somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আ রোড ট্রিপ উইথ রোদেলা

২২ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৭:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



"এ্যাই! আমার জন্যে একটা ডাবল ডাবল স্টীপ টী এনো। আর সাথে সিসেমি বেগল উইথ বাটার! বুঝেছোতো? সাথে কিছু মিক্সড টীম-বীডস! আর শোন, ন্যাপকিনস আনতে ভুলোনা কিন্তু! " টীম হর্টনস কফিশপের দিক পা বাড়াবো এমন সময় পেছন থেকে রোদেলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেলাম।

সকাল আটটা বেজে ত্রিশ মিনিট। অনরুটে আমাদের গাড়ি দাঁড়ানো।

ওন্টারিও 401 ইস্ট হাইওয়ে ধরে টরন্টো থেকে ভোর ছ'টায় রওনা হয়েছি ক্যুবেক সিটির উদ্দেশ্যে। প্রায় দশ ঘন্টার একটা ধাক্কা। রোদেলা বেগম গাড়িতে উঠেই ভোস ভোস করে ঘুমাচ্ছিল। টয়লেট প্লাস সিগারেট ব্রেকের জন্যে অনরুটে গাড়ি থামিয়েছি। রোদেলা ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। আর হাই তুলতে তুলতে অর্ডার শুরু করে দিয়েছে।

প্রতি বছর গুণে গুণে দু'বার আমি বড় কোন ভ্যাকেশনে যাবোই যাবো। কোথায় যাবো সেটা সিলেক্ট করার জন্যে আমার নিজস্ব একটা সিস্টেম আছে। সিস্টেমটা হলো, আমার রিডিং রুমের দেওয়ালে নর্থ আমেরিকার একটা বড় ম্যাপের বোর্ড টাঙ্গানো আছে। ভ্যাকেশনের আগে আমি নিজের চোখ একটা কালো কাপড় দিয়ে বাঁধি। তারপর সেই ম্যাপের গায়ে চোখ বন্ধ করা অবস্থায় একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে আমি ডার্টবোর্ডের ছোট একটা তীর ছুড়ে মারি। তীরটা কানাডা'র যে প্রভিন্স বা আমেরিকার যে স্টেটে গিয়ে বিদ্ধ হবে, আমার ভ্যাকেশন সেই জায়গাতেই হবে।

এবারের এই ক্যুবেক সিটির ভ্যাকেশনটা অবশ্য ঠিক সেই 'তীর মারা' নিয়মে হলোনা। এর কারণ হলো, একটা উৎপাত উদ্রেককারী প্রাণী। আর সেই প্রাণীটা হলো রোদেলা। সে রীতিমতো চোখ খুলে দেয়ালের ম্যাপের একদম কাছে গিয়ে ক্যুবেক সিটির ওপরে তীরটা গেঁথে দিলো। অর্থাৎ, তার ক্যুবেক সিটি দেখা হয়নি বলে আমাকেও সেখানেই যেতে হবে। মগের মুল্লুক আর কী। যাইহোক। এটা নিয়ে আমি আর কথা বাড়ালামনা। কারণ সেন্ট লরেন্স নদীর ধারের ওল্ড ক্যুবেক আমাকেও কেন জানি হাতছানি দিয়ে ডাকছে আবার।

কথা ছিল দু'জন মিলে ড্রাইভ করে যাবো। রোদেলা গাড়িতে উঠেই ওয়াদা ভঙ্গ করলো। স্ট্রেইট জানিয়ে দিলো যে, সে পুরো রাস্তা ঘুমিয়ে যাবে। লং ড্রাইভ করতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ঘাড়, কাঁধ - এগুলো মারাত্মক ব্যাথা করে। রোদেলাকে সিস্টেম করে একটু টিপিয়ে নিতে হবে চান্স পেলে। আজকাল আমার গা-হাত-পা মাসাজ করিয়ে নিতে তার প্রায় পায়ে পড়া লাগে।

গাড়িতে এসে কেবল বসতে পারিনি। এমন সময় রোদেলা বেগম ফিস ফিস করে বললো, "এ্যাই দ্যাখো দ্যাখো। পাশের গাড়িতে। ছেলে মেয়ে দুইটা কী শুরু করেছে!"

