রুমার পথে যাত্রা শুরু
২০ এপ্রিল, ২০১১। সায়েদাবাদ থেকে ঠিক রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিটে শ্যামলীর নন এসি বাসে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। গন্তব্য, বান্দরবান শহর। আমরা বলতে, তৌফিক জোয়ার্দার , সালেহ এবং আমি। এর আগের ট্যুরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে ভাল করেই জানি যে, ট্যুর শুরুর আগে লিস্টে অনেক মানুষই নাম লেখায়। কিন্তু রওনা দেবার সময় নানা কারণে প্রকৃত যাবার মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। এবারও এর ব্যতিক্রম হলোনা। যাবার আগে আমার থেকে যেসব মানুষের উৎসাহ বেশি ছিল, তারাই শেষ পর্যন্ত গেলনা। এতে দু'টি ব্যাপার ঘটলো। এক দুর্ধর্ষ এবং রোমহর্ষক অভিযাত্রার আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত হলো। আর, দ্বিতীয়ত: দল ছোট হয়ে যাওয়াতে আমাদের খরচ একটু বেশি পড়ে গেল।
যাই হোক, ফিরে আসি বান্দরবান হয়ে রুমার বগালেক আর কেওক্রাডং-এর অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনীতে। ২১ এপ্রিল, ২০১১। সকাল সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিটে বান্দরবান শহরে পৌঁছলাম আমরা। ট্রাফিক মোড়ের কাছে ফোর স্টার হোটেলের নিচে ঢাকা হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে রিক্সাযোগে রওনা দিলাম রুমা বাস স্ট্যাণ্ডে। সেখান থেকে দরদাম করে ২৫০০ টাকা দিয়ে রিজার্ভ চান্দের গাড়িতে (জীপ গাড়ি) আমাদের যাত্রা শুরু হলো রুমার কাইক্ষ্যংঝিরি হয়ে ১ নং ঘাটের উদ্দেশ্যে। তখন সকাল প্রায় আটটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ড্রাইভার জসিম। অল্পবয়সী একটা ছেলে। গাড়ি বেশ খানিকদূর যাবার পর বুঝলাম, এই ব্যাটা অপেক্ষাকৃত নতুন ড্রাইভার। কিন্তু তখন আর ফিরে আসার উপায় কোন নেই। তাই তাকে নিজেরাই সাহস এবং সঠিক ভাবে চালানোর পরামর্শ দিতে দিতে আল্লাহকে ক্রমাগত ডাকতে থাকলাম যেন জসিম সহি-সালামতে আমাদেরকে ১ নং ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
রুমা যাবার পথে পাহাড়ী রাস্তার সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। কিন্তু রাস্তা মারাত্মক খারাপ বললেই চলে। চান্দের গাড়িতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে অবস্থা পুরাই কেরোসিন আমাদের। মাথায় দু’বার বাড়ি খেলাম আমি। পথের দুধারে দেখলাম জুম চাষের জন্য বেশ কিছু পাহাড়ের গাছপালা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। যাবার পথে দুই বার গাড়ি থামাতে হলো চেক পয়েন্টে।

রুমা যাবার পথের খারাপ রাস্তা

রুমার পথের পাহাড়ী সৌন্দর্য
ঘড়ির কাটা যখন বেলা এগারোটা দশ মিনিট ছুঁই ছুঁই করছে, তখন আমরা পৌঁছলাম ১ নং ঘাটে। সেখান থেকে ২৫০ টাকা দিয়ে রিজার্ভ নৌকায় রওনা দিলাম রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে। যদিও লাইনের নৌকায় গেলে ২০ টাকা করে পড়তো। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে আমরা রিজার্ভ-ই নিলাম। জাফর আহমেদ নৌকার পাইলট অফিসার। মধ্য বয়স্ক একজন মানুষ। রোদে শরীর পুড়ে তামাটে হয়ে গিয়েছে। যে নদীর উপর দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তার নাম শংখ নদী। এই নদীতে কোন জোয়ার-ভাঁটা নেই। পানি একদমই কম। এক মানুষ সমানও হবেনা বললেই চলে। নদীর বুকে সারি সারি কাঠের তক্তা। জাফর জানালেন, এই সব গর্জন, গামারী, সেগুন জাতীয় দামী কাঠ মানুষজন নদীর উপর দিয়েই টেনে টেনে বান্দরবান পর্যন্ত নিয়ে যায়। সেখান থেকে ট্রাকে করে ঢাকায়।

