somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওমর (রা)- আল-কু'রআন যাঁকে বদলে দিয়েছিল!

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০০৯ বিকাল ৩:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তাঁকে পাশ কাটিয়ে কখনোই ইসলামের ইতিহাসকে জানা সম্ভব নয়। অথচ, কী গভীর মূর্খতায় নিমজ্জিত ছিলেন তিনি! তবে, হৃদয়ের উপর জমাট বাঁধা আঁধারের পর্দাকে ফর্দাফাই করে কেমন করে প্রবেশ করে ছিল তৌহিদের প্রথম আলো? কেমন করে সূচিভেদ্য অন্ধকার ঘর মূহুর্তেই হয়ে উঠেছিল একটি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা?! সেজন্য, জানতে হবে খৃষ্টীয় সপ্তম শতকের আরবের বুকে বেড়ে ওঠা এক বেদুঈনকে, নাম তার ওমর।

অসমসাহসী এক যুবক, তৎকালীন আরবের সেই মুষ্টিমেয় ক’জনের একজন যারা সামান্য লিখতে ও পড়তে জানে। গুছিয়ে কথা বলতে পারার মত গুণ আছে; তাই গোত্রগত ঝামেলার সময় মাঝে মাঝে কূটনৈতিকের দায়িত্ব ও পালন করতে হয়। এর বাইরে বাকিটুকু অন্যদের মতই। শিকার, মদ্যপান, হৈ হুল্লোড়ে ভেসে যাওয়া উদ্দাম যৌবন। পাথরের খোদার সামনে মস্তক অবনতকরণ সহ যত ধরণের মূর্খতা সম্ভব- সবই তার জীবনের অনুসঙ্গ!

তবু, সত্যসন্ধানী একটা মন তার প্রশস্থ বুকের কোন এক কোণায় বোধহয় ধ্বিকি ধ্বিকি জ্বলছিল। আর সেটাই হয়তো তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আলোর দিকে ।

মুহাম্মাদের (স) নেতৃত্বে তখন সবে মাত্র একটা নতুন জীবনাদর্শ আরবের বুকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বিভিন্ন অল্প ক'জন তাঁর দেখানো পথে চলতে শুরু করেছে। হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত আচারের বিপরীত স্রোতে চলতে শুরু করা এই আলোর মিছিল যেন চিরাচরিত আরবীয় অহমের বারুদে এক সশব্দ অগ্নিসংযোগ! যথারীতি অত্যাচারের স্টীম রোলার চালু হয়ে গেলো। এ কাজে সে যুবক ও পিছিয়ে থাকলো না!

এমনি একদিন। কোথাও কোন কিছু করবার সুযোগ না পেয়ে যুবক এলো কা'বার পাদদেশে। উদ্দেশ্য তাওয়াফ (প্রদক্ষিন)। নিয়তিই যেন তাকে অদৃশ্য সুতোর অমোঘ টানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। মুহাম্মদ (স) তখন সেখানে, একাকী নিমগ্ন, প্রার্থনায়- কু'রআন তেলাওয়াতে। হৃদয়গ্রাহী ছন্দবদ্ধ বাণী।

তিনি পড়ছিলেন-
"............তোমরা যা দেখ, আমি তার শপথ করছি। এবং যা দেখনা তার ও। নিশ্চয়ই এ (কু'রআন) একজন সম্মানিত রাসূলের আনীত।"
যুবক ভাবলেন-"এ কোন কবির লেখা না হয়ে যায় না?"
তখনি কানে ভেসে এলো- "এবং এটা কোন কবির কথা নয়, তোমরা খুব কমই বিশ্বাস কর।"
"একী!", যুবক ভাবলেন, " নিঃসন্দেহে ইনি কোন যাদুকর!"
সাথে ভেসে এলো পরবর্তী আয়াত- "এবং এটা কোন যাদুকরের কথা ও নয়, তোমরা খুব কমই অনুধাবন কর।"
যুবক তখন বিভ্রান্ত। এ কেমন করে সম্ভব!
পরবর্তী আয়াতসমূহ তাঁকে যেন পথের দিশা দিল।
"এটি পালনকর্তার নিকট হতে অবতীর্ণ। তিনি যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করতেন- তবে আমি তাঁর ডান হাত ধরে ফেলতাম। এবং তাঁর গ্রীবাদেশ কেটে দিতাম। তোমাদের কেউ তাঁকে রক্ষা করতে পারতে না।।......" (সুরাহ হাক্বক্বাহঃ ৩৮-৪৭)