আমি আড় চোখে তাকালাম। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম, :ছি: রোদেলা, মানুষ একটু 'লাভ মেক' করবে। সেটাও কী তোমার জন্যে পারবেনা?"

"এ্যাহ! পারবেনা কেন? তাই বলে এই সাতসকালে গাড়ির ভেতরে? পৃথিবীতে আর জায়গা নাই? ওদের কী বাড়ি-ঘর নেই? আর ওরা করতে পারলে আমরা তাকাতে পারবোনা?"

"না, পারবেনা। এখানে কেউ তাকায় না।" খানিকটা ধমকের সুরে বললাম কথাটা।

"প্লীজ। নীতি কথা রাখো। আমার ইচ্ছা, আমি তাকাবো।" এই বলে রোদেলা সত্যি সত্যি ড্যাব ড্যাব করে ওই গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

আমি প্রমাদ গুণলাম। গাড়ির দরজা খুলে এমনভাবে বের হয়ে যাচ্ছিলাম যে, রোদেলা নামক পদার্থটাকে আমি চিনিই-ই না যেন।

পেছন থেকে টী-শার্ট খামচে ধরে রোদেলা বললো, "এ্যাই, কই যাচ্ছো? দ্যাখোনা। ছেলেটা কত্ত রোম্যান্টিক! তোমার মতো এরকম পুরু চশমাওয়ালা নার্ড না।"

"শোনো রোদেলা, আমি শিওর যে, ওরা নিউ কাপল। নতুন নতুন অনেক জোশ থাকে। প্রথম কয়েকমাস উত্তেজনা কাজ করে। তারপর একজন আরেকজনের সাথে ইউজড-টু হয়ে গেলে সব ব্ল্যাক-অ্যাণ্ড হোয়াইট, নাথিং কালারফুল।"

"তোমার কী মনে হয়, কিছুদিন পর ওরা 'বোরড' হয়ে যাবে একজন আরেকজনের সাথে?" চোখ নাচিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল আমাকে রোদেলা।

"হতে পারে। আবার এক্সট্রিম কেসে ছাড়াছাড়িও হয়ে যেতে পারে।"

"ছাড়াছাড়ি?" রোদেলার কণ্ঠ কিছুটা বিষন্ন।

"হ্যাঁ। অবশ্য এইসব ছাড়াছাড়ির কেসগুলো মাল্টি ফ্যাকটোরিয়াল। অনেক ধরনের ভ্যারিয়েবল কাজ করে। যেমন ধরো একটা রিলেশনশীপ-এ যদি কাপলের মধ্যে আগে থেকেই গ্যাঞ্জাম থাকে এবং সেখানে কোন থার্ড পারসন যদি নাক গলায়, তাহলে গেম ওভার হতে টাইম লাগেনা। সেইসব থার্ড পারসনরা সম্পর্ক ভাঙ্গার ক্ষেত্রে পজিটিভ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। আর সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেলে কিছু ফিল্মি ডায়লগতো তাদের রেডি। যেমন, আল্লাহ যা করেছেন, ভালোর জন্যেই করেছেন। ও তোমার যোগ্য নয়। ও তোমাকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসেনি। বাসলে ছেড়ে যেতে পারতোনা। তুমি এর চাইতেও ভালো কাউকে খুঁজে পাবে। সামনের দিকে মুভ অন করো। জীবন থেমে থাকবেনা। ইত্যাদি।

একটা সম্পর্ক থেকে বের হয়ে মানুষ সাধারণত: ফ্রাস্টেটেড থাকে। তখনই তার আরেকবার ভুল করার প্রোবাবিলিটি থাকে বেশি। কারণ সে আশ্রয় খুঁজতে চায়, অন্য একটা মানুষের সঙ্গ চায়, একটা জানালা চায় যেখানে সে বুক ভরে অক্সিজেন নিতে পারবে। এই জানালাটা চিনতে যদি আবার ভুল হয়, তাহলে আবারও ..."

