খুব ছোট বেলায় একবার বাবার কাছে বলেছিলাম, বাবা মাকে প্রতিদিন এভাবে আঘাত করো কেন? বাবা রক্ত চক্ষু মেলে আমায় বলেছিলো তুই ছোট মানুষ বুঝবি না, রুমে যা, দরজা আটকে দিয়ে পড়তে বস অথবা কার্টুন দেখ। আখি ছল ছল বালকটি তখন ছম ছম ভয়ে নিজের ছোট গন্ডিতে প্রত্যাবর্তন করে, তার চোখের সামনে ভেসে আসতো এক রাশ বালি, যেই বালিতে চিক চিক করতো বালিশ। হায় কার্টুন দেখা আজো শেষ হয় নাই, এই তো কিছুক্ষন আগেই ওপাশের ফ্ল্যাটে কার্টুন দেখলাম। দেখলাম বিবশ এক বট গাছের নীরব বিসর্জন। থাক আজ আর কাউকে কাঁদাবো না, আজ যে সবার বিবশ হবার বেলা।
তখন আমি কেবল ক্লাস এইটের গন্ডি পেরুলাম, মাকে বলেছিলাম ওপাশের বাড়িতে ইলিশ রেঁধেছে, খুউব সুঘ্রান তাই না? মা বলেছিলো তোর বাবাকে বলবো ইলিশ আনতে। বাবা ইলিশ এনেছিলো কিন্তু মা আমার আর ঐ ইলিশ রাঁধতে পারে নাই, তার আগেই উনার বুঝি পাখির চিৎকার শুনবার খুব তৃষ্ণা জেগেছিলো। বেচারি বাবা রোজ পশ্চিম আকাশের দিক ঠিক ভর সন্ধ্যায় তাকিয়েই থাকে, লুঙ্গিটা প্রতিদিন এখন আমাকেই কেঁচে দিতে হয়। বিচ্ছিরি লাগে। এই বুড়ো ছেলের কাপড় ধোয়া আসলেই অসহ্য লাগে। তাও ধুতে হয় তার কাপড়, তার শরীর, তার সব সব সব সব সব, শুধু আমাকেই বসে বসে ধুতে হয়, আর আমি ধুয়ে ধুয়ে শুধু আবারো সেখানে দেখতে পাই লাল রঙের আর্তনাদ। মাফ করে দাও আমাকে, পারবো না আর ধুতে।
অনেক দিন পর একটু সময় পেলাম রঙ পেন্সিলের বক্স হাতে নেয়ার, প্রথমেই ক্যানভাসের এক কোনে লাল রঙ ছুড়ে দিলাম বড় অযত্নে, জানি ওটা ঠিক জায়গায়, সঠিক ডিরেকশনে বসে থাকবে। নট নড়ন চড়ন। তারপরেই ছুড়ে দিলাম তাঁরার মেলা, ওগুলো জ্বল জ্বল করছিলো কখনো নীল কখনো বেগুনি হয়ে, ভালো করে চোখ কচলে তাকিয়ে বুঝলাম সত্যি সব সত্যি। পায়েলের মৃদু শব্দে পিছনে ফিরেই দেখি ছোটটা চা করে নিয়ে এসেছে। মনে মনে বলি বাচিয়েছিস রে, তোর ঐ সাদা শাড়িই আজ আমায় বাচিয়ে দিলো, এক কাজ কর তোর ঐ সাদা শাড়ি ঝলসে যাওয়া যে অংশটা দিয়ে প্রতিদিন চা করিস সেই চা বানাবার রেসিপিটা আমায় দিয়ে যা। সাদা শাড়িতে ফুটে উঠে আমার প্রিয় চা। প্রথমে গরম পানি খুব, কিছু চা পাতা ছাকনীর উপর রেখে তার উপর দিয়ে পানি গুলো একটা বড় কাপে ঢালতে হবে, তারপর অল্প চিনি, এক টুকরো লেবু দুই টুকরো আদা দিয়ে নেড়ে নিলেই হয়ে গেলো। আমার প্রিয় চা।
ক্রিং ক্রিং শব্দে বেল বাজিয়ে দিলাম, অপেক্ষা করছি একটা বহু আকাঙ্খিত ব্যাচেলর ফ্ল্যাটের, মনে হল এক যুগ পর দরজার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ শুনতে পেলাম, শুভ্র হ্যা কাশফুলের মতো কিছু একটা দরজার এপ্রান্তে মুখ বাড়িয়ে জানতে চাইলো আমি পুন্য গঙ্গার হাটে শেকল বেচি কিনা। সেই শুরু তারপর থেকে এক গাদা শেকল কিনে তার ব্যবসা শুরু করে দিলাম। কিন্তু শেকলের দৈর্ঘ্য যে প্রতিদিন বাড়াতে বাড়াতে আমার পকেটের করুন দশা করে ছেড়েছে, প্লীজ এবার এই শেকল নিয়ে যান আপনি, আমি গোঁড়া থেকে কেটে দিলাম। গঙ্গার জলে তার পর থেকে শুনেছি শেকল পোড়া ছাই। খেও না বাবা, ও মাছ খেও না, ও যে গঙ্গার। তুমি যে বাড়ি রেখে গেছো সে বাড়ি যে আজ হিমালয়সম উচ্চতায়, আর আমি এই পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী কলুর বলদ।
পানপাত্রটা আরেকটু এগিয়ে দে তো শমীর, আচ্ছা আজকের ডিব্বাটা কিন্তু তেমন মজা দিচ্ছে না, জমছে না শালা বাইঞ্চোদ। ধুর মেজাজ আজ অগ্নি। বাসায় ফিরেই শ্যাওলা ধরা একটা বালুর বস্তা পেয়ে গেলাম, এটাই কি তবে আমার রোজকার বিরক্তির কারন? হ্যা তাই তো। আশীর্বাদ করো মা, আশীর্বাদ করো বাবা। আজ এই বালুর বস্তার দফারফা করেই ছাড়বো। কোথায় যেন শুনতে পাই মায়ের আর্তনাদ, বাবার আক্ষেপ। প্লীজ তোমরা আমায় মাফ করে দিও, প্রীতি ম্যাচের তোমরা কি বুঝবে হ্যা? দিস ইজ ফাকিং লাইফ। ইয়া এটা একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত গিফট। হাসো বন্ধুরা। আজকে হাসির সময় চেক করে দেখিও তোমার ঘরে একটা কাচা দেয়া শক্ত পোক্ত লাঠি আছে কিনা, লাঠি নেই তো কি হয়েছে দুদিন বুকডন দিয়ে পেশি বানিয়ে নিও। আসো বন্ধুরা আমরা আজ হাসবো।
আমাকে চিনতে পেরেছো? আমিই সেই যে কিনা বারবার ফিরে আসি প্রজাপতির ডানায় রঙ হয়ে, যে কিনা রোজ সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশ রাঙাতে আরো একটু রঙ ঢালি। চিনতে পারো নাই নাকি এখনো? আমিই সেইই যে প্রতি রাতে নখের ডগায় কিংবা তোমার কারো কারো শক্ত মুঠিতে ভর করি, আমিই তোমাদের প্রতিরাতে ফুটবল ম্যাচের আয়োজক।
আজ আর কোনও বৃষ্টি হয় না নগরীতে, মেঘেরা সব পরবাসে।