ইদানিং আগের মত নেয়া হয় না সব খবর। জানা হয় না কেমন আছি আমরা, আমাদের পৃথিবী, পৃথিবীর মানুষ। কেমন চলছে আমাদের সবকিছু, মানুষের অধিকার ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। মিডিয়াই উঠে আসা খবরগুলো কেন জানি ইচ্ছে হয় না জানতে। সবই একই রকম লাগে। যা ঘটেছে বা ঘটছে এবং যেভাবে ঘটে চলেছে, সবকিছু হুবহু একই রকম প্রতিদিন। পরিবর্তনহীন জীবনযাপন মানুষের; দেশের হালচাল ও রাজনীতি।
পুরানো কোন একটি কাগজ বের করে যদি আজকের পত্রিকা ভেবে পড়ে ফেলা হয়, মনেও হবে না ধ্যাত ' এ তো পুরানো কাগজ। তাই ছুটির দিনে ঘুম, কাজের দিনে অফিস। যা কিছু চোখে পড়ে, তা কেবল ইন্টারনেটে ছুটাছুটি অথবা রিমোটের অলস দাপাদাপির ফাকে, ঢুলু ঢুলু চোখে শেষ রাতে। কোন কিছু জানতে চাই না মন। করে না প্রতিবাদ। আমি ও আমরা। আমরা সবাই "অনাগ্রহী নাগরিক" আজকাল রাষ্ট্রের। থাকি শব্দহীন।
আজ মিডিয়ায় যত্নে এবং অযত্নে স্থান পাওয়া বেশকিছু খবর যেন ঠিকরে আসে এই অনাগ্রহী নাগরিকের নিরুত্তাপ চোখে। খবরগুলোর কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পাই। নিদারুণ সাদৃশ্য ! অবরুদ্ধ ও মুক্ত জীবনের গল্প। সময়ের ব্যবধান। মানুষের অধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চিত্র। নিরাপত্তার হাল হকিকত।
পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত খবরগুলোর একদিকে যেমন রয়েছে ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনিস্টার শহরের বাকিংহাম প্যালেসে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনার সাক্ষাত, অপরদিকে ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী অসুস্থ খালেদা জিয়ার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে না দেয়ার খবর।
কী অসাম্ভব রকমের বৈরিতা, ন্যায্যতা ও মানবাধিকার আমাদের ! একদিকে রাজপথে, কিংবা ঘরোয়া ও উন্মুক্ত বৈঠকে গলা ফাটিয়ে রাজনীতি করছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। অপরদিকে সম্পূর্ণভাবে সংসদের বাইরে থাকা দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হতেই হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এ কোন স্বাধীনতা ! কেমন গণতন্ত্র !
অন লাইন মিডিয়াগুলোতে খুব অনাদারে অল্প কথায় একটি সংবাদ এসেছে। ২০ এপ্রিল শুক্রবার নড়াইল জেলায় একটি ঘরোয়া বৈঠক থেকে পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে গ্রেফতার করে। সেখান থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কবীর মুরাদ, নড়াইল জেলা বিএনপির সভাপতি বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম, যশোর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি সাজিদুর রহমানসহ নড়াইল জেলার বিভিন্ন থানা এলাকার ৫৮ জন নেতা-কর্মীকে আটক করে।
সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত
স্রেফ এই তিনটি ঘটনা থেকে সহজে অনুমেয় দেশের চলমান রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থা। চরম নিন্দনীয় এবং লজ্বাহীন শাসনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মানুষের সাহস ও শক্তিতে আঘাত করা হচ্ছে থেকে থেকে। মানসিক ও শাররীক নির্যাতন এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে অনেকটা জোর করেই নতজানু করা হচ্ছে আমাদের। প্রলুব্ধ করা হচ্ছে তাদেরকে, যারা বন্দুক ও পোশাকের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে টিকিয়ে রেখেছেন এই গণতন্ত্রহীন শাসন ব্যবস্থা। লোভাতুর হয়ে পড়ছে পেশাগত জীবন, বিবেক বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ। পরিলক্ষিত হচ্ছে পেশাগত ক্ষেত্রে নৈতিকতার অনুপস্থিতি।
তবুও নিন্দা জানায় না। জানাবো না। নিন্দা বা ধিক্কারে কিছু যায় আসে না রাষ্ট্রের।