"তাহলে কী তুমি বলছো, রিলেশনশীপ, বিয়ে - এগুলো রিস্কি ব্যাপার?" আমাকে থামিয়ে দিয়ে রোদেলা জিজ্ঞেস করলো।

"ওয়েল, ডেফিনেটলি কমবেশি রিস্কতো আছেই। একটা ভালো কুকুর আর কমপ্যাটিবল লাইফ পার্টনার পাওয়া জীবনে ভাগ্যের ব্যাপার, তাইনা? এটা মনে হয় শেক্সপিয়ার বলেছিলেন।"

"যাহ! শেক্সপিয়ারেরতো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। চাপা কম মারো, বুঝলে?" মাঝে মাঝে রোদেলা বেগম এভাবেই আমাকে ফিউজ করে দেয়।

আমাদের গাড়ি এখন হাইওয়েতে। রোদেলা বেগমকে কথা দিয়ে জাগিয়ে রাখতে হবে। নাহলে ওর ঘুম দেখে আমারও কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। হাইওয়েতে ঘুমালে দুইজনকেই সোজা উপরে চলে যেতে হবে। নো চয়েস।

রোদেলার বামহাতটা আমার ডান হাত দিয়ে ধরে বললাম, "বিয়ে নিয়ে গল্প শুনবে একটা?"

একগাল হেসে রোদেলা আমার দিকে একটু ফিরে আহ্লাদি করে বললো, "তোমার গল্প শুনতে কবে 'না' বলেছি, বলো?"

এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে গাড়ির স্পীড ঘন্টায় একশো দশ কিলো ঠিক রেখে আমি গল্প শুরু করলাম।

"সেবার আমি ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ডেট্রয়েট এয়ারপোর্টে এসে নেমেছি। লাগেজ বেল্ট থেকে লাগেজগুলো কালেক্ট করে ট্যাক্সি ডাকতে যাবো। এমন সময় হঠাৎ দেখি দুইজন অচেনা মানুষ আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। দুই সেকেণ্ড জাস্ট চিন্তা করলাম যে, কী হতে পারে? এরা কী ছিনতাইকারী নাকি? জোরে একটা চিৎকার দিবো কিনা ভাবছি যখন, তখনই ভালো করে তাকিয়ে দেখি ফয়সাল আর ফারিয়া।

আমি ওদেরকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম।

তোরা? এখানে? আনন্দে আমি কথাই বলতে পারছিলামনা।

"হ্যাঁ ভাইয়া। একই ফ্লাইটে এসেছি আপনার সাথে। প্লেন থেকে নামার সময়ই আপনাকে প্রথম খেয়াল করেছিলাম। এরপর ভাবলাম দুইজনে একসাথে আপনাকে চমকে দেই। খিলখিল করে হাসতে হাসতে ফারিয়া প্রায় এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললো। আমরা ডেট্রয়েট এসেছি বছর দু'য়েক হলো। ফয়সাল এখানকার স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পি.এইচ.ডি প্রোগ্রামে আছে।

বাই দ্য ওয়ে, ওই যে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের একমাত্র ছেলে ফারহান। আর বাবাকেতো চেনেনই।

আমি চশমরা ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ফারহানের হাত ধরে বয়স্ক এক লোক দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোককে আমি চিনি। খুব ভালো করেই চিনি। ভদ্রলোকের সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি অপরাধীর মতো মাথা নামিয়ে নিলেন।

ফারহান, এদিকে আসো বাবা। আঙ্কেলকে সালাম দাও।

ফারিয়া যে কী বলছিলো, আমার কানে কথাগুলো কিছুই ঢুকছিলো না। আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। ফিরে গিয়েছি প্রায় বছর দশেক আগে।

