আমার নাম শুনেছি মৃন্ময় আহমেদ। মৃন্ময় মানে হল মাটি থেকে তৈরি । নামটা আমার ভালই লাগে। নিজেকে একই সাথে ক্ষুদ্র, আবার বিশাল কিছু মনে হয় । আমার নিজের নামটা "শুনেছি" বললাম ,এইজন্য অবাক হচ্ছেন তো ? আচ্ছা,তাহলে ব্যাপারটা খোলসা করেই বলি । দুই বছর বয়সে আমার বাবা মা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। এক ই গাড়িতে থেকেও তাদের সাথে আমিও কেন মরিনি, এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানিনা। কোন দয়াবান ব্যক্তি আমাকে তারপর কবে যেন একটা এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছিলেন আর জানিয়েছিলেন একসিডেন্টের কথা। ছোটবেলায় আমি দেখতে শুনতে নিশ্চয় খুব সুন্দর ছিলাম। এই কারণে হয়ত বা এক নিঃসন্তান দম্পতি যখন দত্তক নিতে এতিমখানায় আসলেন,আমাকেই তাদের পছন্দ হল। মানুষ যতই ভাব মারুক না কেন, এক জায়গায় চার পাঁচটা বাচ্চা থাকলে ফুটফুটে বাচ্চাটার ই গাল টিপে আদর করে দিতে ইচ্ছে করে !
একজন মা নিজের ঔরস থেকে জন্ম নেয়া সন্তান আর দস্তখত করে নেয়া কাগুজে সন্তানের ফারাক করে কিনা জানিনা। কারণ, নিজের মা কয়বেলা ভাত খাইয়ে দিত আর কয়বেলা পিঠে লাঠি ভাংত তা জানার কোন উপায় নেই। তাই,এই মা ই আমার পৃথিবী। অবশ্য খালারা বাড়িতে এলে মা ভয়ে ভয়ে আমাক আদর করতেন ,খেতে দিতেন। খালারা যে আমকে দেখতে পারত না তা বলাই বাহুল্য । তাদের এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক, নিজের মায়ের পেটের বোনের ছেলেমেয়ের চেয়ে এতিমখানার কোন এক ছেলেকে তাদের বোন বেশি আদর করবে কেন ! তাই মা, খালার ছেলেমেয়ের সাথে আমাকে খেতে দিতেন না। আলাদা করে বাটিতে তুলে রাখা মাছ মাংসের তরকারিটা আমি পরে একা রান্নাঘরে খেয়ে নিতাম নিঃশব্দে । আর ফুপু বাড়িতে এলে আমি সারা দিন বলতে গেলেই বাড়িতে ফিরতাম না। ফুপুর চোখে আমি ছিলাম নর্দমার কীট। আমাকে দেখতে পেলেই মাকে কথা শুনাতেন কেন তার ছেলেমেয়ে হয়না, বাঁজা মেয়েমানুষ কোন দুঃখে যে তার ভাইয়ের বউ হয়ে এসেছিল। লোকজনের অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের ব্যাপারটা আমার আর খারাপ লাগেনা,কিন্তু মাকে কথা শুনতে হত বলে ফুপুর সামনে আমি যতই দুনিয়ার সবচেয়ে নিরীহ ছেলে হিসাবে প্রমাণ করতে চাইতাম নিজেকে আর ততই ফুপু গালি দিতেন বাবাকে, কোন বাঁশঝাড় থেকে এমন ভেজা বেড়াল নিয়ে এসেছেন!
ফুপু কাকাদের সবসময় এমন খোঁটা শুনেই কিনা ,বাবা মা সবসময় ডাক্তার বদ্যি, পানি পড়া , ঝাড় ফুঁক এর উপর থাকতেন একটা সন্তানের জন্য। যখন মা নীরবে কান্নাকাটি করতেন, তখন আমার গলার কাছে একটা দলা পাকিয়ে যেত। শুধুমাত্র ওই সময়টার জন্য মনে হত, আমার তো একটা মা পাওয়ার জন্য কোন আকুতি নেই, তাহলে কেন মায়ের একটা সন্তান পাওয়ার জন্য আকুতি ! আমি কি তাহলে সন্তান হয়ে উঠতে পারিনি ! কারো সন্তান হওয়ার জন্য ও বুঝি নিজের পরিচয় টা জানা থাকে লাগে !
