বাম হাতের আঙুলে নেইলপলিশ পরতে একটু বেশি সময় লেগে যায় মৌরির। ডানহাতটা কাঁপতে থাকে ওর। নেইলপলিশ পরা, এক অদ্ভুত ভালোলাগার ব্যাপার ওর।শাড়ি, সালোয়ার কামিজ বা অন্য যে কোন ড্রেস পড়ুক,ম্যাচিং নেইল পলিশ পরতে হবেই।
আর ভালোলাগাটা আরো বেশি ঘন হয়েছে ,যখন প্রবাল বলেছে ওর খুব ভালো লাগে এটা। প্রিয় মানুষের ভালোলাগার জিনিসগুলো করতে কার না ভালো লাগে!
এমন কতবার হয়েছে, ও ক্লাস থেকে ফিরেই হুড়পাড় করে রেডি হয়ে নীচে নেমেছে। হাতের দিকে তাকিয়ে মনে পড়েছে ,ভুল হয়ে গেলো। ব্যাগের ভিতর ,নেইল রিম্যুভার রেডি ছিলো। কটন দিয়ে মুছতে মুছতে গেটের বাইরে বেরোতেই দেখে প্রবাল মটরবাইকে হেলান দিয়ে বসে।
ওদের প্রিয় জায়গাতে পৌছাবার পর,প্রবালের কাজ হলো ওর নখ এ নেইলপলিশ পরিয়ে দেয়া।একদম চুপটি করে বসে থাকে ও। কিন্তু অনর্গল কথা বলতে থাকে। সারাদিন কি করলো। কোন স্যার কি পড়ালেন,কোন বন্ধু কি বললো। এই রকম আরো কত কথা! একটু নড়লেই প্রবাল মাথা নাড়ে।
আর মৌরি থেমে যায়। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে। বন্ধুদের সাথে বেট এ জিতে দুই প্লেট ফুচকা খাবার কথাও বলে। প্রবাল ভ্রু কুচকে তাকাতেই হেসে ফেলে ও। এই কথাটা একদম বলা উচিত হয়নি ওর। মৌরির ডাক্তার বারণ করেছে টক খেতে। অথচ তেঁতুল,বরই দেখলে ওর মাথার ঠিক থাকেনা।
ডানহাতের অনামিকায় এসে থেমে যায় প্রবাল। হাতটা আগের চেয়ে ফ্যাকাসে লাগে ওর কাছে। আংটিটা ছুঁয়ে দেয় আলতো করে। এইতো গতমাসেই আংটিটা পড়িয়ে গেছেন ওর মা।
মৌরিকে প্রথম দেখার পর মায়ের সেই উদ্ভাসিত মুখ মনে পড়ে যায়। বাবাহীন জীবনে এই একমাত্র আপন মানুষ পৃথিবীতে। মৌরির আর ওর অদ্ভুত মিল। দুজনেই ওদের বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। মৌরির মা নেই সেই ছোট বেলা থেকে।বাবা আবার বিয়ে করেছেন। দুবাই এ থাকেন। ও ওর এক ফুপুর কাছে বড় হয়েছে। ভার্সিটিতে ঢোকার পর হলেই থাকে। ওদের পরিচয়ের ও প্রায় তিন বছর পার হলো।
প্রবাল সাংবাদিক। ছবি তুলে বেড়ায় । সারাদেশে ওর ছবির অনেক খ্যাতি। মৌরিও শখের ফটোগ্রাফার। পড়ে সাংবাদিকতায়।
প্রবাল ওর এপার্টমেন্টটা সাজাচ্ছে মনের মতন করে। একটা হাই রাইজের ছাদের এপার্ট্মেন্টটা পেয়েছে ও। অর্ধেক ছাদ জুড়ে অজস্র গাছ লাগিয়ে গেছে ওর মা। ক্যাকটাস আর অর্কিড বেশি। মৌরীকে নিয়ে একবারে এই বাড়িতে এসে উঠবে ও।
তিনটা বেড় রুম। একটা বিশাল বসার ঘর। বসার রুমটা চারিদিকে কাঁচের জানালা দিয়ে ঘেরা। ভিতর থেকে বাইরেটা পুরো দেখা যায়।
একটা রুম হবে ওদের ফটোগ্রাফীর ঘর। বেড্রুমটা এখন একদম খালি। শুধু মেঝেতে রাখা একটা ম্যাট্রেস। মৌরী এসে ওর পছন্দমত ফার্নিচার এ সাজাবে। মৌরীর বন্ধু সুইডেন থেকে একটা ক্যাটালগ এনে দিয়েছে। ওখানকার ফার্নিচার খুব ছিমছাম। মৌরীর ইচ্ছা তেমন কিছুই হবে।
