রক্তস্নাত দেশের নামে ভাষা- বাংলাভাষা।
- সোপানুল ইসলাম
‘৫২-র শহীদের বুকের তাজা রক্তের কালিতে স্নাত যে ভাষার মর্যাদা, সে ভাষা কুড়ি বছরে যৌবনে পর্দাপন করে পুনরায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে লাল সবুজের পতাকা অঙ্কিত জন্ম দিয়েছে একটি সুখ-দু:খ গাথা- শিরোনামে- ‘বাংলাদেশ’। ‘৫২-র চেতনায় ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চের মধ্যরাতে টগবগিয়ে ওঠা টকটকে লালরক্তে গর্ভধারণ করে নয়মাস মুক্তির চেতনায় ধীরে ধীরে গর্ভফুল থেকে দেহধারণ করে ১৬ ডিসেম্বর তীব্র চিৎকারে বিশ্বকে জানান দিয়েছিল ভাষার নামে দেশ-বাংলাদেশের আগমনী বার্তা। চিরকিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় যদি বলা যায়-
“যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।”
- নব্যভূমিষ্ঠ এই দেশকে বিশ্ববাসি দিয়েছে মর্যাদা। রক্তের হলি খেলায় রঞ্জিত এই পতাকার গৌরব পেয়েছে বিশ্বময়তা, কুড়িয়েছে নন্দিত সম্মান, ধারণ করেছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’র দেশে দেশে একটি ভিন্ন জাতিসত্তার অনন্য পরিচয়। স্বদেশের প্রিয় পতাকা, মানচিত্র, দেশের গান, জাতীয় সংগীত, সাহিত্য সংস্কৃতি ও তার ঐতিহ্য বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল শান্তির আশ্রয় ও ঠিকানা এবং সঞ্জীবনী সুধা। জন্মভূমির আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে রয়েছে অফুরন্ত ভালবাসা, প্রেম ও আনন্দধারা। প্রতিটি মানুষ মায়ের মতই প্রাণের চেয়ে জন্মভূমিকে বেশি ভালোবাসে। মানুষের হাসি, কান্না, প্রেম আনন্দ, খ্যাতি ও গৌরব সব কিছুই তার মাতৃভাষাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। তাইতো মানুষ- দেশের নদীনালার সুশীতল জলে, গাছের ছায়ায়, পাখির গানে, দেশের সুমিষ্ট ফলে, রকমারি ফুলের-শোভায় আর প্রাকৃতিক দৃশ্যে পরম আনন্দলোকে হারিয়ে যাওয়া সহ সবকিছুকেই মায়ের ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে তৃপ্ত হতে চায়।
বাঙালি সেদিন ’৫২ সালের রক্তিম ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে উপলব্ধি করেছিল ‘ফুলের বাগান সবার মনেরই আছে, ফুল ফোটাতে সবাই নাহি পারে।’ -আর তাই সে বিশ্বাসের শিকলে আঁকড়ে ধরে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত, মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্রনাথ কলেজের শিক্ষার্থী রফিকউদ্দিন আহমেদ, গফরগাঁয়ের যুবক কৃষক আব্দুল জব্বার এবং ব্যাংক কর্মচারী আব্দুস সালাম বাংলা মায়ের আঁচলে দেহধারী নির্জীব কোন মানুষ না হয়ে, আত্মাহুতি দিয়েছিল মনের সুগভীর অন্তরীক্ষে চেতনার বাগানে মনুষ্যত্বের ফুল ফোটাতে। তাঁরা এ কথাও বিশ্বাস করতো; স্বার্থমগ্ন পরাক্রমশালী বেনিয়া শাসকেরা সহজে কোনো জাতিকে স্বাধীনতা দান করে না; বহুকষ্টে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমেই তা ছিনিয়ে আনতে হয়। এটা একেবারেই সত্য যে, এই ধরাধামে কিছু অর্জনের পথ অবশ্যই কণ্টকাকীর্ণ। কাজেই পথের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই পথ করে নিতে হবে। কথায় আছে ‘পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে’। ফলে সংগ্রামের মাধ্যমেই মাতৃভাষার অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বলিষ্ঠ মনোবলের অধিকারী ভাষাপ্রেমিক পথিক - বাঙালি এ জাতি সেদিন শিখে গিয়েছিল - বর্ণাঢ্য ইতিহাস গড়ার - বজ্রধ্বনি। যুগে যুগে তাই বাংলার দামাল ছেলেরা শানিত করেছে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার নিগূঢ় চেতনা।
