ছোটবেলায় আমাদের লালমনিরহাট সাহেব পাড়ার বাসার পাশের বাসায় মুক্তা আপার ফুফাতো একটা বোন থাকতো,মীনা আপা ........উনার বিয়ের পর একটা ছোট্ট মেয়ে রেখে উনি মারা যান....ক্যানসারে ভুগে। উনার শোকে উনার স্বামী সেই যে ঘর ছেড়েছিলেন আর কোনদিন ফিরে আসেন নি। বড় হয়ে যখন এই গল্প শুনতাম খুব অবাক লাগতো।
উনাদের মেয়েটা বড় হয় নানা নানীর কাছে জলপাইগুড়িতে । মেয়েটা একবার লালমনিরহাটে এসেছিলো.........ওর দু'চোখে সব হারানোর যে কষ্ট দেখেছিলাম...আজো মনে পড়ে।
এরপরে
দিনে দিনে এই শব্দটা নানান ভাবে কানে এলো..........
কিন্তু কে জানতো একদিন নিজেদের জীবনেও !
২০০১ এর প্রথম থেকেই আমার কাছের মানুষটার শরীর খারাপ হতে শুরু করলো....
খুব সাদামাটা কিছু উপসর্গ......
১)খেতে ভালো লাগছে না।
২)খেতে বসে প্রতিদিন কিছু খাবার ফেলছে।
৩)পেটে একধরনের অস্বস্তিকর ব্যথা।
৪)রাতে ঘুমানো সময় শরীরের ভিতর আনকমফোর্ট
৫)এবং দ্রুত ওজন কমছে।
৬)খাওয়ার পর পরই বাথরুমে যাওয়ার অনুভূতি
(খালি পেটে থাকলে অস্বস্তিটা থাকে না.....খেলেই সমস্যা)
ডাক্তার এর কাছে যাচ্ছে প্রায়ই। ডাক্তার ছোট্ট দু একটা টেস্ট করাচ্ছেন.....
গ্যাসট্রিক এর ওসুধ দিচ্ছেন।
দিন যাচ্ছে ,মাস যাচ্ছে...........ওর চেহারায় কালি পড়ছে।
যে দেখে চমকে যায়।
আমি ওকে না জানিয়ে ডাক্তার এর সাথে দেখা করি। বলি ওর কষ্টের কথা। খেতে না পারার কথা।ডাক্তার বলেন ও ভালো আছে......
ও কে নিয়ে আবার যখন যাই.....।
ওর পেটে ব্যথাটার কথা বলতেই ,পেটে একটা গুতা দিয়ে বলেন......"Do you think you have Cancer?.................."
ওর মুখটা মলিন হয়ে যায়।
ডাক্তার বলেন .......................চিন্তা কোরনা।তুমি অনেক ইয়ং।
ওর মুখের ভয়টা সরে যায়।
রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানান ওর ..Thalassaemia।
Click This Link
বাসায় এসে দেশে ভাই ভাবীকে জানাই(ডাক্তার) .....রিপোর্টাও স্ক্যান করে পাঠাই।
ভাইজান বলে চিন্তা করিস না ........। বাংলাদেশের অনেক মানুষই থ্যালাসেমিয়াতে ভুগে।
ওকে বলি চিন্তা কোর না.........
এর মাঝে দেশে ঘুরে আসি......
ভাবি দেশে গেলে যদি ভালো লাগে। দেশে গিয়ে ওর ওজন একটু বাড়ে।
কিন্তু ওর চোখের ক্লান্তি........রাতের বেলা গায়ে জ্বর চলতেই থাকে।
ফিরে আসার পর আবার ও টেস্ট শুরু...........
প্রথমে endroscopy
Click This Link
এখানে কিছু ধরা পড়েনা........।
এবার ডাক্তার করতে দেন colonoscopy...........
Click This Link
তারিখটা পাওয়া যায় ৩/৪ মাস পর.............
আবার সেই অপেক্ষা...... দিনে দিনে ওর অবসন্ন হওয়া......
প্রচুর ঘুরতাম সেই সব দিনে......কোথাও গেলে যদি ওর ভালো লাগে।
অবশেষে সেপ্টেম্বর আসে.....
মন্ট্রিয়ল ঘুরে আসি। হেলাল দের বাসায় খুব আনন্দ করি সবাই। ফিরে আসার সময় বলে জানো অনেকদিন পর মীরার হাতের রান্না খেতে পারলাম।
(সেই সব দিনে ও শুধু খাবার এর কথা ভাবতো। কি খেলে ওর ভালো লাগবে।)
Colonoscopy এর আ্যাপোয়ন্টমেন্ট।
ও একা যায়।রাইয়ান ঘুমাচ্ছিল..ও বললো
আমি রান্না করতে করতে ভাবি ...ও এসে কি বলবে.......
বলবে জানো আমার না ইয়া বড় একটা অসুখ হয়েছে.......ও খুব নাটক করতে পারে......এরপর আমি কি বলবো.....। এইসব ভাবতে থাকি।
ঘড়ির কাঁটা চলতেই থাকে........সময় যাচ্ছে না নাকি খুব দ্রুত যাচ্ছে.......ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকি.....।
ও গাড়ী নিয়ে যায়নি।
বাসে আসতে একটু দেরী হতে পারে.....
অপেক্ষার সময়টা পেরিয়ে ও আসে......
দরজা খুলে দাঁড়াই.....
আমি জানি ও কি বলবে।আমি ওর দিকে তাকাই.........খুব হাসি হাসি একটা মুখ নিয়ে......ও হাসে না....কোন নাটকের সংলাপ.......খুব নাটকীয় কিছু......।
কিছুই বলে না.....