সত্যের বীজ বুঝি সেদিনই যুবকের মাঝে উপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অংকুরোদ্‌গমের জন্য তার কেবল মাত্র অনুকূল পরিবেশের প্রয়োজন ছিলো। খুব বেশীদিন অপেক্ষা করতে হলো না! পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সে পরিবেশ ও তৈরী করে দেয়।

চরম উত্তেজিত সেদিন কুরাইশ নেতৃবর্গ। মুহাম্মাদের (স) আনীত বিধান তাদের শত বছরের সংস্কারের নিগড় ছিঁড়ে ফেলছে। অত্যাচারীর প্রাসাদের ভীত টলটলায়মান। অতএব, মুহাম্মাদের (স) রক্ত চাই! এজন্য রয়েছে পুরস্কারের মায়াময় হাতছানি। সেই যুবক বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেল।

কিছুক্ষন পর। উলঙ্গ তরবারী হাতে দ্রূতবেগে ধাবমান যুবক। রক্তের নেশায় বিভোর। গোত্রীয় আভিজাত্যের নীল শিখা ধ্বকধ্বকিয়ে জ্বলছে দু'চোখের তারায়। পথে বাধা হলেন মুহাম্মাদের (স) এক নব্য অনুসারী। যুবকের গতিপথ ঘুরিয়ে দিলেন যুবকের নিজের বাড়ির দিকে। জানিয়ে দিলেন, যুবকের বোন-ভগ্নিপতির মুহাম্মাদের (স) শিষ্যত্ব গ্রহনের খবর। পরামর্শ দিলেন, আগে নিজের ঘর সামলাতে।

বোনের বাড়িতে এসে বোন-ভগ্নিপতি দু’জনকেই কু'রআন পাঠরত অবস্থাতেই পাওয়া গেল। আর যায় কোথায়! নির্মম প্রহারের শিকারে পরিণত হল ঐ দু'টি নিষ্পাপ প্রান। রক্তে রঞ্জিত হল দু'জনের দেহ। কিন্তু, অবাক করা বিষয়, এতো অত্যাচারের মাঝেও দু'জনেই অবিচল! বোনের রক্তমাখা দেহ আর অবিচল মনোভাব যুবককে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করলো। যেন নতুন এক ইতিহাসের প্রসব বেদনা শুরু হলো।

যুবক সেই বাণী দেখতে চাইলেন, যা তাঁরা পাঠ করছিলেন। তাঁরা যুবকের হাতে তুলে দিলেন আর যুবক মুগ্ধচিত্তে পাঠ করে চললেন, " ....এটি তাঁর কাছ হতে অবতীর্ণ যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন। তিনি পরম দয়াময়, আপন আসনে সমাসীন হয়েছেন। নভোমন্ডলে, ভূমন্ডলে, এ দু’য়ের মধ্যস্থলে এবং ভূগর্ভে যা কিছু আছে, সবই তাঁর। তুমি যদি প্রকাশ্যে কথা বল, তিনি অপ্রকাশ্য এবং তার চেয়ে অধিক গুপ্তকথাও জানেন। আল্লাহ্‌; তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তিনি সুন্দরতম নামসমূহের অধিকারী।।....." (সুরাহ ত্বোয়াহাঃ ৪-৮)

অন্তর্জগতে কী এমন বিপ্লব ঘটে গেল যে, যুবকের অন্ধ অহমিকার দেয়াল মূহুর্তে ভেঙ্গে চুরমার গেল! বিদ্যুৎবেগে যুবক ছুটে গেলেন মুহাম্মাদের (স) দরবারে। কিয়ৎক্ষন পুর্বের রক্তপিয়াসী তরবারী তাঁর পদপ্রান্তে রেখে সামিল হয়ে গেলেন আলোর মিছিলে।

