"আমাকে একটা বাচ্চা দেবে? প্লিজ?" আমার হাত দু'টো ধরে আকুলকণ্ঠে কথাটা বললো রোদেলা। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম করুণ এক মিনতি।
আমি কিছুটা বিব্রত ভঙ্গিতে ভ্রু দু'টো কুঁচকে মাথাটা নিচু করে রইলাম।
"আসলে রোদেলা ..."
"না, আমি কোন কথাই শুনবোনা। আমি বাচ্চা নেবোই। আর নেবো কেবল তোমার থেকেই।" রোদেলার কণ্ঠ উত্তেজিত।
"একটা বাচ্চা পালার কত খরচ তুমি জানো? বাচ্চাটা নিলে সেই খরচ পোষাতে পারবে? নাকি বাচ্চাটাকে কষ্ট দেবে? অযত্নে বড় করবে? খামাখা তুমি পাগলামি করছো রোদেলা। প্লিজ ট্রাই টু আনডার্সট্যান্ড।" খানিকটা বিষন্ন কণ্ঠে ওকে কথাগুলো বললাম।
"প্রমিজ। তোমার কসম লাগে। আমি বাচ্চা নিয়ে কোন হেলাফেলা করবোনা। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি। বুকের ভেতরে আগলে রেখে বড় করবো। প্লিজ! আর না করোনা। আজকেই বাচ্চাটা নিতে চাই আমি।"
গম্ভীর কণ্ঠে বললাম, "বুকের ভেতরে আগলে রেখে ওকে বড় করতে হবেনা। ঠিকমতো নিয়মকানুন আর শাষণের মধ্যে বড় করো, তাতেই চলবে।
ঠিক আছে। মাসখানেক সময় দাও আমাকে।" দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা। "কিন্তু স্পষ্ট জানিয়ে রাখছি, বাচ্চাটার কিছু হলে আমি কিন্তু তোমাকে কোনদিন ক্ষমা করবোনা রোদেলা।"
এডমন্টন সিটির সাউথ অ্যানিমেল হাসপাতালের ভিজিটর'স ওয়েটিংরুমে বসে আছি আমি আর রোদেলা।
আমার চার বছরের আদরের কুকুর 'লেপার্ড' বাচ্চা দিয়েছে। মা এবং চারটে বাচ্চার সবগুলোই সুস্থ্য আছে। ঠিক এই মুহূর্তে আমি আমার খুশী ধরে রাখতে পারছিনা। কী যে প্রচণ্ড এক আনন্দ হচ্ছে!
গত পরশু থেকেই লেপার্ডের শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। তাই আজ পশুচিকিৎসক ডা: ম্যাথিউকে দেখাতে নিয়ে এসেছিলাম। আর আসার পরপরেই আমার ছোট্ট লেপার্ড মা হয়েছে। এই সেদিনই না ওকে একটা অ্যাডপশন সেন্টার থেকে তুলে নিয়ে এলাম! কী মায়া মায়া চেহারা। বাসায় আসার দু'দিনের মাথায়ই আমার চরম ভক্ত হয়ে গেল।
আর আজ সে চার বাচ্চার মা?! ভাবতেই কেমন যেন লাগছে! বাচ্চাগুলোকে একবার উঁকি দিয়ে দেখে এসেছি। লেপার্ডের বাচ্চাগুলো একেবারে কুচকুচে কালো। জাত 'রটওয়েলার' হয়েছে।
রোদেলা বেগমও পেছন পেছন এসেছে আমার। এখন মশার ভনভন শব্দের মতো আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছে ওকে যেন চারটের থেকে একটা বাচ্চা দিয়ে দেই। লেপার্ডের বাচ্চা হবার মতো ইম্পর্ট্যান্ট একটা সিচুয়েশনে রোদেলা বেগমের কুকুর পালার শখ মনে হলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। রোদেলার মতো একটা যন্ত্রণাদায়ক প্রাণী আসলেই মাঝে মাঝে বিরক্তির উদ্রেক করে। গার্লফ্রেণ্ড মানেই পেইন।
আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হেসে রোদেলা বললো, "জানো, বাচ্চাগুলো এ্যাত্ত এ্যাত্ত কিউটি পাই হয়েছে!"
