
প্রথম পর্বের পর।
প্রথম পর্ব
..............................
মা যে কিছুটা আতঙ্কিত হয়নি তা না। কেমন যেন ধীর পায়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল মা। রুনা পেছন পেছন হাঁটছে। মায়ের সতর্কতা দেখে রুনার ভয় বেড়ে গেছে। রান্নাঘরের দিক থেকে একটা টিম টিমে আলো এসে পড়ছে রুনার গায়ে। কেমন যেন ভয়টা বাড়িয়ে দিচ্ছে। রুনার মা বুঝে উঠতে পারছেনা তিনি ভয় পাচ্ছেন কেন? রুনার এমন অবস্থা দেখে আসলে তিনিও আতঙ্কিত। রান্নাঘরে ঢুকেই রুনার মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুনা চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
মা: দেখো কান্ড। ভাতের হাঁড়ি ফেলে দিয়ে তার মধ্যে বিড়ালটা কি করছে!
রুনা এবার আস্তে আস্তে ছোখ খুলল।
রুনা: তুমি এই অসময়ে সব লাইট অফ করে এরকম একটা ভুতের বাড়ি বানিয়ে রেখেছো কেন?
মা: একলা আছি। কি করব। লাইট জ্বালিয়ে রাখার তো দরকার নেই। অযথা বিল...
রুনা: মা।
মা: আচ্ছা বল তোর কি হয়েছে? তুই এমন হাপাচ্ছিস কেন?
রুনা: মা, একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে।
মা: বলিস কি? কি ঘটনা?
এমন সময় রুনার মোবাইলটা বেজে ওঠে। এটা আমজাদের কল। রিংটোন এ্যাসাইন করা ছিল।
আমজাদ: আচ্ছা কোন স্লিপিং পিল আছে?
রুনা: বাড়িতে নেই। আমার ব্যাগের মধ্যে আছে।
আমজাদ: তোমার ব্যাগের মধ্যে থেকে আমার কি লাভ? ঠিক আছে আমি দেখছি।
রুনা: একটু ড্রয়ারে দেখবে। থাকতে পারে...
আমজাদ: অকে। দেখছি।
আমজাদ ফোন রেখে দিয়ে বেডরুমে ড্রয়ার খুলতে থাকে। না ড্রয়ারে কোথাও কোন স্লিপিং পিল নেই। ঘুমানোটা খুব জরুরী। কখন যে কি হয়। আগে ভাগেই স্বপ্নটা দেখে ফেললে বিপদটা কি তা বোঝা যেত। ধুরো কিছুই ভাল্লাগছেনা। আরেকবার ঘুমানোর চেষ্টা করা যাক। আমাজাদ বিছানায় ওঠে। এবার ডিমলাইটটাও অফ করে দেয়। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে চোখদুটো বন্ধ করে। ততখনাৎ একটা দৃশ্য স্বপ্নে ভাসে আমজাদের। কেউ একজন, হাতে সেই ছুড়িটা। নাহ্ .. চোখ দুটো খুলে ফেলে। কি যেন অদ্ভুত একটা বিষয় এবার তার চোখে ধরা পরেছে। না না, বাকিটা এখনি দেখতেই হবে। কে এই লোক? কি চায়? চোখ বন্ধ করে আমজাদ। কই? আর কোন দৃশ্য আসছেনা স্বপ্নে। ঘুম নেই। শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকছে সে। এপাশ ওপাশ ফিরিয়েও কোন লাভ হচ্ছেনা। ধুর, কেন যে চোখটা খুললাম, বিরবির করতে লাগল আমজাদ। শুয়ে শুয়ে স্বপ্নটা দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। কিছুতেই যখন আর ঘুম আসছেনা তখন বই পড়া যাক। এটা মাঝে মাঝে ঘুমের কাজ করে। ওয়াল কর্ণার থেকে একটা বই হাতে নেয় আমজাদ। কিছুক্ষণ পাতা ওলট পালট করে বুঝতে পারে আর ঘুম আসবেনা। বিছানা ছেড়ে ওঠে জানালার দিকে তাকায়। বাইরে দুপুর হয়ে গেছে ততক্ষনে। কিছু খাওয়া দরকার। ঘরের মধ্যেও আর ভালো লাগছে না। কতক্ষণই বা ঘরের মধ্যে থাকা যায়।
