মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা করুন। আপনার অন্ধ তীরন্দাজ বাহিনীকে থামান।
আপনার একটি সৎ ও সাহসী পদক্ষেপ; মাদকমুক্ত সুস্থ পরিবেশ গঠনের নির্দেশনা; বাংলার ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মাদকহীন সুস্থ স্বাভাবিক নাগরিক জীবনের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসাবে আপনি গোটা জাতির কাছে চিরটাকাল একজন মঙ্গলকামী রাষ্ট্রনায়ক। একজন ন্যায়পরায়ণ নেতা, যিনি সততা ও স্বচ্ছতাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সবচেয়ে বেশী।
কিন্তু এই অনুধাবনের জায়গাতে এক ধরণের শংকা নাড়িয়ে দিলো একজন বাবার মৃত্যু। একটি অডিও ক্লিপ।
মোবইল ফোনে রেকর্ড হওয়া একটি লোমহর্ষকর এয়ার টাইম, গা গুলিয়ে ওঠা ক্রস ফাইয়ার, যেখানে নিরস্ত্র একজন মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি এবং যার ফোন কলের অপরপ্রান্তে মানুষটির নিজের দুই কিশোরী রাজকন্যা এবং প্রিয় সহধর্মিনী, যারা আর্তনাদ করছেন ও শুনেও চলেছেন গুলির শব্দ, চিৎকার চেচামেচি, প্রিয় বাবার মৃত্যু যন্ত্রণা।
বুলেট বিদ্ধ হতে হতে মারা যাওয়া অসহায় মানুষটি হচ্ছেন কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক। তাঁর মৃত্যুর পূর্ববর্তী এক ঘন্টা সময়ের টুকরো টুকরো কথোপকথনের অডিও ক্লিপ প্রকাশ করেছেন নিহতের পরিবার। স্মার্ট মোবাইলে অটো রেকর্ড হওয়া কথাবার্তা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়েছে। যে অডিও বার্তা শেষ পর্যন্ত শুনে যাওয়ার মত মানসিক দৃঢ়তায় ঘাটতি থাকলেও চোখের পানি, নাকের পানি একাকার হয়ে গেছে, তবুও শুনে গেছি শেষ পর্যন্ত, সাইরেন বাজার শব্দ, কুচকুচে কালো পোশাকের জোয়ানদের ছোটাছুটি, গুলির খোসা খোঁজাখুজি , নিরস্ত্র মানুষের সাথে বীর বাহাদুরদের চলা অপারেশনের শেষ কয়েকটি মুহূর্ত, যখন নিথর দেহটা ঘুমিয়ে আছে আর নিহত বাবার দুই রাজকন্যার কাটে নোনা জলে রাত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনার মহৎ উদ্যোগের অন্তরালে কী ভয়াবহা মানবিক বিপর্যয়ের দিকে দেশটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আপনার লোকজন, একশ্রেণীর পোশাকী বন্দুকবাজ! কী রোমহর্ষকর মৃত্যুর চাপা হুঙ্কার ছড়িয়ে যাচ্ছে সবুজ শ্যমলা বাংলার ঘরে ঘরে, কী বিমর্ষ কান্না, অপরাধী, নিরপরাধী, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, ব্লগার এমন কি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সহসা সাহস করে সত্য বলা মানুষগুলো অন্তর আজ শঙ্কিত, ত্রস্ত ।
স্থানীয় দলাদলি, প্রতিহিংসা, প্রতিপক্ষ দমনে মামলা মোকদ্দমা, অস্ত্রসহ চালান, নারী কেলেঙ্কারীতে ফাসিয়ে দেয়া, সোর্সের দেয়া ফেনসিডিল বা সারিবদ্ধ ইয়াবা সাজিয়ে প্রতিপক্ষ মাদক ব্যবসায়ীকে ফাসিয়ে দেয়ার পাশাপাশি নিজেদের পারদর্শীতা দেখানোর পুলিশি গেম এদেশের পুলিশ সমাজে নতুন নয়। কৃত্রিম কর্ম ঘটিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাসানোর পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করার হীন রাজনীতি ও নোংড়ামি বহুকাল ধরে চলে আসছে দেশের নানা মহলে। গ্রামাঞ্চলে, মফস্বলে এ ধরণের পলিটিক্সে লিপ্ত থাকে সাধারণত পাতি নেতা থেকে একশ্রেণীর পয়শাওয়ালা প্রভাবশালী, যারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে নিজেরাই অপরাধ সংগঠিত করে ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহন করে।
বিভিন্ন পত্রিকায় উঠে আসা খবর ও একাধিক ভিকটিমের পরিবারের করা অভিযোগের তথ্য উপাত্ত ঘাটাঘাটি করে প্রতিয়মান হয়েছে যে, দেশে এখন সরকারের একশ্রেণীর বন্দুকবাজ এতটাই অর্থলোভী ও বিবেক বর্জিত, জন্তুতুল্লো অমানবে পরিণত হয়েছেন, যে তার ভাড়াটে খুনি হিসাবে কাজ করছে এবং সেটির বিরুপ প্রতিফলন অদূর ভবিষ্যতে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, তা কল্পনাতীত। কেননা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না বা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে, 'সময়' চিরটাকাল কখনও কারো পক্ষে থাকে না। প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রকৃতি তার পরিমন্ডলে ঘটে যাওয়া সবকিছুর প্রাপ্তিতা ফিরিয়ে দেয়।