এ আমার দেশের রাজনীতির চলমান নিষ্ঠুরতা, ক্ষমতার দীর্ঘস্থায়ী দাম্ভিকতা। যার হাতে যতটুকু আছে, দেখায় সে কারণে অকারণে থাকলে মসনদে। এ আর নতুন কী ! মানুষের ধর্ম এটি। স্বভাব বৈশিষ্ট্য। কখনও ভাবি না এতটুকু; "সময়" নামের চলমান প্রক্রিয়া চিরকাল কারোর পক্ষে থাকেনি। ইতিহাস আমাদের সে শিক্ষায় দিয়ে আসছে যুগে যুগে। একক আধিপত্য কখনও অসীম হয় না। সীমাহীন ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ।
নড়াইল থেকে গ্রেফতার হওয়া বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত হচ্ছেন দলটির খুলনা বিভাগীয় অঞ্চলের সাংগঠনিক সম্পাদক। যিনি দলটিকে সংগঠিত করতে তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। এবং তা উন্মুক্ত কর্মী সভা বা ঘরোয়া বৈঠকের আদলে। অহিংস রাজনীতিতে বিশ্বাসী অমিতের সাথে বারবার হিংসাত্নক মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে এ সরকার। গত ৩১ জানুয়ারি তাকে ঢাকাস্থ শান্তিনগরের বাসা থেকে এক দফা আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরের দিন তাঁর বড় ভাই সুমিত ইসলামকে আটক করা হয়। যিনি একটি রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বড় হয়ে উঠলেও রাজনীতির ধারের কাছে কখনও তাকে যেতে দেখা যায়নি। অমিত ও সুমিতের বাবা বর্ষীয়ান রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম। বাবা রাজনীতিক এটাই বোধ হয় ছিল বড় ছেলে সুমেতের অপরাধ।
রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিল রোগে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী আছেন। অধিকাংশ সময় তিনি যশোরস্থ নিজ বাড়িতে কখনও বা ঢাকার বারডেমে চিকিৎসাধীন থাকছেন। রাজনীতির সাথে একরকম বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। কেবলমাত্র ছোটপুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিত এবং সহধর্মিনী নার্গিস ইসলাম বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কেউই রাজনীতির সাথে জড়িত না হলেও অসুস্থ এই মানুষটির ওপর মানসিক ভাবে চাপ সৃষ্টি করতে বা তাকে বিপর্যস্থ করে তুলতে সরকার যেন বারবার তাঁর ছোট ছেলে অমিতকে গ্রেফতার করছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। বাস্তবতা হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনা তাঁর গোটা জীবনে কম ধৈর্যের পরিচয় দেননি। একটি রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে, যিনি পরিবারের সব আপনজনকে হারিয়েও নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছেন কেবল মানসিক দৃঢ়তার জোরে। তাঁর জীবন জুড়ে রয়েছে লড়াই সংগ্রাম ও ধৈর্যের পরীক্ষা। রয়েছে অহিংসতার প্রকাশ। এবং সর্বপরি তিনি ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে বিজয়ী হয়েছেন। সুতরাং সহজে অনুমেয় যে ধৈর্য্য ও মনোবলের দৃঢ়তা একজন মানুষকে শেষ পর্যন্ত কাঙ্খিত লক্ষে পৌছে দিতে সাহায্য করে। তাইতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আমাদের প্রধানমন্ত্রী। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক।
এ তো গেলো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনীতি করা মানুষের খবরাখবর। অনাগ্রাহী এই নাগরিক জীবনে নিত্যদিনের আরও খবরগুলো হলোঃ কলেজছাত্র রাজীবের মৃত্যুর পর সপ্তাহ না যেতেই বাসের চাপায় পা হারালেন আরেক তরুণী। এই দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই অর্থাৎ ২০ এপ্রিল দিবাগত রাতে ধানমণ্ডিতে ট্রাকের চাপায় মৃত্যু হয়েছে রিকশাআরোহী এক নারীর। তিনি ইস্কাটনের এসপিআরসি হাসপাতালের সেবিকা ছিলেন। নিহতের নাম মাসুদা (৩৬)। এদিকে বনানীতে পা হারানো তরুনী রোজিনা সাংবাদিক ইসতিয়াক রেজার বাড়ির গৃহপরিচারিকা। বনানী এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় কাকলীমুখী বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাসের ধাক্কায় তিনি পা হারান।
প্রতিদিন এসব খবর শুনতে শুনতে আমাদের হৃদয়ে নীরবে যে রক্তক্ষরণ ঘটে চলেছে, কে জানে কোন দিন; সেই রক্তের জোয়ার সবকিছু ভাসিয়ে না নিয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৪৮