somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার রবীন্দ্র পাঠ, সঞ্চয়িতা এবং একটি স্পর্শকাতর ইস্যু।

০৮ ই মে, ২০০৯ রাত ১১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বয়স তখন সবে চৌদ্দ। নবম শ্রেনীতে উঠেছি। দুনিয়াটাকে মাত্র রঙিন রঙিন লাগা শুরু হয়েছে। সেবা'র পেপারব্যাক আর হুমায়ুনের বালক-বালিকার প্রেমের জগৎ ছেড়ে কাব্যের রাজপথে হাঁটাহাঁটি করতে মনস্থ করেছি। ব্যাপারটা এমন নয় যে তখন কবিতার প্রতি ততটা ভালোবাসা জন্মেছে। আসল ঘটনা ছিলো, বাঙালীর সে বয়সের স্বাভাবিক নিয়মেই, 'তুমি-আমি', 'খাই-যাই' কিংবা 'করি-ধরি' টাইপের ছন্দবিক্ষুব্ধ (!) কবিতা লিখবার জোর প্রচেষ্টা (অপচেষ্টা) চালাচ্ছি। কিন্তু, স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বাইরে তেমন একটা কবিতা পড়া না থাকায় কলম হতে লেখাই বেরুচ্ছিলো না!

ভেবে দেখলাম কিছু কবিতা পাঠ আবশ্যক। পাশেই থাকতেন শ্যামল ভাই (এখন কিশোরগঞ্জ জেলা জজ)। শিল্প-সাহিত্যের সাথে তাঁর বেশ যোগাযোগ ছিল দেখতাম। অতএব, তাঁর কাছে গিয়ে ধর্ণা দিলাম, একটা কবিতার বই চাইলাম। তিনি ধরিয়ে দিলেন 'নির্মলেন্দু গুণ কবিতাসমগ্র'। 'প্রেমাংশুর রক্ত চাই' কিংবা 'হুলিয়া' পড়ে ভালো লাগলে ও সে বয়েসে এ সব বিপ্লবী কবিতার মর্মার্থ উদ্ধার আমার পক্ষে পুরোপুরি সম্ভব ছিল না! তার উপর ছন্দ-মাত্রার আগা মাথা নেই।

শেষ করে আবার গেলাম। এবার, এক কাঠি সরেস! ধরিয়ে দিলেন 'আল মাহমুদ কাব্যসমগ্র'। সন্দেহ নেই, এ কবিতা গুলো গুণের কবিতার চেয়ে ভালো লেগেছিল। 'সোনালি কাবিন' আর 'নোলক' পড়ে কী যে ভাল লেগেছিল, বোঝানো সম্ভব নয়। পুরো বইটাই গোগ্রাসে গিলে ফেললাম।

এবার, গিয়ে ভালো মত ধরলাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতাসমগ্র দিতে হবে! তখন পর্যন্ত, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমার ধারনা ছিলো এই রকম-
. উনি খুব ভালো কবিতা লিখতেন। সে জন্য তাঁকে কবিগুরু বলে।
. ১৯১৩ সালে 'গীতাঞ্জলী' কাব্যের জন্য উনি নোবেল পুরষ্কার পান। এ জন্য তাঁকে বিশ্বকবি বলে।
. উনি অনেক ভালো ভালো গান লিখেছেন যাকে রবীন্দ্র সংগীত বলে। (আরেক বড় ভাইয়ের কল্যানে তখন আমি সাগর সেনের ভক্ত)। আমাদের জাতীয় সংগীত ও একটা রবীন্দ্র সংগীত!
. গান ও কবিতার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু কঠিন কঠিন গল্প-উপন্যাস লিখেছেন যে ছোটদের বোঝার সাধ্য নেই।

(আমি আজো মনে করি, বাঙলাদেশের বেশীরভাগ মানুষের এর চেয়ে বেশী ধারনা নেই)

এই পরিমান রবীন্দ্র জ্ঞান সম্বল করে গিয়ে যখন দেখলাম, শ্যামল ভাই হাসি মুখে বিশ্বভারতীর ১৯ খন্ডের সবগুলো বের করেছেন, তখন আমার অবস্থা বুঝে দেখুন! বাংলাতে এক কথায়, চক্ষু চড়কগাছ বোধহয় একেই বলে! ও খোদা! এত কিছু লিখেছেন নাকি এ ভদ্রলোক?

যাই হোক, বুকে বল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। কী মনে করে তৃতীয় খন্ডটা তুলে নিয়ে গেলাম। 'অনন্ত প্রেম' এর 'তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার' পড়ে একেবারে দেওয়ানা হয়ে গেলাম। সেখান থেকেই আমার রবীন্দ্র প্রেম শুরু।

কয়েক দিনের ভেতর হাতে এলো সুনীলের 'প্রথম আলো'। যে এই বই পড়ে নি সে জানেই না যে, সে কী হারিয়েছে। কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের উত্থানকে একেবারে উপন্যাসের পাতায় বেঁধে ফেলে সুনীল একটা কাজের কাজ করেছেন। সে সময়ই সুনীলের একটা লেখায় পড়েছিলাম, 'রবীন্দ্রনাথের লেখা যে তন্ন তন্ন করে পড়ে নি, তার বাংলা ভাষায় কলম ধরার অধিকার নেই'। সামান্য আবেগমথিত অতিকথন মনে হলে ও রবীন্দ্রনাথের স্থান কোথায় সেটা ঠিকই বুঝে ফেলেছিলাম। পরবর্তীতে মৈত্রয়ী দেবীর 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' পড়ে এই ভদ্রলোকের সাথে পরিচয়টুকু আরো গাঢ় হল।

