আগেই বলে রাখি- আমার এই লেখায় জামায়াত-শিবিরকে কোনভাবেই সমর্থন করা হয় নাই। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমিও চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক- জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ করা হোক। আরও চাই, যারা জামায়াত-শিবির করেন কিন্তু যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত নন এবং বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন- তারা রাজনীতি করতে হলে নতুন কোন দল গঠন করেন। কারণ, জামায়াতে ইসলামী একটি অশুভ দল যারা আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছিল এবং একাত্তরে অনেক নৃশংস কাজের সাথে জড়িত ছিল। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হল মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত যারা দেশপ্রেমের নামে ভন্ডামি করেন, মুক্তিযুদ্ধকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আখের গোছান, যাদের চরিত্রে কপটতা বিদ্যমান- তাদের কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করা।
আগে জানতাম-মানুষ জনপ্রিয় বা বিখ্যাত হয় দুই পদ্ধতিতে- সু অথবা কু পদ্ধতি। সুপদ্ধতি হল ভাল কাজের মাধ্যমে সুখ্যাতি অর্জন করা। আর কুপদ্ধতি হল খারাপ কাজ করে কুখ্যাত হওয়া। আশাকরি এই দুই পদ্ধতির উদাহরণ দেয়া লাগবে না, সবাই সেটা জানেন। ইদানিং নতুন আরেকটা পদ্ধতি আবিস্কার হয়েছে- সেটা হল ভন্ডামির মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন। এই খ্যাতি অর্জনের জন্য কোন ভাল কাজের দরকার নাই, আবার কোন খারাপ কাজেরও দরকার নাই। শুধু এমন কিছু একটা করা যেটা দিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ সম্ভব। যেমন- 'কষ্টে আছি'- আইজুদ্দিন বা 'অপেক্ষায়'- নাজির নামে দুই ব্যক্তি স্রেফ দেয়াল লিখন করে মোটামুটি ঢাকা শহরবাসীর কাছে বিখ্যাত। তেমনি ধরুন, আমি যদি আমার ব্যক্তিগত গাড়ির উপর বড় করে একটা সাইনবোর্ড লাগালাম ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’। তারপর ঢাকা শহরে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরলাম। মাঝে মাঝে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়ালাম। মাসখানেকের মধ্যে মিডিয়ায় আমার নাম প্রচার হবে, আমি সাংবাদিকদের সামনে পেলে বিশাল বিশাল জ্বালাময়ী ভাষণ দিব যাতে গলার রগ ফুলে ওঠে- যেভাবে মতিয়া চৌধুরী ভাষণ দেন। টিভিতে টক শোতে আমাকে আমন্ত্রণ জানাবে- সেখানেও বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলব। সারাদেশে ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে- কারও আওয়ামী জমানায় মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু সবচেয়ে ভাল দামে বিকোয়। তারপর আমি বিশিষ্ট দেশপ্রেমিক- মাত্র কয়েক হাজার টাকার অকটেনই আমার বিনিয়োগ।
আমাদের মুহম্মদ জাফর ইকবাল তেমনই একজন দেশপ্রেমিক। ওনার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে গেলে কোন সদুত্তর আজ পর্যন্ত পাই নাই। উনি কি এ পি জে আব্দুল কালামের মত দেশবরেণ্য কোন পদার্থবিজ্ঞানী, নাকি জে কে রাউলিংয়ের মত কোন বিখ্যাত কল্প উপন্যাস লেখক, নাকি কুলদীপ নায়ারের মত বিশিষ্ট কলামলেখক, নাকি আসমা জাহাঙ্গীরের মত কোন সাহসী মানবাধিকার কর্মী। ঠিক কোন বিবেচনায় মুহম্মদ জাফর ইকবাল তরুন প্রজন্মের আইকন- সেটা আজও বুঝে উঠতে পারি নাই। তার একমাত্র যোগ্যতা- উনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান। ভাল কথা- তার জন্য তিনি নিশ্চয়ই নিয়মিত সভা, সমাবেশ, পদযাত্রা, প্রতীকী অনশন ইত্যাদি কাজে জড়িত আছেন। যেমন দেশের তেল-গ্যাস রক্ষায় শ্রদ্ধেয় আনু মহম্মদ সারা দেশে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করছেন, এমনকি পুলিশের হামলায় রক্তাক্ত হচ্ছেন। যেমন অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন যাচ্ছেন সবার সামনে থেকে। যেভাবে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ড. ইউনুস দেশে ও দেশের বাইরে নিয়মিত কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। যেভাবে দেশের পরিবেশ রক্ষায় বেলার সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