পীচঢালা কালোপথকে বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তে লাল গালিচা বানিয়ে, মাথার খুলি থেকে মগজ ঢেলে পরাধীনতার গ্লানি মুছে রক্তে রঞ্জিত রাজপথে হঠাৎ লাশের গন্ধে জেগে উঠেছিল - বলেছিল, ‘মাগো, ওরা বলে, সবার কথা কেড়ে নেবে; তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দিবে না, বল, মা, তাই কি হয়?’ ক্রমে ক্রমে ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতেছিল, আপোষহীন সংগ্রাম ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে- দিক নির্দেশক আলোক বর্তিকা হয়ে। এ দিকে ’৪৮ থেকে ’৫২- পর্যন্ত, নিপীড়ন আর প্রতারণার চলছিল নগ্ন মহড়া। একদিন ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় এক জনসভায় পূর্বসুরিদের অনুসরণে খাজা নাজিমুদ্দিন যখন বলে উঠলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ - এ ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথ ছাত্রজনতার আন্দোলনের বজ্রধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং ২০ জানুয়ারি ধর্মঘট, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সবগ্রাম কমিটি’র জনসভায় সিদ্ধান্ত হয়- ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন ও হরতাল করণ। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধর্মঘট। এ অবস্থায় সরকার ধর্মঘট ও ছাত্র-জনতার মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে ভয়ে ভীত হয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ধর্মঘট, জনসভা বা শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দেয়। কিন্তু পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারিতে উত্তেজিত ছাত্রজনতার উত্তাল জনসমুদ্র ১৪৪ ধারার বিধি নিষেধ ভঙ্গ করে মিছিলে মিছিলে - এদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ শ্লোগানে বলতে ছিল- ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।’ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্রজনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দেন। তৎক্ষণাৎ পুলিশের গুলিতে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের মাথার খুলি উড়ে গেল, বুক হলো ঝাঁঝড়া - শহীদ হলো- সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বার।
এরপরই সারা বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিবাদের ভাষায় আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠল। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ এনামূল হকের মতে “একুশে ফেব্রুয়ারি কোন বিশেষ দিন, ক্ষণ বা তিথি নয়, একটি জাতির জীবন্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস অগ্নিগর্ভ। যেন সজিব ‘লাভা স্রাবক আগ্নেয়গিরি’, কখনও অর্ন্তদাহে গর্জন করেছে, আবার কখনও চারিদিকে অগ্নি ছড়াচ্ছে। সত্যি এ ইতিহাস মৃত নয়, একেবারে জীবন্ত।”
ইকতিয়ার চৌধুরীর- ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাকি ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- ‘মায়ের ভাষার সম্মান সমুন্নত রাখার সংগ্রামের সূচনা অবশ্য আরও আগে হতেই। এমনকি তা’ পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে। জুলাই ১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রস্তাব করেছিলেন ব্রিটিশের প্রস্থানের পর বাংলা নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অভিষিক্ত হতে পারে। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতিসন্তান রামরাইল গ্রামের অধিবাসী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তানের আইন পরিষদে বাংলাকে পরিষদের অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব এনেছিলেন- যা গৃহীত হয়নি। পূর্বপাকিস্তান কংগ্রেস পার্টির নেতা ধীরেন্দ্রনাথ যুক্তি দেখিয়েছিলেন- পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যার ৪ কোটি ৪০ লাখই বাংলায় কথা বলে - যার স্বীকৃতি থাকতে হবে।’ আর সেকারণেই একুশ এলেই মনের পর্দায় অনুভব করি বাংলাদেশ আমার মা; বাংলা ভাষা আমার মায়ের দুগ্ধ, একুশ আমার চেতনা, ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত আমার অহংকার।