"থাক! আমাকে আর ভজাতে হবেনা। বললামইতো ওখান থেকে একটা বাচ্চা দেবো। আর হ্যাঁ, সত্যিই বাচ্চাগুলো দারুণ হয়েছে। বিশেষ করে গায়ের চামড়াগুলো কেমন শাইন করছে। আর পায়ের থাবাগুলো দারুণ হয়েছে সব ক'টার! দেখেছো?"
"এহ! তোমার কুকুর বলে সব দারুণ? না? পৃথিবীতে সব প্রাণীর বাচ্চাই কিন্তু কিউট।"
"মানতে পারলামনা। স্যরি।" আমি ঠোঁট দু'টোকে বাঁকিয়ে মাথা নাড়লাম। "সাপের বাচ্চা দেখেছ? দেখতে জঘন্য। আর ব্যাঙের বাচ্চা? আরও কদাকার। আর কুমিরের বাচ্চার কথা না-ই বা বললাম।"
"কিন্তু মানুষের বাচ্চা?" অনেকটা বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলো রোদেলা।
"ওয়েল, মানুষের বাচ্চা চেহারায় দেখতে সুন্দর হলেই হলোনা রোদেলা বেগম! কিছু বান্দর পোলাপাইন ছোট থেকেই ইঁচড়ে পাকা হয়ে যায়। ওইগুলারে দেখলে মনে হয় দিন-রাত জুতাই।"
"ছি: ছি: ছি:! তোমার মতো এমন ভদ্রলোকের মুখে এসব কথা মানায়না।" রোদেলা যেন সুযোগ পেয়ে আমাকে ইনসাল্ট করতে এতটুকু কার্পণ্য করলোনা। "মানুষের বাচ্চা নিয়ে কী এমন খারাপ এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে তোমার? শুনি একটু?"
"উমমম...শুনতে চাও? আচ্ছা তাহলে বলছি একটা ঘটনা।
বাসাবোর ফরিদভাইকে মনে আছে তোমার? আরে, ওই যে, বাসাবো টেম্পু স্ট্যাণ্ড-এর সাথে লাগানো যে বাড়িটায় থাকতেন উনারা? উনারা মানে উনি আর উনার বউ মলি ভাবী। আমার কিন্তু খুব ক্লোজ বড়ভাই আর ভাবী উনারা। সেই ফরিদভাই বাবা হবার পর একবার দাওয়াত দিয়েছিলেন। ব্যাস্ততার জন্য যাওয়া হয় নাই।
উনার পিচ্চি ছেলেটার চতুর্থ বার্থডেতে না গিয়ে পারলামনা। কারণ না গেলে ভাবী মাইণ্ড করতেন ফর শিওর। ওইদিন গিয়েতো আমার অবস্থা পুরাই হালুয়া টাইট।"
"কেন কেন?" রোদেলার চোখে কৌতুক।
"বলছি শোন। ফরিদ ভাইয়ের ছেলের নাম ফাইজান। ছোটখাট গাট্টা গোট্টা শরীর। জন্মদিন উপলক্ষে আমি তার জন্যে বেশ বড় সাইজের একটা বন্দুক নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই বন্দুক পেয়ে সে খুশীতে আত্মহারা হয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে আমাকে পিটানো শুরু করলো। মনে হলো, আমার কদু সাইজের ভুড়িটাকে ওই বন্দুকের নল দিয়ে গুতিয়ে ফুটা না করে সে ক্ষ্যান্ত হবেনা। এটাই যেন তার পৃথিবীর সবচাইতে প্রিয় খেলা। এরপর আমার কোলে চড়ে বসে তার শক্তিশালী গাট্টাগোট্টা বাম হাত দিয়ে কষে আমার ডান গালে এমন এক চড় লাগালো যে আমার মাইনাস ফাইভ পাওয়ারের চশমাটা মুহূর্তের মধ্যেই দুমড়ে মুচড়ে কোথায় যেন উড়ে চলে গেল।
বিশ্বাস করো রোদেলা। আমি পুরাই বেকুব। কী করবো বুঝতে পারছিনা। গালে চড় খাওয়ার জ্বালায় আমি অস্থির। এমন সময় দেখি ভাবী এলেন। এসে আহ্লাদে গদগদ হয়ে বললেন, "আমার সোনা জাদু, মানিক জাদু, ছি: এত জোড়ে এমন করে কাউকে মারতে হয়? আঙ্কেল ব্যাথা পাবেনতো! আঙ্কেল তোমার জন্যে কত্তগুলা চকলেট নিয়ে এসেছেন, দেখেছো? আসো আমার রাজপুত্র। কোলে আসো। দুধটা খেয়ে নাও! একটু পরে আমরা কেক কাটবো!