কিন্তু আমি অবাক বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে দেখি- আমাদের এই মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাহেবের সমস্ত দেশপ্রেম স্রেফ পত্রিকার কলাম ও নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমার জানামতে উনি ২০ বছর আমেরিকাতে ছিলেন, কিন্তু স্বউদ্যোগে দেশে বা দেশের বাইর কোনদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোন সভা বা সমাবেশের আয়োজন করেন নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তার কোন নির্দিষ্ট প্রস্তাবনাও নেই। বরং দুই চারটা গালভরা অতিরঞ্জিত বুলি তিনি নিয়মিত পত্রিকার কলামে বা সভা-সমাবেশে অতিথি হয়ে আওড়ে যাচ্ছেন। উপরন্তু তার লেখায় বা কথায় নিরপেক্ষ দেশপ্রেমের কোন লক্ষণ নেই- তিনি একটি রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের মত শুধু বিরোধীদের দুর্নাম রটনায় ওস্তাদ। নিজের দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন উনি উটপাখির মত বালিতে মুখ গুঁজে থাকেন। আর যখন অপর দলটি ক্ষমতায় থাকে তখন ওনার কলম চলে বিদ্যুৎ গতিতে। তখন তার একেকটা কলাম পড়লে মনে হয় দেশ যেকোন দিন ধ্বংস হয়ে যাবে! অথচ তাঁর প্রিয় দলটির নেতাদের মত তিনিও যে তথ্যটি চেপে যান- শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাই ওরফে সিদ্দিকুর রহমানকে গ্রেফতার করেছিল বিএনপি সরকার এবং বিএনপির সেই মেয়াদেই তাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন বর্তমান রাষ্ট্রপতির মত লক্ষীপুরের খুনী বিপ্লবের ফাঁসির আদেশ প্রত্যাহার করেন নাই বা বিকাশের মত ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে ছেড়ে দেন নাই। বিএনপি যে জেএমবি তথা জঙ্গী নির্মুলে কোন ছাড় দেয় নাই তা সে সময় র্যা বের দুর্ধর্ষ অভিযানেই প্রমাণিত হয়। অথচ এই মুহম্মদ জাফর ইকবালরা এখনও বিএনপিকে জঙ্গীদের সহায়তাকারী হিসেবে মিথ্যাচার করে।
গত ৭ ডিসেম্বর মুহম্মদ জাফর ইকবাল ‘তোমরা যারা শিবির করো’ শিরোনামে একটি কলাম লিখলেন। তার অন্ধভক্তরা খুশিতে লাফিয়ে উঠল- কিন্তু একবার চিন্তা করে দেখল না এই লেখার উদ্দেশ্য কী। লেখার ভাষায় আমার কাছে মনে হয়েছে এই লোকটি কোন কারণে ভয় পেয়েছেন- সম্ভবত আওয়ামী লীগ সরকার যে জামায়াত-শিবির নির্মুল করতে পারছে না সেটা তিনি টের পেয়েছেন। ফলে যে শিবির কর্মীদের চিরকাল তিনি ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন- তাদের কেন হঠাৎ নসিহত করতে যাবেন। সময়ের অভাবে ব্লগে সেটা লিখতে পারিনি। তবে গতকাল ২০ ডিসেম্বর তিনি ছাত্রলীগের বিপক্ষে আরকটা কলাম ‘বিশ্বজিতের লাল শার্ট’ লিখে আমার সেই ধারণাকে বদ্ধমূল করেছেন।
অর্থাৎ এই লোকটি জামায়াত-শিবিরকে ভয় পাচ্ছেন, ভয় পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর। নয়ত গত ৪ বছর ধরে যখন ছাত্রলীগ প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আছে- যখন তাদের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ছাত্র আবু বকর কিংবা জাহাঙ্গীরনগরের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়েরের মৃত্যু হয়- তখন শিক্ষক জাফর ইকবাল একবারও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কলম ধরেননি- আজ কেন বিশ্বজিতের মৃত্যুতে তাকে পবিত্র কোরআনের আয়াত ব্যবহার করে কলাম লিখতে হচ্ছে?