মৌরির দিকে তাকিয়ে থাকে প্রবাল। ও ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছে কিনা,ঔষধ খাচ্ছে কিনা। এইসব নানা কথা হয়। ফাইনাল পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেলেই ওরা শপিং শুরু করবে। মৌরির ইচ্ছা সাদা গাউন পড়ার। প্রবালের ও। মা বলেছেন তাই হবে। তবে মৌরি একটা রক্ত লাল কাতানের কথাও বলেছে। ও যেদিন কাতানটা পড়বে। ওর লম্বা চুল এ একটা বেনী করবে শুধু। আর ফুলের অলংকার পড়বে। কিযে অদ্ভুত পাগলী স্বভাবের মেয়েটা। ওকে দেখলেই জয় গোস্বামীর পাগলী তোমার সংগে কবিতার সেই লাইনটা বলতে ইচ্ছে করে প্রবালের, "পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব'।
ওকে যতবার কবিতার এই লাইনটা বলেছে,মৌরি ওর বেনীটা ঝাকিয়ে সামনে এনে আবৃত্তি করেছে পুরো কবিতাটা। লাইনের পর লাইন। অনর্গল।অসম্ভব সুন্দর করে। একটা মানুষ কি করে এত সুন্দর হয়? এত সাবলীল?
প্রবালের মনে হয়েছে, এই জন্যই ,শুধু মৌরি জন্যই ওর নিজের পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। একটা জীবন ও যেমন করে চেয়েছে,সব কিছু তেমন করেই হয়েছে ওর সংগে দেখা হবার পর। মৌরির সাথে দেখা হবার পর ওর জীবনের সবকিছু পজিটিভ হয়ে গেছে। যদিও ওদের দেখা হওয়া এক দূর্ঘটনা থেকে।
এই মৌরি যখন বিশাল এক দূর্ঘটনার পর হাসপাতাল এ মৃত্যুর সাথে লড়ছিল। প্রবাল দিনের পর দিন পাশে থেকেছে। রিকশায় ওড়না পেঁচিয়ে পড়ে যাবার পর অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ও। প্রবাল সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। ও মৌরিকে হাসপাতাল এ নিয়ে যায়।মাথাতেও বিশাল সার্জারী হয়েছিল। এখনো মৌরি সেই ট্রমার থেকে পুরো বের হয়নি। তবে মিরাকেল তো হয়েছে ।ডাক্তাররা বলেন। প্রবাল দিনের পর দিন,মাসের পর মাস অফিসে যাবার আগে এবং ফেরার পর, ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছে। অচেনা একটা মেয়ে,যার কাছে বসলে অদ্ভুত অচীন এক গন্ধ পেতো। অনেক পরে জেনেছে ওর ডাক নাম মৌরি। এর আগে ওকে মুনিরা নাম এ জানতো।
মৌরি জ্ঞান ফিরে পাবার পর থেকে ওকে দেখেছে। রাস্তায় পড়ে যাবার পর যখন অন্ধকার নেমে আসছিল চোখে, একটা মুখ চোখের সামনে নেমে কি যেনো জানতে চাইছিল। সেই মুখটা। সেই চোখ দুটো প্রবালের। এটাই ও বিশ্বাস করে। এই মুখটা ওকে জীবনের দিকে ডেকে এনেছে আবার।
ওর চোখের ভিতর প্রবালের সেই মুখের ছবি গাঁথা হয়ে আছে। সেটা ধরেই ও বাঁচতে শিখেছে নতুন করে। আর প্রবাল ? ও শুধু ভাবে,জীবন কি এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতে পারতো?
মৌরির হাতের নেইল পলিশ এর রঙ এর মতই নানা রং সাজাতে চায় ও জীবন..................ও বলতে থাকে।
"পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন"
আর মৌরিটাও কম যায়না হিউমার এ।
বলে,পাগল ,তোমার সংগে নেইলপলিশ জীবন কাটাবো।
তোমার সংগে কোলবালিশ কাটাবো জীবন!
লেখা : ২১ সেপ্টেম্বর'২০১৮