ফ্ল্যাশ ব্যাকের মতো করে সব পুরনো স্মৃতি, ছবিগুলো আমার সামনে যেন ভেসে উঠলো।

ফয়সাল আর ফারিয়া আমারই জুনিয়র। ওরা ইয়ারমেট। ভার্সিটির ক্যাম্পাসে একসাথেই আড্ডা দেয়। শুরুতে ফয়সালের সাথেই আমার সম্পর্কটা বেশি ছিল। কারণ আমার সাথে সে-ও নীলয়দা'র কাছে গীটার শিখতো। ওখান থেকেই পরিচয়।

এরপর ফারিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। বয়সে ওদের কিছুটা সিনিয়র হলেও আমাদের তিনজনের বন্ধুত্বে বয়সের থেকে সুমন চট্টোপাধ্যায় কিংবা নচিকেতার গান, বিনদাস ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা - এগুলোই বেশি প্রাধান্য পেল।

তারও কিছুদিন পর ফয়সাল আমাকে জানালো যে, সে ফারিয়ার ব্যাপারে সিরিয়াস। ওকে প্রোপোজ করতে চায়। কিন্তু তার হাঁটু কাঁপছে। আমি হাসতে হাসতে তাকে রোম্যান্টিক ওয়েতে প্রোপোজের কিছু তরিকা শিখিয়ে দিলাম।

আমার 'বটিকা ইণ্ডিয়া' মোতাবেক ফয়সাল তার জন্মদিনে একটা ক্যাণ্ডেল নাইট ডিনারে বুকে 'সাহস' টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি দিয়ে ফারিয়াকে প্রোপোজ করে ফেললো। ফারিয়াও লক্ষ্মী মেয়ের মতো ফয়সালের ফ্রেণ্ড থেকে গার্ল ফ্রেণ্ড পদমর্যাদায় ভূষিত হলো।

অত:পর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকলো - এভাবেই গল্পটা শেষ হতে পারতো।

কিন্তু না। এত তাড়াতাড়ি গল্প শেষ হলে দর্শক মুভি দেখবে? দেখবেনা। কাজেই ফয়সাল আর ফারিয়ার জীবনেও টুইস্ট আসলো। অর্থাৎ, পুরাই বাংলা সিনেমার কাহিনী শুরু হয়ে গেল।

ফারিয়ার বাসা থেকে তার বিবাহের কথাবার্তা শুরু হলো। ফয়সাল এখনও স্টুডেন্ট। পাশ করবে, তারপর চাকুরী নিবে। দিল্লি বহুত দূর। ফারিয়ার পুলিশ কমিশনার বাবা পারলে কালকেই ফারিয়াকে বিয়ে দিয়ে দেন। ফারিয়ার জন্যে তিনি আমেরিকা প্রবাসী ছেলে রেডি করে ফেলেছেন। ছেলে আগামী মাসে দেশে আসবে। তারপর সুন্দরী ফারিয়াকে বগলদাবা করে নিয়ে উড়ে চলে যাবে।

আর একই সাথে আঙ্কেল, মানে ফারিয়ার বাবা ফয়সালের নামে হুলিয়া জারি করে দিয়েছেন। কোনভাবেই এই বেকার স্টুডেন্টের সাথে মেয়ে বিয়ে দিবেননা তিনি। প্রয়োজনে মেয়েকে কেটে টুকরা টুকরা করে বুড়িগঙ্গার নোংরা পচা পানিতে ভাসিয়ে দিবেন। টিপিক্যাল বাংলা মুভি যাকে বলে!