১ নং ঘাট থেকেই নৌকা করে রুমা বাজার পর্যন্ত যেতে হবে

শংখ নদীর উপর কাঠের তক্তা ভেসে যাচ্ছে বান্দরবানের দিকে
হঠাৎ হালকা ধাক্কা খেয়ে নৌকা আটকে গেল। অগভীর পানির নিচের বালুতে নৌকা আটকে গিয়েছে। মাঝির কষ্ট হচ্ছিল ঠেলতে। পানিতে নামলাম আমি। তাকে একটু সাহায্য করলাম। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখছি, বর্ষার সময় বান্দরবান থেকে ১ নং ঘাট পর্যন্ত আসতে হয়না। কাইক্ষংঝিরি থেকেই ট্রলার পাওয়া যায় রুমা বাজার পর্যন্ত।

নৌকা ঠেলছে মাঝি, আনন্দে আছে তৌফিক আর সালেহ

ওই দূরে রুমা বাজার দেখা যাচ্ছে
দুপুর একটার দিকে রুমা বাজারে পৌঁছে গেলাম। তারপর সোজা ফাইভ স্টার হোটেল হিলটনে। সেখানে ১০১ নম্বর রুম নিয়েই দৌড়ালাম আল মামুন খাবার হোটেলে। পাহাড়ী গরুর সাথে মোটা চালের ভাত, ডাল আর গরুর হাড়ের স্পেশাল একটা সব্জি দিয়ে কব্জি ডুবিয়ে তৃপ্তিসহকারে ভাত খেলাম তিনজন। তারপর ১.৪৫ মিনিটে আবার ঘাটে গিয়ে রিজার্ভ নৌকায় উঠে পড়লাম। এবারের গন্তব্য রিজুক ঝর্ণা। মাঝির নাম চিত্ত রঞ্জন দাস।

রুমা বাজার থেকে তোলা ছবি
রিজুক যাবার পথের দুধারে পাহাড়। পাহাড়ী ছোট ছেলে মেয়েরা শংখ নদীতে সাঁতার কেটে খেলায় মত্ত। পাহাড়ের গায়ে দেখলাম তামাক পাতার গাছ। মাঝিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এখানে তামাক চাষের প্রচলনটা বেশি। স্থানীয়ভাবে’ 'গোল্ডলীফের পাতা'’ নামে ব্যাপক পরিচিত। তামাক পাতা পরে কেটে নিয়ে রৌদ্রে শুকিয়ে একটি ঘরে এগুলোর নিচে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়।

রিজুক যাবার পথের সৌন্দর্য
রিজুক পৌঁছলাম বেলা তিনটা পঁয়তাল্লিশ এর দিকে। উঁচু ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজলাম আমরা একে একে। এখন পানি কম । তারপরেও সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। সবাই ছবি তুললাম মন ভরে। তারপর আবার রওনা দিলাম রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে। এবার সময় কিছুটা কম লাগলো। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম রুমা বাজারে।

রিজুকের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি আমরা

রিজুক ঝর্ণা আমাদের কাছেই

একদম কাছ থেকে রিজুক ঝর্ণা
ফেরার পর গাইডের খোঁজ নিলাম। রুমাতে মোট ১৬ জন সরকারী নথিভুক্ত গাইড রয়েছে যারা সিরিয়ালে একের পর এক ট্যুরিস্টদের জন্য নির্ধারিত থাকে। এন্ট্রি ফরম বাবদ পঞ্চাশ টাকা এবং দৈনিক ৪০০ টাকা করে গাইডকে দিতে হবে। সাথে তার খাওয়া দাওয়া এবং আনুসঙ্গিক খরচ আমাদেরকেই বহন করতে হবে। সিরিয়ালে থাকা জামালকে গাইড হিসেবে পেলাম আমরা।
স্থানীয় আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট সংক্রান্ত কাজ গুলোতে জামালই আমাদের সহযোগীতা করলো। তাকে জানালাম যে, পরদিন আমাদের প্ল্যান হলো ট্র্যাকিং করে বগা লেক পর্যন্ত যাওয়া। সুতরাং পরের দিনের জন্য বাজার থেকে কিনে নিলাম বিস্কুট, পানি আর ১৮০ টাকা করে পাহাড়ে ওঠার বেল্টসহ স্যাণ্ডেল। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখছি, আমাদের প্ল্যান ছিল ২৩ এপ্রিল আমরা বগালেক থেকে রুমাতে ফিরবো চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে। তাই ওই দিন রাতেই লাইনম্যান বক্করের সাথে ২০০০ টাকায় একটা গাড়ি রিজার্ভ করে ফেললাম যেটা ২৩ তারিখ সকাল এগারোটা নাগাদ বগাতে গিয়ে আমাদেরকে রুমা বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসবে। গাড়ির ব্যবস্থা করে রাতের খাবার আল মামুনে খেয়েই শরীরে ভাল করে ওডোমোস মেখে চলে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
নীলিমা যেখানে মিশেছে নীলে: বান্দরবানের গহীনে - পর্ব ২
নীলিমা যেখানে মিশেছে নীলে: বান্দরবানের গহীনে - পর্ব ৩
নীলিমা যেখানে মিশেছে নীলে: বান্দরবানের গহীনে - ছবি ব্লগ