ক্লাস এইটে বৃত্তি পাওয়ার পর বাবা সবাইকে গল্প করে বেড়াতেন,আমার ছেলে বৃত্তি পেয়েছে। “আমার ছেলে” কথাটুকু শুনতেই বেশি ভাল্লাগত। মনে হত , তাদের কাছে ঋনের শেষ নেই,এতটুকু গর্বের বিষয় করে দিতে পেরে যেন আকাশে উড়ছিলাম। আমার জীবনে সবচেয়ে খুশির দিন ছিল এস এস সির রেজাল্টের দিন। একদিকে আমার এ প্লাস পাওয়ার খবর,আরেকদিকে ওইদিন ই জানতে পারলাম, মা নাকি সত্যিকারের মা হতে যাচ্ছে। “ মিছেমিছি” মা হওয়ার দুর্নাম ঘুচাতে সেদিন মায়ের চোখে যে খুশি দেখেছিলাম,আমার এ প্লাসের খবর সেখানে কোন ভাগ বসায়নি । কিন্তু তাতে আমি একটুও দুঃখ পাইনি, সত্যি !
কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসগুলা বেশিরভাগ ই হতনা। একবার বন্ধুদের সাথে নদীর পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সবাই হাশিখুসি, ঠাট্টা তামাশায় মশগুল, এর মাঝে হঠাৎ তীব্র মাথা ব্যথায় চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। এতটাই যন্ত্রণা যে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। চোখে মুখে পানি দিয়ে বন্ধুরা সুস্থ করে তুলার পর বাড়িতে এসে শুনি মা হাসপাতালে ।এক দৌড়ে হাসপাতালে পৌঁছে শুনি আমার বোন হয়েছে। লাল টুকটুকে নরম তুলতুলে একটা পুতুল।চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। প্রচণ্ড ইচ্ছা করছিল কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু খালারা সবাই থাকায় সাহস পাইনি। আমি ওর নাম দিয়েছিলাম উপমা। বাবার আমার দেয়া নামটা পছন্দ হয়েছিল, সবাই উপমা নামেই ডাকত ।
উপমা আসার পর আমার জীবনটা আরেকটু পালটে গেল। মা আমার সব কাজেই বিরক্ত হওয়া শুরু করলেন। মায়েরা অদ্ভুত নাকি মেয়েরা অদ্ভুত জানিনা। নিজের সন্তানের সামান্যতম অসুবিধাও মায়েরা মেনে নিতে পারেন না। আমি যেন কোনভাবেই উপমার আদরে ভাগ না বসাই, এইটা মা সবসময় কঠোরভাবে মেনে চলতেন।সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের মনে যত বেশি ভালবাসার ,কাছে টানার ক্ষমতা দিয়েছেন , বোধ হয় সমান সমান দূরে ঠেলার ক্ষমতাও দিয়েছেন। এই প্রথম আমার মনে হতে থাকল, আমার কেন মা নেই ? আস্তে আস্তে পড়ালেখায় মনোযোগ কমতে থাকল আর সেই সাথে বাড়তে থাকল মাথার ব্যথা টা। মাঝে মাঝেই ভোগাত খুব। ইচ্ছে করেই কাউকে আমার এই ক্ষুদ্র সমস্যার কথা বলিনি। উপমার প্রথম জন্মদিনে ওকে কোলে নিয়ে হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, আমার জন্মদিন যেইটা সব জায়গায় লিখি, ওইটা তো আসলে আমার জন্মদিন না। কেউ ই জানেনা আমার জন্মদিন। কি