ফয়সাল তার প্রেমিকার বিরহে পড়াশুনা ছেড়ে দিল। গাঁজা চরস আফিম খাবে খাবে করছে। এমন সময় একদিন আমার বাসায় এসে সে উপস্থিত।

"ভাইয়া, ওকে ছাড়াতো আমি বাঁচবোনা"। ফয়সাল প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে আমাকে জানালো।

সেটাই। এই ডায়লগটা দেওয়াই তোর বাকী ছিল। বুঝলি? আমি হাসতে হাসতে বললাম।

শোন্ ব্যাটা। এইসব ফালতু ডায়লগবাজী না করে যদি সত্যিকারভাবে ফারিয়াকে চাস, আর সে-ও তোকে চায়, তাহলে যা বিয়ে করে ফ্যাল দু'জন।

ফয়সাল যেন আকাশ থেকে পড়লো। আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বললো, "বিয়ে করে ফেলবো? তারপর কী হবে?"

তারপরেরটা তারপর দেখা যাবে। শোন্ ফয়সাল, আগামীকাল বাদ আসর তোদের বিয়ে। তোকে কিছুই করতে হবেনা। ব্যবস্থা যা করার সেটা আমি-ই করবো। তুই শুধু ফারিয়াকে নিয়ে লালমাটিয়া পানির ট্যাঙ্কির কাছের কাজী অফিসে বিকাল পাঁচটার মধ্যে চলে আসবি। এখন যা, ফারিয়া কী বলে সেটা দ্যাখ। আর আমাকে আজকে রাতের মধ্যে কী ডিসিশন নিলি সেটা কনফার্ম কর।

রাত সাড়ে নয়টায় ফয়সালের ফোন এলো। একটাই কথা শুধু সে বললো, "কমরেড, আমরা রেডি।"

পরদিন বিকাল সাড়ে পাঁচটায় পাঁচলক্ষ একটাকা দেনমোহর ধার্য্যবাবদ ফয়সাল এবং ফারিয়া নতুন দম্পতিতে রূপান্তর লাভ করলো। এর আগে সকাল বেলায় ওদের বিয়ের টুকটাক শপিং আমি নিজেই করে ফেললাম। পরিশেষে কাজী সাহেব এবং দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ওদের বিয়েতে আমি হলাম ফারিয়ার 'উকিল বাপ'।

"এরপর? বিয়েতো করলাম, এখন আমাদের কী হবে?" দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে করুণ দৃষ্টিতে চাইলো।

আমি পকেট থেকে গ্রীনলাইনের দু'টো টিকেট বের করে দিলাম। ঢাকা টু সিলেট। কক্সবাজার না। বাংলাদেশে বিয়ের পর মানুষ হানিমুন করার জন্যে কক্সবাজার ছাড়া আর কোন জায়গা চিনে বলে মনে হয়না। পুরাই গার্বেজ বানিয়ে দিয়েছে কক্সবাজারটাকে।

"মন দিয়ে শোন্ তোরা।" আমি ওদেরকে কাজী অফিসের বাইরে এনে কথা শুরু করলাম।

সিলেট গিয়ে প্রথমেই শাহজালাল এবং শাহপরাণের মাজার জিয়ারত করবি। হোটেল সুপ্রিমে তোদের জন্যে পনের দিনের রুম বুক করা আছে। এই পনের দিনের মধ্যে আমি না বলা পর্যন্ত ভুলেও ঢাকা আসবিনা। আর তোদের ফোন নম্বর বন্ধ রেখে শুধুমাত্র আমার দেয়া এই সিমটা ইউজ করবি। তা-ও শুধু আমার সাথে যোগাযোগের জন্যে। কথাগুলো বলে ফয়সালের হাতে হাজার দশেক টাকা গুঁজে দিয়ে ওদেরকে গ্রীনলাইন বাস কাউন্টার পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম।

দিন দশেক পরের কথা। সকালে স্টুডেন্ট পড়াতে বের হবো। এমন সময় কাজের মেয়ে এসে খবর দিলো, "ভাইয়া, পুলিশ আইসে। আপনেরে খোঁজে।"

