বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান তথা ভারতবর্ষের দূর্গোৎসবের কালক্রমিক ইতিহাস নির্মাণ করা এখনো সম্ভব হয়নি। এ কাজের উপযোগী সুস্পষ্ট ও অনুপুঙ্খ ধারাবাহিক তথ্য-উপাত্তও পাওয়া যায়নি। কোনো ইতিহাসবিদ বা সমাজবিজ্ঞানী ভারতবর্ষের দূর্গোৎসব উদ্ভবের ইতিহাস ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপঞ্জি নির্ভরযোগ্য দলিলপত্র ঘেঁটে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি। তবে পূরাণ, মহাভারত, রামায়ন, ধর্মীয় কাব্য, নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও সূত্র থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
দূর্গা পূজা প্রথম কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল--তা নিয়ে ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতা শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারনা। ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারনা অতি প্রাচীন। ইতিহাস থেকে প্রমান পাওয়া যায়, প্রায় ২২,০০০ বছর পূর্ব ভারতে প্যালিওলিথিক জন গোষ্ঠি থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেন্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি, তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তার নেতৃত্বে শত্রু নাশ হয়, আর তাই মাকে সামনে রেখে দেবী বিশ্বাসে গড়ে উঠে, গড়ে ওঠে শাক্ত সম্প্রদায় মত। এই মত অনুসারে দেবী হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্ব সৃষ্টির আদি কারণ। দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র। মহাভারত অনুসারে, দূর্গা বিবেচিত হন কালী শক্তির আরেক রূপে। বাংলায় কখন থেকে শক্তির আদি বলে খ্যাত কালী পূজার প্রচলন শুরু হয় সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না ইতিহাসে। খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দী হতে বাংলায় কিছু কিছু অঞ্চলে কালী পূজার প্রমাণ মিলে। নবদ্বীপের তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। অমিল ও বৈচিত্র থাকা সত্বেও কিভাবে কালী দূর্গার রূপের সাথে মিশে অভিন্ন হয়ে গেল সে রহস্য আজো অজানা।
অস্ট্রিকভাষী নিষাদেরা প্রাচীন বাংলার গভীর অরণ্যে ‘বোঙ্গা’ দেবতার পূজা করত । কোনও কোনও পন্ডিতের ধারণা ওই ‘বোঙ্গা’ থেকেই বাংলা শব্দের উদ্ভব । কেউ কেউ ধারনা করেন, সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা) দেবীমাতার, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দূর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী--সে হিসাবে অথবা দেবী মাতা হিসাবে পূজা হতে পারে। কিন্ত পৌরাণিক আর্যদের ব্যাখ্যায়, দুর্গা ব্রহ্মা,শিব ও বিষ্ণুকর্তৃক সৃষ্ট দেবী এবং দুর্গা কিছুটা উগ্র, স্বাধীন ও কারও স্ত্রী নন। বাংলার হিন্দুধর্মটি হল তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম। তন্ত্র হল বেদবিরোধী এবং সাধনার বিষয়। যে কারণে বাঙালি তান্ত্রিকেরা দুর্গাকে পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দুর্গোৎসবের প্রবর্তক স্বয়ং কৃষ্ণ। এই পুরাণে দুর্গাপূজা প্রবর্তনের একটি ইতিহাস কথিত হয়েছে। সৃষ্টির আদিতে গোলকস্থ আদিবৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমণ্ডলে কৃষ্ণ সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন। মধুকৈটভ দৈত্যদ্বয়ের ভয়ে ভীত ব্রহ্মা দ্বিতীয়বার দুর্গার আরাধনা করেন । ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধকালে বিপদাপপন্ন মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন। এরপর দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভ্রষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন, তা ছিল চতুর্থ। আবার দেবী ভাগবত পুরান অনুসারে জানতে পারি, ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দূর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন।
পুরাণ মতে, দুর্গা পর্ণশবরী ৷ তিনি শবরদের দেবী। পর্ণশবরী ৷ দেবী ভাগবতে হলেন ‘সর্বশবরানাং ভগবতী’৷ ঝাড়খণ্ডের বনবাসী শবর মেয়েরা এখনও দুর্গা মূর্তি বিসর্জনের শোভাযাত্রায় আকণ্ঠ মদ্যপানের পর উর্ধাঙ্গ অনাবৃত রেখেই নাচতে নাচতে বিসর্জনে যান৷ মহাভারতের পরিশিষ্ট ‘হরিবংশ’-এর ‘আযার্স্তব’-এ বলা হয়েছে, ‘শিখীপিচ্ছধ্বজাধরা’ ও ‘ময়ূরপিচ্ছধ্বজিনী’ এই বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মদ্য ও মাংসে ছিল অপরিসীম আসক্তি। সপ্তম ও অষ্টম শতকের কবি বাণদেব ভট্ট ও বাকপতিও এই মতেই বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর পুজোর উল্লেখ করে বলেছেন, দেবী পশু ও নররক্তের পিপাসু ছিলেন। কথাসরিৎসাগর-এর ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ অংশে একাদশ শতকের পণ্ডিত সোমদেব ভট্ট বলেছেন, রাজা যশকেতুর রাজ্যে মহিষের কাটা মুণ্ড-র উপর নৃত্যরতা আঠারো হাত বিশিষ্ট এক দেবীর কথা, দস্যু ও ডাকাতরা যার কাছে নরবলি দিত। শাস্ত্র মতে এই দেবীর নাম ‘পাতালভৈরবী’। আসলে দূর্গা-কালী-চন্ডী-পাতালভৈরবী সহ আরো নানা দেবীকে দূর্গার সাথে গুলিয়ে ফেলে নানা কথা বলা হয়েছে। আবার হয়তো সুপ্রাচীন কালে দূর্গাকে এরূপেই পূজা করা হত।
চলবে