যেই ভাবা সেই কাজ। কোনরকম চুলগুলো আছড়িয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ল আমজাদ। পেছন ফিরে ঘরের দিকটা ভালো করে তাকাতে লাগল। নাহ..এমন কিছু চোখে পড়ছেনা যা সে স্বপ্নে দেখেছে। কি যে হল। সব দোষ রুনার। কেন যে স্বপ্নটা শেষ হবার আগেই ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিল। আচ্ছা, রুনার কি খবর? অনেক্ষন রুনার কোন খবর নেয়া হয়নি। নাহ্ মেয়েটা হয়তো ঘুমোচ্ছে। এখন ডিস্টার্ব করা ঠিক হবেনা। সামনের দিকে এগিয়ে যায় আমজাদ। সূর্য্য তখন মধ্য গগন পেরিয়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছে।
রুনা আর তার মা মিলে গল্প করছিল।
রুনা: মা চা খাবো। মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে।
মা: দাড়া আমি বানিয়ে আনছি।
রুনা: না মা থাক আমিই বানিয়ে আনছি। তুমি সারাদিন অনেক কাজ করেছো।
রুনা দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। রান্না ঘরে ঢুকে চায়ের জন্য কিছু একটা খুঁজতে যাচ্ছিল হঠাৎ চোখটা চলে যায় উপরের তাকে রাখা চকচকে ছুড়িটার দিকে। ছুড়িটা কেমন যেন নড়ছে। নাহ! বাইরে কোন বাতাস নেই। তাহলে ছুড়িটা নড়ছে কেন? মা বলে একটা বিকট চিৎকার দেয় রুনা। মা ছুটে যায় রান্না ঘরে।
মা: কিরে কি হয়েছে?
রুনা: ঐ যে ঐ দেখ, ঐ ছুড়িটা। ওটা নড়ছে।
মা: তাইতো। আরতো কিছু নড়ছেনা।
রুনা প্রচন্ড জোড়ে একটা চিৎকার করে ওঠে।
রুনা: মা রক্ত।
মা মেঝের দিকে তাকায়, টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। রক্তের ¯্রােতটা কোন দিক থেকে তা বোঝার চেষ্টা করছে রুনা। এটা টেবিল বেয়ে পড়ছে। নাহ্ ! আজতো কোন মুরগী কাটা হয়নি, একা একাই বলছে মা। সাহস করে কাছে এগিয়ে গেল রুনা। নাহ রক্তের কোন উৎস নেই। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠার শব্দে ভয় পেয়ে গেল রুনা। তারপর মা ও রুনা দুজনে রান্নাঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে এল।
রুনা: মা তুমি রান্নাঘরে তালা লাগাও। আমি ফোনটা রিসিভ করছি।
ফোনের কাছে যেতে না যেতেই ফোনটা কেটে গেল। নাহ, নাম্বারটা পরিচিত নয়।
***
আমজাদ চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। টং এর মত যে বেঞ্চিটাতে বসেছে তা মাঝে মাঝেই দুলছে। নতুন কেউ বসলে যেমন নড়ছে, কেউ উঠে গেলেও নড়ছে। না, বসে বসে ঠিক মত চা খাওয়া যাচ্ছেনা। উঠে দাড়ালো আমজাদ। তারপর দাঁড়িয়ে চা খেতে লাগল। সামনের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। একটা লোক আমজাদের বাসার দিকে খুব নজর দিচ্ছে। আমজাদের কেমন যেন সন্দেহ হল। চায়ের কাপটা নিয়ে একটু আড়াল হল। লোকটার দিকে নজর রাখল। একজন বোরখা পড়া মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। আমজাদের ফ্ল্যাটের ঠিক পাশের ফ্ল্যাট থেকে আসছে। লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপর একটা রিকশা নিয়ে দুজনে সামনের দিকে চলে গেল। না, এটা একটা নিছক সন্দেহ ছাড়া আর কিছুনা।