সোজা ঘর থেকে বেলকনিতে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে.....।
আমি বলি কি কিছু বলছো না যে!
ও তাকায়।
হাসিহীন একটা মুখ।
পৃথিবীর এ যাবতকালের ভয়ংকর সেই শব্দটা শুনি।
ক্যানসার।
কোলন ক্যানসার।
Colon Cancer http://coloncancer.about.com/od/cancerprevention/a/Cancer_Symptoms.htmআমার চিৎকার টা কি আকাশ ছাপিয়ে গেছিলো।
কেমন করে এই শব্দটা ও আমাকে বললো। কেমন করে
আজকের নাটকটা সত্যি হয়ে গেলো!
ও কি করে এতটা পথ আসলো।ডাক্তার যখন ওকে কথাটা বললো......ও কি করে সেটা সহ্য করলো?
রাইয়ান ঘুমিয়ে ছিলো বলে আমাকে ও নিলো না আজ।
আর আজই শুনতে হলো এই খবর....।
একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো.........
ওয়েব সাইট.....।
এত কমন একটা অসুখ।
অথচ কোনদিন জানিনি......শুরু হলো আমাদের রিসার্চ.......সারাদিন ইন্টারনেট এ বসে থাকি।
ও যা খুঁজে পায় আমি পড়ি।আমি যা খুঁজে পাই ও পড়ে..........বান্ডিল বান্ডিল ইনফরমেশন।
আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার কে ফোন করে বললাম...........একদিন তুমি ফান করে যা বলেছিলে তাই সত্যি হলো......ডাক্তার অবাক হয়ে যায়......বলে আমি ভাবিনি এমন ইয়ং একজন ছেলের তেমন কিছু হতে পারে.......
আমি বলি সমস্ত সিম্পটম গুলো ছিলো.....
সে সাধারন শব্দটা বলে...........Sorry।
আমি শুধু ভাবি ওর কস্টের কথা.........২ টা বছরের কি ভীষন যন্ত্রনা।
খুব তাড়াতাড়ি সব ঘটে যায়.......
ইমারজন্সী ব্যাপারটা এখানে খুব ভালোই ঘটে.....।সিনেমার চেয়েও তাড়াতাড়ি......
৫/৬ ঘন্টার অপারেশন।
সার্জেন বলেছিলো ৪ ঘন্টা।
কিন্তু অপারেশন এর সময় প্রচুর ব্লিডিং হওয়ায় রক্ত দিতে হয় ।তাই সময় বেশী লাগে।
ছোট্ট দুইটা ছেলে নিয়ে আমি পারি দেই সেই সব দিন........।আল্লাহর অসীম রহমতে মা বাবা ,সবার দোয়ায় ও ভালো হয়ে ওঠে।
যে ছেলেটা ডাক্তার এর কাছে যেতে সবচেয়ে অপছন্দ করতো।
কাউকে হাসপাতালে দেখতে যেতে চাইলে বলতো তোমাকে নামায় দেই......সে হাসপাতালের সাদা চাদরে বসে শুয়ে কাটালো অনেকগুলো দিন......।
এরপর ছয় মাস Chemotherapy
সে এক অসম্ভব কষ্টের দিন............
এক একটা দিন যেনো এক একটা যুগ.....
আমাদের জীবনে সুখ স্মৃতিগুলো এত উত্তাপ ছড়ায় যে দুঃখদিন গুলো ভুলে থাকি ।
কত মানুষ এসেছিলো...কাছে দুরের কত মানুষের শুভাশীষ।
কত রকম ভাবে মানুষকে চিনতে শেখা.....।
আজকে সকালে হঠাৎ কেমন জানি লাগলো।
জটিলের পোস্ট টা পরে মনে হলো আসলেই সচেতনতার প্রয়োজন আছে।
জটিলের লিন্ক:
Click This Link
কে জানে আমার লেখাটা পড়ে অন্তত কিছু মানুষ যদি সচেতন হয়।
সে কারনে সব ইনফরমেশন গুলো দিলাম........
কোন অসুখই পুষে রাখতে নেই........।
যখন হাইপ্রশার ,ডাইবেটিস এর জন্য সচেতনতা বাড়ছে। মানুষ কথা বলছে। তাহলে ক্যানসার নিয়ে তো নিয়ে সচেতনতার সময় এসেছে।
একদিন টিবি,যক্ষায় মানুষ চলে যেতো.....
তার প্রতিষেধক বের হয়েছে......
প্রার্থনা করি একদিন ক্যানসার এর প্রতিষেধক বের হবে।
এই শব্দটার ভয়াবহতা মানুষ ভুলে যাবে............
কানাডার মত উন্নত দেশে থেকেও আমাদেরকে কি এক কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়েছে...উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্হার কারনে ফলোআপ ট্রিটমেন্ট গুলো ভালো হয়েছে।
পাঁচ বছর ফলোআপ টাইম পার হয়ে গেলো এ মাসেই.......
ও ভালো আছে.....।
আমাদের জীবনের আনন্দ হলো আমরা সুস্হতায় আছি......
সবার কাছে দোয়া চাইছি।
সবার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।
আশ্চর্যজনক ভাবে দেখলাম যে সামহোয়ার ইন এ আমার একবছর পূর্ণ হলো ২ ঘন্টা আগে......সেজন্য একটা লেখা লিখছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে.....সেই লেখাটা পরে কখনো শেয়ার করবো.......।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:০২