তখনো 'সঞ্চয়িতা' নামের বাইরে এই সংকলন সম্পর্কে বেশী কিছু জানি না! একদিন কিভাবে যেন হাতে এসে গেলো। এরপর থেকেই এটি আমার নিত্য সহচর। 'গীতাঞ্জলী'র জন্য কবি নোবেল পেয়েছেন সত্যি, কিন্তু 'সঞ্চিয়তা'কে আমার এর চেয়ে ভালো বলে মনে হয় (যদিও গীতাঞ্জলীর ১৬ টি কবিতাও এখানে ঠাঁই পেয়েছে)! এক কথায়, একটা মাষ্টারপিস্‌। কী নেই এতে? প্রেম-বিরহ, আবেগ-উচ্ছ্বাস, থেকে শুরু করে মৃত্যু ভাবনা পর্যন্ত সবই এসেছে এখানে। শেষ বয়সের কয়েকটা কবিতা ছাড়া এ সংকলনের সবগুলো কবিতাই কবি নিজে বেছে নিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, "আমার লেখা যে সকল কাব্যগ্রন্থ দীর্ঘকাল পাঠকদের পরিচিত, এই গ্রন্থে তাদেরই থেকে বিশেষ করে সংগ্রহ করা হয়েছে"।

এবার, বলি, এটি এতো প্রিয় কেন। আমার মনের যে কোন অবস্থায় একে আমি সহচর হিসেবে পেয়েছি। প্রথম প্রেমের বেলায় সে বলেছিল-
'তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার' (অনন্ত প্রেম)
কিংবা
'আর কতদুরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী'। (নিরুদ্দেশ যাত্রা)
আবার বিরহ বেলায় সে গেয়ে ওঠে-
'শুনেছি আমারে ভালই লাগে না নাইবা লাগিলো তোর'। (রাহুর প্রেম)
কঠিন জীবনের কথা বলে,
,আমি যে দেখেছি প্রতিকার হীন, শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে' (প্রশ্ন)
পরবর্তী প্রজন্মের কথা,
'আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/ কৌতুহলভরে,' (১৪০০ সাল)
মৃত্যু চিন্তা,
'একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ,/ পড়িবে নয়ন পরে অন্তিম নিমেষ।' (দূর্লভজন্ম)
মিথ্যের উপাসনা,
'রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম/ ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রনাম/ পথ ভাবে,'আমি দেব, রথ ভাবে,'আমি'/ মূর্তি ভাবে, 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী'।' (ভক্তিভাজন)
তারুণ্যের উচ্ছ্বাস,
'আজি এ প্রভাতে রবির কর,/ কেমনে পশিল প্রানের 'পর?' (নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ)
হাহাকার,
'তখন কাঁদি চোখের জলে দু’টি নয়ন ভরে/ তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূণ্য করে?' (কৃপণ)
স্রষ্টার রূপ,
'সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর' (সীমায় প্রকাশ)

এমনি করে জীবনের পদে পদে একে পেয়েছি বলেই এটি এতটা আপন হয়ে আছে। হাসি-কান্নায়, বিরহ-বেদনায়, প্রেম-ভালবাসায়, একাকী প্রহরে, কিংবা একেবারে কোন কিছু ছাড়াই এই বইকে পাশে পেয়েছিলাম। এই অর্থে আমি একজন রবীন্দ্র ভক্ত।

সবশেষে, একটি স্পর্শকাতর ইস্যু।
. জমিদার রবীন্দ্রনাথ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রেনীস্বার্থকে জয় করে সাধারণ প্রজাদের কাছাকাছি নেমে আসতে পারেন নি।
. সেই দৃষ্টিকোণ হতেই সম্ভবতঃ তিনি বঙ্গভঙ্গ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন।
. ইংরেজ শাসনের প্রতি তাঁর নিরব সমর্থন ছিলো, যদিও পরে তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারেন।
. সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাঙ্গালী তাঁর লেখাতে এক প্রকার উপেক্ষিতই ছিলো। ভারতবর্ষের ইতিহাস আলোচনায় পুরো মোঘল-পাঠান আমলকে (আওরঙ্গজেব-শিবাজী দ্বৈরথ বাদে) তিনি যেন সচেতনভাবেই এড়িয়ে গিয়েছেন।


(কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় এ সবের রেফারেন্স দিচ্ছিনা, প্রয়োজন হলে দিয়ে দেব)

এমতাবস্থায়, আমার কথা হলো, ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ও মানুষ বৈ অন্য কিছু ছিলেন না। তাঁকে গুরুদেব আখ্যা দিয়ে মহামানবের পর্যায়ে তোলার কী দরকার? তাঁর জমিদারি কিংবা রাজনৈতিক সত্ত্বা, কখনো তাঁর কবি সত্ত্বাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না, এরা তাঁর কবি মানসের উপর তেমন একটা প্রভাব ফেলেছে এমন ও নয়। রবীন্দ্রনাথ বাঙলা সাহিত্যের আকাশে সেই সূর্য যার কিরণকে অস্বীকার করে কেবলমাত্র অল্প কিছু দূর্লভ প্রতিভাবানই এখানে স্থান করে নিতে পেরেছেন। সুতরাং, তাঁর কবি সত্ত্বার সাথে অন্য কিছু মিশিয়ে না ফেলাই উত্তম। এতে আমরা অন্ততঃ রবীন্দ্রের সৃষ্টি হতে বঞ্চিত হব না, হতে চাই ও না!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০০৯ রাত ১১:২৪
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×