১. ২০০৬ সালে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল বিচারপতি কে এম হাসানের। কিন্তু জনাব হাসানকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ আখ্যা দিয়ে সাংবিধানিক সেই বাধ্যবাধকতাকে আওয়ামীলীগ তখন মানেনি। তাহলে বলুন, শেখ হাসিনা নিজেই সরকারপ্রধান হিসেবে থেকে নির্বাচন করলে এবং সেই নির্বাচনকে ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা’ আখ্যা দিলে সেটা কি বিএনপির মেনে নেয়া উচিত? কে এম হাসানের অধীনে নির্বাচনে আস্থা রাখা না গেলে শেখ হাসিনার অধীনে আস্থা রাখা যায় কি?
২. আওয়ামীপন্থী সুশীলরা বলছেন, নির্বাচনে অংশ নেয়া যেমন অধিকার, ঠিক তেমনি নির্বাচনে অংশ না নেয়াও কোনো রাজনৈতিক দলের অধিকার। তাহলে বলুন, এরশাদকে জোর করে নির্বাচনে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা করল কেন আ’লীগ? মনোনয়ন প্রত্যাহার করা সত্ত্বেও জাপার বহু সদস্যের মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয়নি কেন? নির্বাচনে অংশ না নেয়া কি শুধু বিএনপিরই অধিকার? জাপার সেই অধিকার নেই???
৩. শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে সংলাপে যোগ না দেয়ায় আওয়ামীপন্থী সুশীলরা বেগম জিয়াকে দোষী করেন এবং বলতে চান যে সেই সংলাপটি অনুষ্ঠিত হলেই বুঝি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত! আসলেই কি বেগম জিয়া শেখ হাসিনার সংলাপে অংশ নিলেই সব কিছুর সমাধান হয়ে যেত? ধরলাম, বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে খুব ভুল করেছেন। কিন্তু বিএনপির সিনিয়র নেতারা তো ঠিকই আ’লীগের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের সঙ্গে তারানকোর মধ্যস্থতায় সংলাপে বসেছিলেন! সংলাপের মধ্য দিয়েই সমঝোতা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকলে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হলো কেন?
৪. আ’লীগ-বিএনপি উভয় দলকেই ছাড় দেয়া দরকার বলে সুশীলরা বলেছেন। কিন্তু বিএনপির কাছ থেকে কোন ধরনের ছাড় আশা করেন তারা? বিএনপি তো হুবহু ত্রয়োদশ সংশোধনীর আদলে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়নি, চেয়েছে যেকোনো ফরম্যাটের একটা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার। রাষ্ট্রপতির অধীনে নির্বাচন করতে চাইলেও বিএনপি তা মেনে নিত বলে দলটির নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে সেরকম নমনীয়তা দেখা গেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও বার কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। কিন্তু এরকম কোনো প্রস্তাবকেই গ্রাহ্য করেনি আ’লীগ।শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তার হাতে অসীম ক্ষমতা রেখেই নির্বাচন করতে চেয়েছে আ’লীগ। এমতাবস্থায় বিএনপির কি উচিত ছিল ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থনপুষ্ট নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ছাড় দেয়া?
৫. আ’লীগের অধীনে নির্বাচনে গেলে সেটা যে বিএনপির জন্য পায়ে কুড়াল মারা হতো, সেটা কি এই নির্বাচন কমিশনের আচরণ থেকে স্পষ্ট হয়নি? মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পরও এই নির্বাচন কমিশন জাপার প্রাথীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেনি; আবার প্রত্যাহারের সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও আওয়ামীপন্থীদের বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করার জন্য বিপক্ষ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুসারে প্রার্থীদের সম্পদ-বিবরণী প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন কিন্তু আ’লীগের চাপে সেই তথ্য ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আওয়ামীলীগ আইন লঙ্ঘন করে প্রচার-প্রচারণা চালালেও নির্বাচন কমিশন আপত্তিটুকুও জানায়নি। সাবেক আওয়ামী মন্ত্রী আবু সাঈদ এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী প্রার্থীর পক্ষে খোদ পুলিশ নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে! এরকম ভূরি ভূরি নজিরের পরও কি আওয়ামীপন্থী সুশীলরা বলবেন যে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হওয়া সম্ভব ছিল?