পিচ্চি পোলায় কথা না বাড়িয়ে দুধের গ্লাস নিয়ে এসে সোজা আমার মাথায় ঢেলে দিল। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা, এই ছেলের সমস্যা কোথায়? তার সব আক্রোশ আমার উপরেই কেন? হোয়াই? হোয়াটস রং?
ফরিদ ভাই এসে বললেন, আহা, আঙ্কেলের মাথাটা ভিজে গিয়েছে। এখন একটু টাওয়েল দিয়ে মুছে দাও সোনামানিক!
আমি তাকে আর সেই সুযোগ দিলামনা। আস্তে করে সরে গিয়ে পরবর্তী মাইরগুলো থেকে আত্মরক্ষা করলাম। ওইদিন কোনমতে প্রাণ নিয়ে ওই বাসা থেকে বের হলাম।
এরপর ব্যস্ততার জন্যে কিছুদিন আর ফরিদভাইদের সাথে তেমন যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি।
হঠাৎ একদিন ফরিদভাইয়ের ফোন। আমার হাতের কাচ্চি বিরিয়ানী তার খুব প্রিয়। তিনি জানালেন, অফিস থেকে সোজা আমার বাসায় চলে আসছেন। আর ভাবীদেরকে আমি যেন কষ্ট করে একটু গিয়ে আমার বাসায় নিয়ে আসি। না হলে অফিস শেষে উনি আবার বাসায় গিয়ে ভাবীদেরকে নিয়ে আমার বাসায় আসতে আসতে বেশি রাত হয়ে যাবে।
কাচ্চির এন্তজাম করে ভাবীদেরকে নিয়ে আসতে গেলাম।
কিন্তু গণ্ডগোলটা বাজালো পিচ্চিটা। সে কোনমতেই আমার বাসায় আসবেনা। সে কি চিৎকার! মা রে মা! ওর ওই চিৎকারে এলাকা পুরাই কাঁপাকাঁপি।
অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভাবী আর পিচ্চিটাকে নিয়ে যখন বাসে উঠতে যাবো, ঠিক তখনই সে মাটিতে শুয়ে একেবারে গড়াগড়ি করে অশ্রাব্যভাষায় আমাকে গালাগালী করা শুরু করলো। তার কথা একটাই। সে কোনমতেই আমার বাসায় যাবেনা।
ভালো কথা। যাবিনা? মনে মনে 'তুই যাবি', 'তোর ঘাড়ে যাবে' বলতে বলতে নেক্সট বাস আসতেই পিচ্চিটাকে শক্ত করে ধরে কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে ভাবীসহ বাসে উঠে পড়লাম।
বাসে উঠে বসার পর সে আবার শান্তশিষ্ট একটা বাচ্চা হয়ে গেল। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আমিও হাসি মুখে বললাম, "বাবু, কেমন আছ? তোমার নাম যেন কী? বলো প্লিজ?" নামটা আসলেই মনে পড়ছিলোনা তখন।
ভাবীও পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য বললেন, "সোনামানিক, তোমার নামটা বলো আঙ্কেলকে!"