এই লোকটির প্রতিটি লেখাই স্ববিরোধিতায় ভরপুর। 'তোমরা যারা শিবির কর' শিরোনামে লেখাটার কথাই ধরা যাক। এখানে লিখেছেন-
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই দীর্ঘ জীবনে আমি সবচেয়ে বিচিত্র, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য বিষয় কী দেখেছি। আমি এতটুকু দ্বিধা না করে বলব, সেটি হচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির। তার কারণ, যে বয়সটি হচ্ছে মাতৃভূমিকে ভালোবাসার বয়স, সেই বয়সে তারা ভালোবাসে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদের, যারা এই মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। যে বয়সে একজন তরুণের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা অনুপ্রাণিত হয় সেই মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাকারীদের দিয়ে। যে বয়সে তাদের স্বপ্ন দেখার কথা দেশের বড় বড় লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিককে নিয়ে, সেই বয়সে তারা আনুগত্য মেনে নিয়েছে সেই সব মানুষের, যারা আলবদর বাহিনী তৈরি করে একাত্তরে এই দেশের লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী আর সাংবাদিকদের হত্যা করেছে! যে বয়সে তাদের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করার কথা, ষোলোই ডিসেম্বরে স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার কথা, পয়লা বৈশাখে রাজপথে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা যে শুধু এই অবিশ্বাস্য আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে রাখে তা নয়, তারা এগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। যে বয়সে তাদের মুক্তচিন্তা শেখার কথা, গান গাওয়ার কথা, নাটক করার কথা, আদর্শ নিয়ে ভাবালুতায় ডুবে যাওয়ার কথা, সেই সময় তারা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আটকে রাখতে শেখে, সাম্প্রদায়িক হতে শেখে, ধর্মান্ধ হতে শেখে। যে বয়সে ছেলে আর মেয়ের ভেতর সহজ ভালো লাগা ভালোবাসা জন্ম নেওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা সেই অনুভূতিগুলোকে অশ্রদ্ধা করতে শেখে—সে জন্য তারা কত দূর যেতে পারে, সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি, সেই ভয়ংকর কাহিনি আমি কখনো কাউকে বলতেও পারব না!
অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন- শিবিরকর্মীরা ধর্মান্ধ এবং বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। আবার এই লেখার পরবর্তী অংশে লিখছেন-
আমার এই লেখাটি তোমরা যারা শিবির করো, তাদের জন্য। আমি জানি, এটি সম্পূর্ণ অর্থহীন একটি কাজ—আমার এই লেখাটি তোমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলবে না এবং তোমরা যারা পড়ছ তারা আমার এই লেখায় বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে এর মধ্যে নানা ধরনের যুক্তি দাঁড় করিয়েছ। শুধু তা-ই নয়, তোমাদের প্রিয় জায়গা—ইন্টারনেটে সম্ভবত এই লেখার বিরুদ্ধে বিশাল একটা প্রচারণা শুরু হবে। কিন্তু তবু আমার মনে হয়েছে, আমার এই কাজটুকু করা উচিত, তোমাদের কখনো যে সত্য কথাগুলো বলা হয়নি, আমার সেটা বলা উচিত।
শিবিরকর্মীদের প্রিয় জায়গা ইন্টারনেট!!!- মানে তারা প্রযুক্তির সাথে পরিচিত? এই লোকটার ভন্ডামির প্রমাণ এর চেয়ে কি হতে পারে! আমার দেখা শিবিরকর্মীর মধ্যে শতকরা ১ ভাগও ইন্টারনেটের ব্যবহার জানে কিনা সন্দেহ- অথচ মুহম্মদ জাফর ইকবাল কিভাবে তাদের বিনামূল্যে সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছেন!!!
এই ব্লগের এক বিখ্যাত ব্লগার ভাই ফেসবুক স্ট্যাটাসে মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার বড়ভাই হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু পরবর্তী দোয়ায় মুনাজাত ধরার ছবি দেখিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেছিলেন। ঐখানে আমি মন্তব্য করেছিলাম- মুহম্মদ জাফর ইকবাল কখনও নিজেকে নাস্তিক হিসেবে দাবী করেন নাই। আমি এখনও সেটা বিশ্বাস করি। কিন্তু এই লোকটি যখন শিবিরকর্মীদের উদাহরণ দিয়ে ইসলামের গর্হিত কাজগুলোকে স্বাভাবিক কাজ হিসেবে ধরে নিতে উৎসাহিত করেন- তখন তার কলামে পবিত্র কোরআনের আয়াত দেখলে ভন্ডামির চূড়ান্ড রূপ প্রকাশ পেয়ে যায়।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের উদ্দেশ্যে ক্ষুদ্র এই ব্লগারের একটাই কথা-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে যেমন কোন আপোষ নাই- তার চেয়ে কঠিন বিষয় হল- ইসলামে মধ্যপন্থা বা উদারপন্থা বলে কোন বিষয় নাই। মুসলিম দেশে জন্ম নিয়ে মুসলিম পরিবারের সন্তানদের আপনি ইসলামের হারাম কাজে উৎসাহিত করবেন- সেটা উচিত নয়। আপনার উদারপন্থী ইসলাম আপনার নিজের সন্তানদের উপর প্রয়োগ করেন- দয়া করে দেশের সাধারণ মুসলিম পরিবারের সন্তানদের বিপথগামী করবেন না। আপনি যদি রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া, খালি পায়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়া কিংবা ছেলেমেয়েদের প্রেমের সম্পর্ককে হালাল করার চেষ্টা করেন- তবে সেটার জন্য শুধু শিবিরকর্মীরা নয়- প্রকৃত মুসলিম যে কোন বাংলাদেশী আপনাকে ঘৃণা করবে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১০:৫৪