৬. অনেকেই বলছেন, বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, আ’লীগ যে বন্দুকের শাসন কায়েম করেছে, শত শত মানুষ হত্যা-গুম করেছে, তার বিপরীতে সাধারণ নিরস্ত্র মানুষ যে প্রতিরোধ তৈরি করেছে, সেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন নয় কি? বঙ্গবন্ধুর মতো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বকে হত্যার পর তার প্রতিবাদ জানাতে বন্দুকের মুখে মানুষ রাস্তায় নামতে পারেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে পূর্বে কখনোই এবারের মতো বন্দুকের নলের শাসন কায়েম হয়নি। কখনোই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের ওপর এভাবে নির্বিচারে গুলি চালায়নি, গুম করেনি (আওয়ামীপন্থী আইন ও সালিস কেন্দ্র বলছে, কেবল ২০১২ সালের অর্ধেক পর্যন্ত এই সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে একশরও বেশি মানুষ গুম হয়েছে)। সুতরাং, বন্দুকের শাসনের মুখে বঙ্গবন্ধুর খুনের বিরুদ্ধে যেখানে মানুষ প্রতিবাদ করতে পারেনি, সেখানে অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা-গুমের পরও যে বিরোধী দলের কর্মীরা এখনো রাস্তায় নামছে, প্রতিরোধের চেষ্টা করছে, সেটা কম কিসে?
মনে রাখতে হবে, এই মুহূর্তে কেবল বিরোধী দলের সক্রিয় কর্মীরাই মাঠে নামছে, সাধারণ মানুষ নীরবে আ’লীগের নির্যাতন প্রত্যক্ষ করছে, নির্বাচন হলে তারা ব্যালটের মধ্য দিয়ে আ’লীগকে শাস্তি দিত, যার আভাস পাওয়া গিয়েছিল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনগুলিতে। আগামীতে আওয়ামী সরকার জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইলে নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষও অতীষ্ঠ হয়ে একসময় মাঠে নামবে। ইতিহাস তেমনটাই বলে না কি?
৭. ৫ জানুয়ারি তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ বলছেন আওয়ামীপন্থীরা। কিন্তু এই সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের অধীনেই যে ২৪ জানুয়ারি-পরবর্তী আরো ৯০ দিন সময় নির্বাচনের জন্য নেয়া সম্ভব, তারা কি সেটা জানেন না? আর সংবিধান তো কোনো ঐশীবাণী নয় যে এর পরিবর্তন হতে পারবে না। ২০০৬ সালে এই কথাটি বারবার আওয়ামীনেতা ও সুশীলরা উচ্চারণ করতেন। তাহলে এখন কেন সংবিধানের এত্তো দোহাই? সংবিধানের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে সমাধান করে পরবর্তীতে তার আইনি ভিত্তি দেয়ার নজির তো বাংলাদেশেই রয়েছে। ১৯৯০ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইতিহাস তো সেটাই বলে। তাহলে এখন কেন তেমনটি সম্ভব নয়? সুতরাং, সংবিধানের দোহাই দিয়ে এই নির্বাচন অনুষ্ঠান যে কতটা ভাওতাবাজি সে সম্পর্কে কোনো সংশয় আছে কি?
সবশেষ কথা, নির্বাচনে ভোট দেয়া যেমন অধিকার, ভোট থেকে বিরত থাকাও আমার তেমনই অধিকার। সুতরাং, আমি এই নির্বাচনে ভোট দেব না এবং বন্ধু-পরিজনকে ভোট না দিতে উদ্বুদ্ধ করব। আগামীকাল আমার এই অধিকারটুকুও হয়তো স্বৈরাচারী এই সরকার কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপব্যবহার করে এবং নিজ দলের ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে। কিন্তু বন্দুকের নলের মুখে সাময়িক কার্যোদ্ধার হলেও জনগণের মনের ভেতর যে ঘৃণার পাহাড় সঞ্চিত হচ্ছে, তার বিস্ফোরণ আওয়ামীলীগ কতদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে???
মূল লেখা: আতিক হাসান
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:০৬