ভদ্রলোকের নাম বলা যাবে না। কারণ তিনি এখনো জীবিত এবং বার্কশায়ার হ্যাথাওয়েতেই কাজ করছেন। ওয়ারেন বাফেটের পুরনো ও বিশ্বস্ত কর্মীদের একজন তিনি। একবার বাফেট খেয়াল করলেন ভদ্রলোক কাজে আনন্দ পাচ্ছেন না। ক্লান্তি ও বিরক্তি নিয়ে অনেকটা রোবটের মতো করে চলেছেন কাজকর্ম। সহকর্মীরা বাফেটের কাছে অভিযোগ করলেন, তার মনোযোগ কমে গেছে; সঙ্গে কর্মনৈপুণ্য। বাফেট ভাবছিলেন কী করা যায়? বিদায় করে দেবেন? তাহলে তো নতুন লোক খুঁজতে হয়। চাকরি খাওয়ার হুমকি দেব? বলব কী— কাজে গাফিলতি চলতেই থাকলে ছয় মাসের মধ্যে অন্য কোথাও কাজ খুঁজতে হবে তোমাকে? কিন্তু এত সিনিয়র লোক, বিষয়টিকে যদি অপমান হিসেবে নেন? অনেক ভেবে বাফেট ঠিক করলেন, আগে বরং কথা বলি। ভদ্রলোককে লাঞ্চের আমন্ত্রণ জানালেন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আলাপ চলতে লাগল। শরীর-স্বাস্থ্য কেমন? পরিবার-পরিজন কেমন আছে? কেমন চলছে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া? ভবিষ্যতের জন্য অর্থকড়ি জমাচ্ছেন কি না প্রভৃতি। এসব বলে বাফেট আসলে বুঝতে চেয়েছিলেন, ভদ্রলোকের কোনো রকম শারীরিক-মানসিক অশান্তি আছে কি না। যেই বুঝলেন তেমন কিছু নয়। তিনি কৌশলে বলতে লাগলেন তার পরও কোনো সমস্যা থাকলে জানাও। হয়তো সমাধান করতে পারব না, কিন্তু তুমি তো হালকা হবে। এত দিন ধরে কাজ করছ বার্কশায়ারে। আমি তোমাকে এখানকার শ্রেষ্ঠ কর্মীর একজন ভাবি। তোমাকে দেখিয়ে অনুপ্রাণিত করি অন্যদের। সবাই বলে, আমিও স্বীকার করি তোমার মতো কর্মী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। অথচ কয়েক মাস ধরেই দেখছি, কাজে মন নেই তোমার। তাই ভাবলাম, এ বিমর্ষতা কাটাতে সাহায্য করা যায় কি না। যে কারণেই ভদ্রলোকের কাজে মনোযোগ কমে গিয়ে থাক, বাফেট কথা বলার পর দিনই তাকে আগের মতো উদ্যমী দেখা গেল। কেন? কারণ মানুষের স্বভাবই হলো, সুনাম করা হলে সে উপাদান তার মধ্যে না থাকলেও ওই ব্যক্তি সেটি অর্জন করে নিতে চায়। এ জন্যই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে বা লজ্জা দিয়ে কাজ আদায় করতে চাইলে হতাশ হতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। দোষত্রুটি দেখিয়ে অভিযুক্ত করলে মানুষ বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চায়; নিষ্ক্রিয়তা দেখায়।
বাফেট কিন্তু সুযোগ পেলেই প্রশংসা করেন বার্কশায়ারের দক্ষ ম্যানেজারদের। প্রতি বছর বার্কশায়ারের শেয়ারহোল্ডারদের কাছে একটি চিঠি যায়। তাতে কোম্পানির আয় বিবরণীর সঙ্গে যুক্ত থাকে— কোন ক্ষেত্রে তার কোন ম্যানেজার, কোন সিইও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন গত বছর, তার খতিয়ান। বাফেট তাদের প্রশংসা করেন বার্ষিক সাধারণ সভায় অথবা সুযোগ পেলে সংবাদ সম্মেলনে; তাদের প্রশস্তি করেন একান্তে ডেকেও। এসব করে বার্কশায়ারের সিইও-ম্যানেজারদের আসলে বুঝিয়ে দিতে চান— যে সুনাম তাদের গড়ে উঠেছে, সেটি যেন কোনোভাবে বিনষ্ট না হয়।
একবার জনপ্রিয় ইউ-টু ব্যান্ডের পল ডেভিড হিউসন (বোনো) এলেন বাফেটের কাছে। উদ্দেশ্য আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত মানুষকে বাঁচাতে আমেরিকাজুড়ে চ্যারিটি কনসার্ট আয়োজন। তিনি বাফেটের কাছে পরামর্শ চান, কী করলে আমেরিকানরা এমন কাজে তাদের হাত ‘স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি’ বাড়িয়ে দেবে? কীভাবে সহজে অনুপ্রাণিত করা যায় মার্কিন জনসাধারণকে? বোনোর আসলে কী করা উচিত? আমেরিকার বিবেকের কাছে প্রশ্ন তোলা— আফ্রিকায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে আর তোমরা এখানে নিশ্চিন্তে রয়েছ? নাকি কনসার্টটির স্লোগান হবে ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে আফ্রিকা রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ো? বাফেট শুরুতেই বললেন, আমেরিকার বিবেক নিয়ে প্রশ্ন তুলো না। তার মহত্ত্বের কাছে বরং আবেদন জানাও। তাহলেই তোমার উদ্দেশ্য পূরণ হবে। আমেরিকার বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই পাবে তুমি। এমনটি করলে আমার মনে হয়, যেকোনো মানুষ বা জনগোষ্ঠীই এর ভিন্ন আচরণ করবে না। তুমি কেন এটি বল না যে, উন্নত দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক আমেরিকানেরই উচিত নিজ থেকে আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। বাফেটের এ কথাগুলো পয়েন্ট আকারে টুকে নিয়েছিলেন বোনো। পরে এ থেকে একটি ভাষণও দাঁড় করান, যেটি আমেরিকাজুড়ে চলা প্রতিটি চ্যারিটি কনসার্টেই দিয়েছেন তিনি। ‘আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান জাতির বাসস্থান। আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিতেছিল সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। চাঁদের বুকে প্রথম পদচিহ্ন একজন আমেরিকানেরই। ...যখন দেখলাম আফ্রিকার হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরছে, তৃষ্ণায় ছটফট করছে শিশুরা, ভেবে পাচ্ছিলাম না এ নিয়ে কার কাছে যাব, কার সাহায্য চাইব? তখনই মনে পড়ল বিশ্বে একটি জাতি আছে, যারা অসম্ভবকে সম্ভব করতে জানে। তারা পারবে এ প্রতিকূলতা জয় করতে, আফ্রিকার মানুষকে সাহস জোগাতে। তাই আমি তোমাদের কাছে এসেছি।’ এমন একটি ভাষণ বোনোকে এনে দিয়েছিল অভাবনীয় সাফল্য। বাফেটকে নোটও পাঠিয়েছিলেন তিনি, পরামর্শে কাজ হয়েছে; ধন্যবাদ।
Click This Link