মৃদু একটু হাসলাম। কাঁধের ব্যাগটা সাথে নিয়ে সদর দরজার দিকে পা বাড়িয়ে দেখি আমাদের ধানমণ্ডি থানার ও.সি সাহেব দু'জন কনস্টেবলসহ উপস্থিত। ও.সি সাহেব আমার বড় চাচার বোজম ফ্রেণ্ড। সেই সূত্রে আমাকে ছোটবেলা থেকেই তিনি চিনেন। ও.সি সাহেব কথা বলার আগেই আমি বললাম, "চলেন, আমি রেডি।"

ও.সি সাহেব বললেন, "ইয়ে মানে, আমি স্যরি আসলে। উপর থেকে নির্দেশ এসেছে। তুমিতো ফারিয়া'র বন্ধু। ফারিয়াকে অপহরণের দায়ে তোমাকে আসামী করে একটা মামলা করা হয়েছে। এজন্যেই থানায় যেতে হবে একটু।

থানায় এসে দেখি ফারিয়ার বাবা, মা আর চাচা-ফুফুরা উপস্থিত। সবাই আমাকে দেখে প্রায় মারমুখী।

ফারিয়া'র বাবা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, "ফারিয়া কই? ওকে কোথায় রেখেছিস তুই?"

আমি তার চোখে চোখ রেখে শীতল এবং ধীর গলায় বললাম, "আঙ্কেল, শান্ত হোন। আপনিতো ভদ্র ফ্যামিলির মানুষ। কাইণ্ডলি তুই-তোকারি করে নিজের চারিত্রিক দৈন্যতা প্রকাশ করবেননা। ফারিয়া ভালোই আছে। ফয়সাল আর ও দিন দশেক আগে বিয়ে করেছে। এখন ওরা সহি-সালামতে আছে।"

আমার কথাগুলো শুনে আঙ্কেল, মানে ফারিয়ার বাবা আমাকে মারতে এলেন। ওর চাচারা অনেক কষ্টে তাকে আটকালো।

এরপর ফারিয়ার পুলিশ কমিশনার বাবা হুঙ্কার দিয়ে ও.সি সাহেবকে বললেন, "এই ব্যাটাই যত নষ্টের মূল! এই শালাকে জেলে ঢোকান। ওকে আমি যদি জেলের ভাত না খাওয়াই, তাহলে আমিও পুলিশ কমিশনার ইয়াহিয়া খান নই!"

দু'জন কনস্টেবল আমার দিকে এগিয়ে এলো।

এটুকু শুনে রোদেলা উত্তেজনায় কাঁপছে। "তুমি জেলে গেলে? কি সাংঘাতিক!"

আমি বললাম, "আহা! বেবি, শেষটুকু শোনোতো আগে।

বাই দ্য ওয়ে, তুমি কী জানো যে, দাবা খেলায় আমি কখনো আমার ঘোড়াকে আগে চালিনা? আর তাস খেলায়? আমার হাতে টেক্কা থাকলেও সেটা কাক-পক্ষীতেও টের পাবেনা।"

তারপর কী হলো শোনোনা।

আমি হাত তুলে কনস্টেবলদেরকে থামালাম। বললাম, "ঠিক আছে, জেলের ভাত খেতে হলে খাবো। কিন্তু আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে, তাইনা? আমাকে আপনারা বলতে দিন।

কাঁধের ব্যাগটা থেকে ফারিয়ার নিজ হাতে লেখা একটি চিঠি বের করে ও.সি সাহেবের হাতে দিলাম। ওখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে যে, একজন সাবালিকা হিসেবে ফারিয়া তার নিজের ইচ্ছায় ফয়সালকে বিয়ে করেছে। এরপর ব্যাগ থেকে আমার ভিডিও ক্যামেরা বের করে ফারিয়া এবং ফয়সালের একটা ভিডিও দেখালাম যেখানে তারা দুইজনেই কাজী অফিসে বসে তাদের নিজের ইচ্ছাতেই যে বিবাহ হয়েছে, সেটা বলছে। এরপর ইসলামী আইন মোতাবেক তাদের বিয়ের ডকুমেন্টের একটা কপিও ও.সি সাহেবের হাতে দিয়ে দিলাম।

পুলিশ কমিশনার ইয়াহিয়া খান ওরফে ফারিয়ার বাবা চিৎকার করে আঙুল তুলে বললেন, "ওইসব বানোয়াট। জাল। আমি অর্ডার করছি। ওকে এখুনি অ্যারেস্ট করুন!"