পিচ্চি পোলায় কটমট করে আমার দিকে তাকায় বলে, "খবরদার! আর একবার বাবু ডাকবিতো থাবরায়া তোর চাপার দাঁত ছুটায়া ফেলামু! আমার নাম বদু! বদু, বদু, বদু! এখন থেইকা আমারে বদু বইলা ডাকবি! মনে থাকবেতো?
সাড়ে চারবছরের এই পিচ্চি পোলায় কয় কী? ওর ওই কথাগুলো বুঝতেও আমার মনে হয় দশ সেকেণ্ড সময় লাগলো। রেগে গেলে আমার দুই কান গরম হয়ে যায়। আমি বুঝলাম আমার কান গরম হচ্ছে। আর ভাবী? উনাকে দেখলাম নির্বিকারভাবে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন। যেন বাইরের সৌন্দর্য্য না দেখতে পেলে তিনি মারা যাচ্ছেন!
বাসায় পৌঁছার পর শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আমার পুরো বাসাটা আমি সাজিয়েছিলাম অ্যান্টিক দিয়ে। দুষ্প্রাপ্য সব জিনিসপত্র। চোখের নিমিষে বদুমিঞা সব দুর্লভ অ্যান্টিক পদার্থগুলো ভাঙতে শুরু করলো। আমি হাসবো? নাকি কাঁদবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলামনা। শুধু মনে হচ্ছিল এই বিচ্ছুটাকে থামাতে হবে যে কোন উপায়ে।
ফরিদভাই আর ভাবী টিভি সিরিয়ালে মশগুল। ভাইজান একবার শুধু বদুকে বললেন, "আব্বুজান, বাবা টিভি দেখছি। একটু আস্তে শব্দ করো প্লিজ!" আর সাথেসাথে ভাবী ভাইকে কড়া একটা ধমক দিয়ে বললেন, "তোমারও কানটা গিয়েছে। টিভি'র সাউণ্ডটা জোর করে নিলেই পারো!"
সেদিন বদুরা আমার বাসায় ছিল প্রায় দু ঘন্টার মতো। ওরা বের হয়ে যাবার পর আরও প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে গেল বিধ্বস্ত বাসাটা পরিষ্কার করতে। আর আমার সাধের অ্যান্টিক? একটাও তার অবশিষ্ট নেই। দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দুমড়ে মুচড়ে একাকার। যাবার সময় বদু মিয়া একটা পেপারওয়েট দিয়ে আমার সাধের পঞ্চান্ন ইঞ্চি টিভিটার বিগ স্ক্রিণটাকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে রেখে দিয়ে গেল।
আমি থামলাম। রোদেলার দিকে তাকিয়ে দেখি সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। "ভারী বদমাইশ বাচ্চাতো! কষে একটা চড় লাগালেনা কেন?"
"রোদেলা, ভাই ভাবীর সামনে তাদের বাচ্চাকে মারবো? তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? একটা কড়া কথা বললেও তো তারা মাইণ্ড করতেন, তাইনা?"
"করলে করতেন।" রোদেলা ঝামটা দিয়ে উঠলো।
"না রোদেলা। বদুকে চড় মারাটা সমাধান না। সমাধানটা আসলে কোন কথায় জানো?"
"কোথায়?"
তোমাকে যে কুকুরের বাচ্চাটা দিচ্ছি, সেটা দেবার সময় আরও একবার কথাটা মনে করিয়ে দিতে চাই তোমাকে রোদলো বেগম: "বুকের ভেতরে আগলে রেখে ওকে বড় করতে হবেনা। ঠিকমতো নিয়মকানুন আর শাষণের মধ্যে বড় করো, তাতেই চলবে।"
ফেসবুকে আমি
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৬:৩৪