চাকরি করা বিষয়টা আসলে আমার সাথে যায়না। আমার হবার দরকার ছিল একজন পাকা ব্যবসায়ী। সেই ছোটবেলায় সবচেয়ে সুখি ভাবতাম বাদাম বিক্রেতাদের। ইস কি সুন্দর সারাদিন ঘুরে ঘুরে বাদাম বিক্রি করে। ঘুরে ঘুরে ভিবিন্ন জায়গা দেখতে পায় আবার ইচ্ছে হলেই বাদাম খায়। তাই ছোটবেলায় কেউ যদি জিজ্ঞেস করত বড় হয়ে কি হবে, অকপটে বলে ফেলতাম বাদাম বিক্রেতা হব। সবাই শুনে হাসত। একটু বড় হয়ে এই বাদাম বিক্রেতা হবার ইচ্ছা নিজে নিজেই চলে গেছে। ফটিকের মত দুরন্ত না হলেও আমার বন্ধু মহলে দু-একজন ফটিক ছিল সবসময়। নিজেকে একা ভাববার মত সুযোগ করে দেয়নি এই ফটিকেরা।
আর একটু বড় হয়ে ভাবতাম সাইকেল মেকার হব। সাইকেল মেকার হবার একটা বিশেষ কারণ ছিল। তখনো আমার নিজের কোন সাইকেল ছিলনা। বাসা থেকে কিছু দুরে স্টেশন রোডে একটা সাইকেলের মেকার বসত। তার কাছে ছিল প্রায় ৮-১০টা সাইকেল। আমার মত অনেকেই ৫ টাকা ঘন্টায় এই সাইকেল ভাড়া নিত। অনেক সকালে গিয়ে দাঁড়ায় থাকতে হত এই সাইকেলের জন্য। একটু দেড়ি করে ফেললেই ৮-১০ টি সাইকেলের একটিও পাওয়া যেতনা। তখন বেশ মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসতে হত। তো যাই হোক, আমার কাছে মনে হত এই সাইকেল ভাড়া খাটানোর ব্যবসাটা মন্দনা। আমি এরকম ৮-১০টি সাইকেল পেলে একটা জমজমাট ব্যবসা করতে পারতাম আর উপরি হিসেবে সারাদিন নিজের সাইকেল চালাতাম। এই হল আমার সাইকেল মেকার হতে চাওয়ার রহস্য।
একই বয়সে আমি আর একটা ব্যবসার কথা ভাবতাম। আর সেটা হচ্ছে ভিডিও গেমের ব্যবসা। বাসা ছেড়ে অনেক দূরে গিয়ে ভিডিও গেম খেলতে হত। ভিডিও গেমের দোকানে প্রচুর ভীড়। দুই টাকায় এক কয়েন। সারাদিন দুই টাকা দুই টাকা করে কত কয়েন নষ্ট হয়ে যেত তার হিসেব নেই। এই ভিডিও গেমের ব্যবসার চিন্তাটা প্রবল আকার ধারণ করল যখন দেখলাম পাড়ার মোড়ে একেবারে বাসার কাছাকাছি নতুন একটা ভিডিও গেমের দোকান চলে এসেছে। ওরা আসলে এর উপযোগিতাটা বুঝতে পারছে, কিন্তু ওদের আগে এই একই জায়গায় একটা ভিডিও গেমের দোকান নির্মাণের চিন্তা আমার ছিল। আফসোস আমার টাকা ছিলনা।
আর একটু বড় হয়ে আমার বিজনেস চিন্তা অন্য দিকে ডাইভার্ট হল। এবার মনে হল একটা ছোটখাটো ফুলের দোক দিলে মন্দ হয়না। স্কুলের পাশেই ছিল ফুলের দোকান। স্কুলে যাওয়া আসার পথে দাঁড়িয়ে দেখতাম ফুলের দোকানের ভীড়। আহারে মানুষ কত্ত ফুল কেনে। তাছাড়া পাশেই ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ক্লাশগুলোতে প্রত্যেকেই ফুল উপহার পেত। মনে হত এরকম একটা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থাকলেইতো ফুলের ব্যবসা রমরমা। কিন্তু নাহ। আমার এই ফুলের ব্যবসাটাও পরে আর করা হয়ে ওঠেনি।
এবার আমার মাথায় যে ব্যবসার চিন্তাটা এল তা বলতে পারেন ভয়ানক। টিভি ভিসিডি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা। এই ব্যবসাটা ভয়ানক কেন বা কেন এই ব্যবসাটা করার জন্য আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল তা একটু আড়াল করলাম। তবে এখনো মাঝে মাঝে মনে হয় এই ব্যবসাটা খারাপ না। তবে এই ব্যবসার কনসেপ্টকে কেন্দ্র করে আরেকটা দুর্দান্ত ব্যবসার কনসেপ্ট মাথায় আসে। কনসেপ্টটা হল সিনেমা হলের ব্যবসা। কি দুর্দান্ত কনসেপ্ট না? হায়রে মানুষ! কত্ত মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখে! ইস আমার কাছে যদি টাকা থাকত তাইলে একটা সিনেমা হল দিয়ে সারাদিন সেখানে সিনেমা দেখতাম। আর সেই সাথে বিজনেসটাও চরম হত। নাহ্, সে আশাতেও গুড়ে বালি।
এরপর আরো আরো অনেক ধরনের বিজনেসের চিন্তা আমার মাথায় আসছিল। কিন্তু টাকার অভাবে সেই চিন্তাগুলো কাজে লাগাতে পারিনি। তবে আপুর বিয়ের জন্য পাত্র খোজাখুজি শুরু হলে বাসায় সবাই বলত ব্যবসায়ী ছেলের সাথে বিয়ে দেবেনা। কেন দেবেনা? এই বিষয়ে আমি বরাবরই দ্বান্দিক অবস্থানে ছিলাম। কেন? ব্যবসায়ীরা কি মানুষ না?
যাই হোক, এখনো মনে হয় বাদাম বিক্রেতা, সাইকেল মেকার, ভিডিও গেমের দোকানদার, ফুল বিক্রেতা, টিভি-ডিভিডির ব্যবসা কিংবা সিনেমা হলের ব্যবসা করলেই বুঝি ভাল করতাম। কষ্ট করে পড়ালেখা করে এত এত ভাল-মন্দ বোঝার উপলব্ধি করতে হতনা। নাহ্! আমি ব্যবসায়ী হইনি, যা হয়েছি তা কখনো হতে চাইনি। এরকম হাত-পা বাঁধা মিডিয়া কর্মী হবার চেয়ে স্বাধীন বাদাম বিক্রেতা হলেই বোধহয় ভাল করতাম। হাসি মুখ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম আর বাদাম বিক্রি করতাম, এই বাদাম ! এই বাদাম !