থানায় পিন পতন নিরবতা।

হঠাৎ নাটকীয়তা চূড়ান্তে পৌঁছালো। সবাই তাকিয়ে দেখলাম, ফারিয়া আর ফয়সাল থানার গেট দিয়ে ঢুকছে।

এরপর আর কাউকে কিছু বলতে হলোনা। ফারিয়াই যা বলার বললো। আমি নির্দোশ প্রমাণিত হলাম।

খানিক নিরবতা শেষে ও.সি সাহেব মুখ খুললেন। ফারিয়ার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "স্যরি স্যার, এই কেসটা আপনি উইথড্র করুন প্লিজ।"

থানার ওই ঘটনাটা যে ঘটবে, আমি আগে থেকেই সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তাই আগে থেকেই নিজেকে বাঁচানোর জন্যে আমি সব প্রমাণাদি সাথে রেখে দিয়েছিলাম। আর পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ফয়সালদেরকে ঢাকায় ফিরে এসে কোন একটা হোটেলে থাকতে বলে দিয়েছিলাম আগেই। এরপর ও.সি সাহেবের সাথে ধানমণ্ডি থানায় যাবার সময় জাস্ট একটা টেক্সট ছেড়ে দিয়েছিলাম ওদের ফোনে।

এর বছর দু'য়েক পরের ঘটনা। ভার্সিটি পাশ করে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ফয়সালেরও দেখতে দেখতে একটা ভালো জব হয়ে গেল। ফারিয়া-ফয়সালের ঘর আলো করে একটা ফুটফুটে ছেলে এলো। এই দুইটা বছর ওদের ওপর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গিয়েছে। কিন্তু সব ঝড়ের শেষেই বৃষ্টি নামে, শান্তি আসে।

তারপরের ঘটনা আমি আসলে আর জানিনা। কারণ ঠিক ওই সময়টাতেই দেশ ছাড়ার পর ফয়সালদের সাথে দুই-একটা চিঠি চালাচালি ছাড়া আর যোগাযোগটা রাখা হয়নি।

এই পর্যন্ত বলে আমি থামলাম। সামনে ট্রাফিক। গাড়ি স্লো করে দিলাম।

"উফফ! কী সাংঘাতিক একটা ব্যাপার বলতো! আর একটু হলেইতো তোমাকে জেলে যেতে হতো!" আড়চোখে দেখলাম, রোদেলা রীতিমতো ঘামছে।

আমি খুব সাবধানে সামনের গাড়িটার স্পীড ফলো করতে করতে বললাম, "রোদেলা বেগম, তুমি কী জানো যে, দাবা খেলায় আমি কখনো আমার ঘোড়াকে আগে চালিনা? আর তাস খেলায়? আমার হাতে টেক্কা থাকলেও সেটা কাক-পক্ষীতেও টের পাবেনা।"
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৭:৩৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ট্রাম্প ভাইয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল টিমের সদস্য এর মধ্যে এই তিন জন সদস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিখেছেন অতনু কুমার সেন , ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮

প্রথম জন হলো: জেডি ভান্স, উনি মেবি ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। ভদ্রলোকের বউ আবার ইন্ডিয়ান হিন্দু। ওনার নাম উষা ভান্স। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট।

দ্বিতীয় জন হলো বিবেক রামাস্বামী। এই ভদ্রলোক আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসল 'আয়না ঘর' থাকতে রেপ্লিকা 'আয়না ঘর ' তৈরির প্রয়োজন নেই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮


স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ৫ই আগস্ট সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন আমলে অসংখ্য মানুষ কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯






ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×