মিডিয়ার খবর অনুযায়ী অডিও টেপে পৌর কাউন্সিলর ও টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুল ও তাঁর মেয়ের কথোপকথনে শোনা যায়। শুরুতে দেখা যায়, মেয়ে জানতে চাইছে তিনি কোথায় আছেন। জবাবে বাবা বলেন, ‘মেজর সাহেব’ ডেকেছিলেন, ওখান থেকে তিনি টিএনও (ইউএনও) অফিসে যাচ্ছেন।
টিএনও অফিস থেকে আসতে দেরি হবে কি না, মেয়ের এমন প্রশ্নে বাবা বলেন; দেরি হবে না। এরপর ফোন কেটে যায়।
একরামের মৃত্যু: ভয়ঙ্কর অডিওতে ‘অশনি সংকেত’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বিডি নিউজ উল্লেখ করে, ঘটনার দিন দিবাগত রাত ১১টা ১৪ মিনিটে একরামের মেয়ে আবারও ফোন করলে অপর প্রান্ত থেকে একরামুল হক বলেন, “আমি টিএনও (ইউএনও) অফিসে যাচ্ছি তো, আমি চলে আসব আম্মা।” ফিরতে কতক্ষণ সময় লাগবে, মেয়ে জানতে চায়লে উত্তর আসে, “বেশিক্ষণ লাগবে না, আমি চলে আসব ইনশাল্লাহ, ঠিকাছে? ঘুমাও।”
মেয়ে দুটো আর ঘুমাতে পারেনি। যে বাবা তাদেরকে ঘুমিয়ে পড়তে বললেন, সেই বাবা চিরদিনের মত ঘুমিয়ে পড়লেন রাষ্ট্রের কতিপয় বন্দুকওয়ালার নৃশংসতায়। এদরকে আমরা কি সেই পথভ্রষ্ট্র সৈনিকের মত খুনি হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারি; যারা ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বাঙ্গালী জাতির কপালে লেপ্টে দেয় কলঙ্কের কালিমা।
নিহত একরামের দুই রাজকন্যার আহাজারি, কান্নার তিব্রতা কি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সৌভাগ্যবশত বেঁচে যাওয়া দুই রাজকন্যার কষ্ট, যন্ত্রণার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল কি?
স্থানীয় বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে করা
মাদক ব্যবসায়ী নয়, সৎ মানুষ ছিলেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত একরামুল শিরোনামের প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় নিহত একরামুল যদি মাদক ব্যবসায়ী হতেন, তাহলে মানুষটির বাসায় একটি ভাঙ্গা খাট ও দু মাসের বিদুৎ বিল বকেয়াও থাকতো না। তিনি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শুধু নেত নন, একজন জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি, যিনি দেশের নাম্বার ওয়ান ইয়াবা ব্যবসায়ী আবদুর রহমান বদির অবৈধ কারবার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন । অথচ প্রতিবাদকারী মানুষটির তরতাজা প্রাণ ঝাজরা হলো কুচক্রির পরিকল্পনায়। আর অবধৈ কারবারী, মাদকের গডফাদার চলে গেলেন পবিত্র ওমরা পালনে সৌদী। কী বিস্ময়কর আমাদের ধর্মবোধ ! শাসন ব্যবস্থা । অদ্ভুত নীরবতায় এখনও তুমি হে মহান সৃষ্টিকর্তা।
শৈশব থেকে যৌবনের পুরোটা সময় ধরে সীমান্ত লাগোয়া জেলা শহর যশোরে বেড়ে ওঠার সুবাদে ছোট বেলা থেকেই অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুনোখুনি, বোমাবাজি, মাদক আর চোরাচালান পণ্যর প্রকাশ্যে বেঁচা কেনা দেখেছি । স্থানীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সুত্র ধরে কোতয়ালী থানা ও থানার প্রাচীরের পেছনে অবস্থিত মাড়োয়ারী মন্দির পতিতালয়ে পুলিশ ও দলীয় মস্তানদের চাঁদাবাজি, জেলা প্রশাসকের বারান্দার ভাসমান পতিতাদের ক্ষুধার যন্ত্রণা, তুলোতলা মাদকপট্টির মাদক বিক্রেতাদের হাকডাক - কত কিছু ! যশোরে খুঁজলে এমন পুলিশের সংখ্যা হাতে গুনে দু'একটা মিলবে, যারা মাদকের টাকা খেতেন না। মাদক বিক্রেতার টাকায় পুলিশের বাড়ির ফার্ণিচার, টিভি মনিটর, বিমানের টিকিট, বাড়ির বাজার, প্রভাবশালী পুলিশের সেবায় কত কী যে করে গেছে মাদক ব্যবসায়ীরা, তা লিখে শেষ করা যাবে না।
লেখাটি মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে নূন্যতম অনুকম্পা নয়। বরং মাদক দমনের নামে প্রজাতন্ত্রের অস্ত্রধারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিবেককে শাণিত করার আহবান, যেন ভাড়াটে খুনি হিসাবে নিজেদের নাম ইতিহাসের চলমান কলঙ্কজনক অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ না করেন। এ অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা যেন তাদের পেশাগত নৈতিক মানদন্ড বজায় রেখে কাজ করেন। কোন ক্রমেই রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে প্রতিপক্ষ দমনের খুনের উৎসবে পরিণত না হয়, মাদক বিরোধী অভিযান ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৮ রাত ৩:৩০