“তোমার কি ভয় লাগছে?” হাঁসতে হাঁসতে জিজ্ঞাসা করলো জলিল আঙ্কেল।
“একটু একটু” কাপা গলায় উত্তর দেয় অনি।
“ভয় পেও না। একটুও ব্যথা লাগবে না।“
জলিল আঙ্কেল কে বিশ্বাস না করে এখন উপায় নেই অনির। যদিও সে জানে ব্যথা লাগবেই। ছোট বেলা থেকে সে এই একই কথা শুনে আসছে।
চারিদিকে আবছা আলো। শুধু চোখের সামনের ঝলসানো আলোটাই সব থেকে বেশি ভোগাচ্ছে।
ছোট বেলার শান্তার ছাদ থেকে পরে যাওয়ার দৃশ্যটা কেন যেন বারবার মনে পরছে।
পরে যাওয়ার সময় ও শুধু একবার ভাইয়া বলে ডেকেছিল। তারপরের কথা গুলো আর মনে করতে চায় না অনি। মা ভেবেছিলো অনিই শান্তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল।
হঠাৎ করেই দাঁতের ব্যথায় কাঁতরে উঠলো অনি।
“হয়ে গেছে। ভয় পেও না।“ শান্ত ভাবে বলে জলিল আঙ্কেল।
কোনও রকমে উঠে বসে অনি। জলিল আঙ্কেল ওদের ফ্যামিলি ডেন্টিস্ট। ভাল ডাক্তার তারথেকেও বেশি ভাল মানুষ।
আঙ্কেলের কাছ থেকে ওষুধ গুলা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো অনি। একটা রিকশা নিয়ে বাসার দিকে রওনা হল।
বাসাতে ফিরেই মায়ের ঘরে ঢোকে অনি। এই ১০ বছর ধরেই এই ঘরটাই মার পৃথিবী। শান্তা মারা যাবার পর থেকে আর কখনও সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি মা। ওই স্ট্রেস টা সহ্য করতে পারেনি। সেই থেকেই মানসিক ভাবে অসুস্থ।
ঘরটা অস্বাভাবিক রকম ঠাণ্ডা। ডিম লাইটটা টিমটিম করে জ্বলছে। দাঁতের চিনচিন ব্যথাটা আবার একটু একটু অনুভব করছে অনি।
‘মা’ ডাক দেয় অনি।
কোনও উত্তর আসেনা ওপাশ থেকে।
মা নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। মায়ের বিছানার পাশে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় অনি। মায়ের নিঃশ্বাস এর শব্দ শুনতে পায়। স্থির কিন্তু অস্বাভাবিক রকম গভীর। যারা অনেক মানসিক শান্তিতে থাকে তারা হয়তো ঘুমের মধ্যে এতো গভীর নিঃশ্বাস নেয়। কিন্তু কোন স্বাভাবিক মানুষ হয়তো এতোটা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে না।
মায়ের কপালে হাত রাখে অনি। অনেক ঠাণ্ডা যেন হিম বরফ। অবাক হয়না ও একটুও। ঘুমের মধ্যে মায়ের শরীর অস্বাভাবিক রকম ঠাণ্ডা থাকে। এটাই দেখে আসছে এই ১০ বছর ধরে। জরিনার বিশ্বাস ঘুমের সময় মায়ের শরীরে আর তার আত্মা থাকে না। অনেক দুরদুরান্তে ঘুরে বেড়ায়। জীনের আছর হলে নাকি এরকম হয়। তাই ২-৩ বার জিন তাড়ানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছিল কাজ হয়নি।
জরিনা বাসার কাজের মেয়ে। কাজের মেয়ে বললে ভুল হবে পরিবারের একজন।
অনেক ছোট বেলা থেকেই সে এই পরিবারের সদস্য।
ঘর থেকে বেরিয়ে আশে অনি। নিজের ঘরে ফিরে আসে। ওয়ারড্রবের উপর ফ্যামিলি ফটোটার দিকে চোখ চলে যায়। অনেক পুরনো ছবি। শান্তার ২য় জন্মদিনে তোলা। বাবার কোলে উঠে নির্লিপ্ত কিন্তু স্বর্গীয় কোন আনন্দে যেন হাসছে মেয়েটা। জিনিসটা এতদিন কেন দেখিনি ও...?
বাবাও মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর মা অনিকে জড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু ও নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হল। একটুও হাসছে না ও। বরং মনে হচ্ছে অনেক রেগে আছে।
কিন্তু কেন?
মনে নেই ওর।
বাইরে সন্ধ্যা নামছে একটু একটু করে।
নিঃসঙ্গতা আসছে অন্ধকার নিয়ে। বাইরে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় অনি।
হঠাৎ পরিচিত রিংটোনটার শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায় অনি।
কলটা করেছে প্রাপ্তি। বায়োলজিতে পরে থার্ড ইয়ার।
কিন্তু ফোনটা তুলতে তুলতেই মায়ের চিৎকার শুনতে পায় অনি। দৌড়ে মায়ের ঘরে চলে আসে।
জরিনা রুমের দরজায় দাড়িয়ে কাঁপছে। ভয় পেয়েছে মনে হয় অনেক।
-কি হয়েছে জরিনা ?
-খালাম্মা...
কথা আটকে গেল জরিনার মুখে।
ভিতরে ঢুকে অনি দেখে মায়ের হাতে একটা লোহার রড। আর চোখ থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে... অস্বাভাবিক রকম লাল।
অনিকে দেখে সেই আগুন যেন ঠিকরে বেরিয়ে এলো।
নিজেকে বাঁচানোর সময় পেলনা অনি।
তার আগেই প্রথম আঘাত টা এলো মাথা বরাবর।