চায়ের কাঁপটা দোকানদারের কাছে দিয়ে পকেটে হাত দিল আমজাদ। তারপর পকেটের মধ্য থেকে টাকা বের করে দিল দোকানদারকে। একদৃষ্টে তাকিয়ে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল। দড়জার তালা খুলল, খুব শুনশান মনে হচ্ছে। দড়জা খোলার সাথে সাথে বেডরুমের দিকে তাকাল। না, কেউ নেই। এবার অস্তে আস্তে নিজের বিছানার উপর উঠে শুয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে একটু টায়ার্ড, ঘুমটা আসতে পারে। এটা একটা ভালো লক্ষন, মনে মনে ভাবল আমজাদ। আস্তে আস্তে ঘুম কাতুরে হয়ে যাচ্ছে। বাইরের ক্লান্তিটা অনুভব করছে আমজাদ। সচেতনভাবেই প্রতিজ্ঞা করছে এবার স্বপ্নটা শুরু হলে শেষ না করে উঠবেনা। কেউ একজন আসছে, নাহ আগের হাতটা না। কেমন যেন একটা রক্তমাখা হাত। ক্রমশ স্পস্ট হচ্ছে চেহারাটা। ঘটনাটা লিখে রাখার সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই হাতরিয়ে বেড়াচ্ছে কলমের জন্য আমজাদের হাত। ডায়েরী আর কলমে সমানে রিখে চলেছে আমজাদ।
এবার বেশ পরিস্কার লাগছে। লোকটার মাথায় একটা হ্যাট পড়া। গলায় টাই। ডান হাতের কব্জি পর্যন্ত গোটানো জামা। হাতের সামনের অংশে আঙ্গুল গুলোতে রক্ত। লোকটা কি যেন করছে। তার এগিয়ে আসাটা খুব বেশি ভয়ংকর নয়। লোকটা নিজেই হয়ত কিছুটা আপসেট। দরাম করে বসে পড়ল লোকটা। তারপর..... আমজাদের স্বপ্নটা ভেঙ্গে যেতে চাইছে কিন্তু আমজাদ খুব মনোযোগ দিয়ে স্বপ্নটা দেখার চেষ্টা করছে। ডায়েরীটাতে লিখতে লিখতেই পাশে রাখা গ্লাসটা থেকে পানি নিয়ে খেল আমজাদ। চোখদুটো বন্ধ, গা ঘামছে। আবার লিখছে আমজাদ। লোকটা বসে বসে মাটি খুড়ছে। জায়গাটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করল আমজাদ, আরে এটাতো একটা কবরস্থান।

লোকটা কবর খুঁড়ছে। হাতদিয়ে পাগলের মত মাটি সরাচ্ছে।
এরপর আমজাদ আর কন্টিনিউ করতে পারছেনা স্বপ্নটা। কিন্তু প্রচন্ড নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা আমজাদকে স্বপ্নের বাকিটা দেখার রাস্তা করে দিল। এবার অন্য একটা দৃশ্য এল আমজাদের চোখের সামনে। একদম অন্য একটি লোক রিকশায় করে যাচ্ছে। সঙ্গে একটি মেয়ে। আমজাদ খুব গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করতে লাগল তারা কারা। রিকসার পেছন পেছন যাচ্চে আমজাদের চোখ। খুব কষ্ট করে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছে সে। নাহ, কিছুতেই সামনের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। কে এই মেয়েটি, তার সাথে এই পুরুষটিই বা কে? রিকশাটা থেমে গেল হঠাৎ। মেয়েটা নামল রিকশা থেকে। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে। আরে এটাতো রুনা ! পাশের লোকটা কে? লোকটা রিকশা নিয়ে সামনের দিকে চলে গেল। আর রুনা অন্য একটি রাস্তায় হাঁটতে লাগল। আমজাদ বুঝতে পারছেনা কাকে ফলো করবে। বারবার লোকটির দিকে ফলো করতে চাইলেও তার স্বপ্ন তাকে নিয়ে যাচ্ছে রুনার দিকে। রুনা একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল হুট করে। আমজাদের স্বপ্ন রুনার পিছু পিছু যেতে চাইলেও যেতে পারছেনা। মনে হয় গলির মাথায় আটকে আছে তার স্বপ্ন। খুব চেষ্টা করছে আমজাদ। না সে এগুতে পারছেনা। বিরক্ত লাগছে আমজাদের, ধুর গলির ভিতর যাচ্ছেনা কেন?