অদ্ভুত ! সারাটা জীবন হাতড়ে বেড়ালেও আমি আমার জন্মদিন টা কবে জানতে পারবনা । এইসব চিন্তা করতে করতেই আবার সেই তীব্র মাথা ব্যাথাটা শুরু হল। আমার আর কোন বোধ বুদ্ধি নেই উপমা আমার কোলে। তীব্র যন্ত্রণায় কোলে সামলাতে পারিনি উপমাকে। মা ,ফুপু সেদিন খুব গালাগাল দিয়েছিল। কিন্তু বাবা পরদিন আমাকে ডাক্তারের কছে নিয়ে যায়। বেশ কয়েকটা টেস্ট করার পর দিন সাতেক পর ডাক্তার বাবাকে কি জানিয়েছিল জানিনা। তবে বাবার থমথমে মুখ আর অসহায় চোখের দৃষ্টি টা এড়াতে পারেনি আমার চোখ। আমাকে বার কয়েক বলার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু আমি বাবাকে কোনভাবেই বলতে দেইনি। তার চোখে পানি দেখে একবারের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম,মানুষটা আমার বাবা না, পালক বাবা।
আস্তে আস্তে সবাই জানল আমার নাকি কি অসুখ হয়েছে। ফুপুরা বলত, অসুখ না, বদমাইশি । তখন এইস এসসি পরীক্ষা চলে। কোনমতে পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের দিন একটা বড়সড় ধাক্কা খেলাম।আমার রেজাল্ট ৪.৫ । আমার সারাজীবনের স্বপ্ন আর্কিটেক্ট হওয়াটা সেইখানেই শেষ। সাইন্স সাব্জেক্টগুলাতে যেই গ্রেড, তা দিয়ে এপ্লাই করার সুযোগ নেই। এইবার ফুপু আর কাকারা সুযোগ পেলেন। ফুপু বাবাকে সরাসরি বলেছিলেন, “ ওই ছেলের অসুখের পিছনে টাকা খরচ করিস না । ভাল হবে কি হবেনা তার নাই ঠিক , তোর মেয়ের একটা ভবিষ্যৎ আছে” । কাকাদের ও এক ই কথা, “ অনেক হয়েছে। পেলেপুষে বড় করেছিস, এইবার নিজের রাস্তা দেখুক, তুই তো আর এতিমখানা খুলে বসিস নাই” । পনের বছর ধরে লালন পালন করা বাবা মা নির্বাক হয়ে ছিলেন, কোন কথা বলতে পারেনি , কিংবা কে জানে মনের যা কথা,তা মুখে আসেনি।
সেদিন অনেক রাতে বাবা মায়ের দরজার সামনে কিছুক্ষন থমকে দাঁড়াই আমি। পনের বছরের ভালবাসার একেকটা মুহূর্ত এই বাড়ির সীমানায় বন্দী করে পা বাড়াই আত্মপরিচয়ের খোঁজে। লাশ বেওয়ারিশ হয় জানি কিন্তু আমি এই জীবন্ত মানুষটাই কেন যেন বেওয়ারিশ হয়ে গেলাম রাতারাতি। আমার জীবনটা গল্প বা সিনেমা না। যেখানে কাকতালীয় ভাবে অনেক অনেক টাকা জোগাড় হয়ে যাবে, আর আমার অসুখটা ভাল হয়ে যাবে। পৃথিবীতে এখন আমার কাছে সুখদুঃখ বলে আর কিছু নেই, বেঁচে থাকাটাই মুল কথা। যতক্ষণ শ্বাস,ততক্ষণ আশ। ঈশ্বরের দাবার চালের আমি নিতান্তই একটা ঘুটি মাত্র। আমি শুধু আমার সীমানাতেই থেকে যেতে চাই,যতদিন না খেলা মাত করে বাক্সবন্দী হই ! মৃন্ময় নামটা এখন সার্থক মনে হয় আমার, নিতান্তই মূল্যহীন আমি ! তবুও আমিই আমার পৃথিবী ............