলে ভাসিয়ে আপনি ইহধাম ত্যাগ করলেন নিজের লালীত বিশ্বাসের উপর অটল থেকে!
আজ যখন ভাবতে বসি, তখন বারেবারে এই মনে হয়, তবে কি আপনার সকল ভালোবাসা ছিল অকালপ্রয়াত ভ্রাতা আব্দুল্লাহর নিরাশ্রয় পুত্র মুহাম্মাদের প্রতি? সকল নিরাশ্রয়ের সর্বশেষ আশ্রয় যে খোদা, তাঁর বার্তাবাহক মুহাম্মাদকে(স) আপনি বোধহয় ঠিক ওভাবে ভালোবাসতে পারেন নি। সকল কিছু ছাপিয়ে ব্যক্তি মুহাম্মাদই হয়ে উঠেছিল আপনার স্নেহের আধার।
কিংবা আপনার অহমের দেয়াল এতটাই শক্ত ছিল যে, কুরআনের যে বাণীসমূহ সে সময়ে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, সে আগুন ও ঐ দেয়ালে চিড় ধরাতে পারে নি। পুর্বপুরুষ হতে উত্তরপুরুষে পাওয়া রীতিনীতির প্রতি আপনার আনুগত্য এতটাই অন্ধ ছিলো যে, সত্যের সুতীব্র রশ্মিও তাকে আলোকিত করতে অক্ষম ছিল।
কারন যাই হোক, রহস্য যাই থাক, এ জন্যই মুহাম্মদের(স) প্রতি আপনার অপার স্নেহ ও ভালোবাসাকে চিরস্মরণীয় জেনে ও আপনার জন্য দুঃখ হয়। আপনাকে আমার সেই মানুষের প্রতিচ্ছবি বলে মনে হয়, যে কীনা প্রদীপের কাছে বসে থেকেও চিরজীবন অন্ধকারের বাসিন্দা থেকে যায়, কিংবা বিশাল জলাধারের পাশে থাকার পরেও পিপাসাই হয় যার মৃত্যুর কারন!
মানব মন বড় বিচিত্র। শত চেষ্টাতেও তার থৈ মেলা ভার। আপনি, আবু তালিব, কুরআনের সম্মানিত বাহকের নির্ভীক আশ্রয়দাতা ও একান্ত শুভাকাঙ্খী, সে বিচিত্র মনের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকবেন চিরটা কাল।
ওমর (রা)- আল-কু'রআন যাঁকে বদলে দিয়েছিল!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০০৯ সকাল ১১:৩৯