হঠাৎ গলির ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসছে একটা লোক। আরে, এটাতো ঐ লোকটা! রক্তমাখা হাত। হাতাগুলো গোছানো একটা হ্যাট পড়া। একি! তার কোলে কার যেন লাশ। স্বপ্নের মিল খুঁজে পেয়েছে আমজাদ। এটা ঐ লোকটা, ঐ যে কবর খুঁড়ছিল। কবর খুঁড়ে লাশটা নিয়ে আসছে হয়ত। ক্রমশ সামনের দিকে আসছে। খুব পরিচিত রাগছে লাশটাকে। পোশাকটা চির চেনা। আরে, এটাতো রুনা! স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল আমজাদের।
আমজাদ নিজে নিজে প্রশ্ন করল, এটা আমি কি দেখলাম? রুনাকে একটা কল করা দরকার। টেবিলে রাখা গ্লাসটার বাকি পানিটুকু খেয়ে মোবাইলটা হাতে নিল। মোবাইলটা হাতে নিতেই অবাক হয়ে গেল আমজাদ। ৪৯টা কল। রুনা কল করেছিল আমজাদকে। নিশ্চিত কোন বিপদ হয়েছে রুনার।
সাত পাচ না ভেবে আমজাদ কর দিল রুনাকে। রুনা ফোন ধরছেনা। আবারো ফোন দিল, এবার বন্ধ দেখাচ্ছে মোবাইল।
আর কোন কথা নেই, আমজাদ বুঝতে পেরেছে কি হয়েছে। সে দেৌড়ে বেড়িয়ে গেল বাড়ি থেকে। ছটপট একটা সি এন জি নিয়ে চলে গেল রুনার বাসায়। দরজার সামনে চকচকে টাইলস এ নিজের চেহারাটা ভয়ংকর লাগছে। দড়জায় ঠেলা মেরে ভিতরে ঢুকে পড়ে আমজাদ। কেউ নেই। রুনা রুনা বলে ডাক দেয়। না রুনা নেই। সামনের ঘরটায় এগিয়ে যায়। একটি লাশ পড়ে আছে।

রক্তাক্ত দেহটা যে রুনার তা বুঝতে বাকি নেই আমজাদের। কান্না ভারাক্রান্ত শরীর নিয়ে এগিয়ে যায় আমজাদ। রুনার লাশটা কোলে তুলে নেয়। তারপর লাশটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে আমজাদ। গলির মাথায় এসে হাঁটু গেরে বসে। আমজাদের হাত রক্তাক্ত। হাতের মধ্যে কব্জিতে আঠো সাটো হয়ে আছে সেই বিদেশী ঘড়িটা। জামার হাতাগুলো কব্জি পর্যন্ত গোটানো।
হাতে তেমন সময় না থাকার জন্য খুব বাজে ভাবে গল্পটা শেষ করলাম। দু:খিত।