তিনি তো আর কেউ নন হযরত ওমর (রা)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা।
কত বিরাট আকারের মূর্খতা একজন মানুষ প্রলুব্ধ করে একজন পয়গম্বরের রক্তপিয়াসী হতে! সেখান হতে ফিরে এসে ওমর (রা) হয়ে গেলেন মূর্তিমান এক জ্ঞানকোষ। হয়ে গেলেন "সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী (ফারুক)"। মুহাম্মাদ (স) বলে গেলেন, "আমার পরে যদি কেউ নবী হোত, তবে সে হোত ওমরঃ কিন্তু আমার পরে কোন নবী নেই।"

সময় তাকে বসিয়ে দিয়েছিল অর্ধ পৃথিবীর দোর্দন্ড প্রতাপ শাসকের আসনে। মাটির বিছানায় তিনি পেতেছিলেন আপন সিংহাসন। শত শত মাইল দূরে ফোরাতের তীরে অভুক্ত সারমেয় তাঁকে দায়িত্বে অবহেলার অপরাধবোধে ভুগিয়ে তুলতো। রাতের পর রাত তাঁর নির্ঘুম পার হয়ে যেত নগরবাসীর দুঃখমোচনে। এমনি করে তিনি নিজেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এমন এক অবস্থানে, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। সাম্যবাদের উত্তম নমুনা পেশ করলেন স্বীয় ভৃত্যকে উটের পিঠে বসিয়ে; আর নিজের জন্য রাখলেন উটের দড়িটুকু টেনে নেবার দায়িত্ব! উপমা দিতে গেলে নজরুলের (রবীন্দ্র-নজরুল এ দু'জন না থাকলে আমাদের যে কী হোত!) কাছেই ফিরে যেতে হয়-
"ভৃত্য চড়িল উটের পিঠেতে উমর ধরিল রশি,
মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী।" (উমর ফারুক- কাজী নজরুল ইসলাম)

এই যে এতো পরিবর্তন, নির্দ্বিধায় বলা যায়, কু'রআনের অনুপম বাচনভঙ্গীই ওমরকে (রা) আলোর পথে নিয়ে এসেছিলো। তবে, কথা হলো, কু'রআনের সে অপার্থিব বাণীসমূহ শোনার পরে ও সকলে ইসলামের অনুসারী হতে পারে নি। কিন্তু, সে অন্য কাহিনী, অন্য দিন হবে।


সুত্রঃ
১. সীরাত ইবনে হিশাম।
২. আল-কু'রআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য্য- সাইয়েদ কুতুব শহীদ।
৩. মরু দুলাল- গোলাম মোস্তফা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৪
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ, চীন ও ভারত: বিনিয়োগ, কূটনীতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ ভোর ৫:১০


প্রতিকী ছবি

বাংলাদেশের বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। চীন সফরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরছেন, যা দেশের অর্থনীতির জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

অদৃশ্য দোলনায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ৮:৩৮



ভোরের রোদ্র এসে ঘাসের শিশিরে মেঘের দেশে চলে যেতে বলে
শিশির মেঘের দেশে গিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঘাসের মাঝে ফিরে আসে-
বৃষ্টি হাসে শিশিরের কথায়। তাহলে আমরা দু’জন কেন প্রিয়?
এক জুটিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনূসকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪

ড. ইউনূসকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান....

বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চীনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। শনিবার (২৯ মার্চ) এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্রঋণ ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনুস: এক নতুন স্টেটসম্যানের উত্থান

লিখেছেন মুনতাসির রাসেল, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ড. মুহাম্মদ ইউনুস ধীরে ধীরে রাজনীতির এক নতুন স্তরে পদার্পণ করছেন—একজন স্টেটসম্যান হিসেবে। তার রাজনৈতিক যাত্রা হয়তো এখনও পূর্ণতা পায়নি, তবে গতিপথ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তার প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে মেপে নেয়া,... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর কেমন হলো ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪৮


প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এখনো চীন সফরে রয়েছেন। চীন সফর কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এক শ্রেনীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক হাইপ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সাসেক্সফুল সফর আর কোনো দলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×