উর্দু, পাকিস্তানের কোনো অঞ্চল কিংবা এদেশের অধিবাসীদের ভাষা ছিল না। উর্দু শব্দটি নিজেই একটি তুর্কি শব্দ। যার অর্থ ক্যাম্প। যাইহোক ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) দ্বারা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষিত হবার পর এই দিবসটি আন্তর্জাতিক স্বাীকৃতি লাভ করে। মায়ের ভাষা সুরক্ষায় মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন, একুশে ফেব্রুয়ারি, অমর একুশে, মহান ভাষা দিবস।
সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত ভাষা - বাংলা ভাষা; সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত দেশ- বাংলাদেশ
তাইতো, ভাষার নামেই দেশের নাম- বাংলাদেশ,
যার চিরসবুজের বুকে ’৫২র ২১ শে ফেব্রুয়ারি হয়ে আছে এক রক্তিম লাল তিলক।
- তবে, এই অর্জনকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। কোন কিছু অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা অনেক কঠিন। ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ভাষা। মুখে যদি এই মায়ের ভাষা, আর প্রাণের ভাষা না থাকতো- তাহলে কী হতো, একটু ভেবে দেখলেই অন্তর দর্পণে সুস্পষ্টই প্রতিবিম্ব ফোটে উঠবে, অনুপ্রাণন করবে। জাতির এত বড় একটি অর্জনকে কোনভাবেই অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই বা ছোট করে দেখারও সুযোগ নেই।
একুশে ফেব্রুয়ারি এমনই এক ভাষাময় জীবন্ত গতিশীল কিংবদন্তী। যা প্রতিবছর বিশ্বের ১৮৮ টি দেশে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপিত হবার গৌরব অর্জন করেছে। অপরদিকে শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই সারা মাস চেতনায় অনেক কিছু ধারণ করবো। আবার ফেব্রুয়ারি চলে যাওয়ার সাথে সাথেই সবশেষ হয়ে যাবে - তা হলে কখনোই সাফল্যের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। একুশের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে গ্রামে-গঞ্জে, শহর-শহরতলী সহ সারা বাংলায় বাংলাভাষায় সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে। এভাষায় আরো অনেক অনেক গবেষণা করতে হবে, অনেক বইপত্র পড়তে ও লিখতে হবে, প্রকৃতির রাণী বাংলার মানব মনের মননশীলতা বিকাশে ভাষা প্রকাশের সর্বস্তরে প্রেরণা দান করতে হবে। প্রতি জেলা-উপজেলায় ভাষা গবেষণা কেন্দ্র চালু করতে হবে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বাধ্যতামূলক করতে হবে, ঘরে ঘরে লাইব্রেরি স্থাপন করার মানসিকতা বৃদ্ধি করতে হবে, উপহার হিসেবে স্থানীয় বা দেশীয় কবি সাহিত্যিকদের বই বা রচনা সামগ্রি কেনার অভ্যাস গড়ে তোলতে হবে। তবেই কেবল- রক্তাঙ্কিত ভাষার মাধুর্য বৃদ্ধি পাবে। শহীদের তাজা রক্তে টগবগিয়ে ওঠা প্রতিটি দেহকোষে সঞ্চারিত দেশমাতৃকার তরে আত্মত্যাগের রক্তাক্ত প্রাণবায়ুর বর্ণিল স্ফুলিঙ্গে অনুরণন অনূভুত হবে।
বাংলার আকাশে বাতাসে গর্বে বুক ফুলিয়ে আনন্দের নি:শ্বাস নিয়ে অহংকার করি যখন জানি, পৃথিবীর মানচিত্রে যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ভাষার সম্মান ও অধিকার নিয়ে একমাত্র ভাষা বাংলাই শির উঁচু করে দণ্ডায়মান। ভাষার নামে দেশের নামকে বিকশিত করার রক্তস্নাত বলিদান তখনই পুরোপুরি সার্থক হয়েছে।