সুরের আকাশ আলো করে দিয়ে সে এসেছিল আমার জীবনের ক্লান্ত দিনগুলোর কোন এক নিরব মুহূর্তে । আমি এমনিতেই আনমনা হয়ে থাকি অধিকাংশ সময় । বলা বাহুল্য যে সেই মাহেন্দ্রক্ষনেও আমি ডুব সাতার দিচ্ছিলাম আমার কল্পনায় আঁকা গোলাপী রঙের সমুদ্রে । দীর্ঘক্ষন পাশাপাশি বসে থাকার পরও তাকে খেয়াল করে দেখার সময় হয়নি আমার । এভাবেই বয়ে যাচ্ছিল নিস্তরঙ্গ সময়ের স্রোতস্বিনী নদীর অববাহিকা । হঠাৎ কী হয়ে গেল আমার, যে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম তার নীল চোখের তারায় অশ্রুবিন্দু রুপে । নিজেকে সামলানো খুব কষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেদিন । জানি না কখনও স্বপ্ন দেখে কেউ সুরেশ্বর হয়েছে কিনা, তবে আমি তার নীল চোখের তারায় যে আলোর সন্ধান সেদিন পেয়েছিলাম তার উৎস এই পৃথিবীতে নয় । প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে তাকিয়েছিলাম আমি অপলক দৃষ্টিতে । তারপর কেটে গিয়েছিল ক্ষুদ্র কয়েকটা সময়ের পল । হারিয়ে গিয়েছিলাম নিজের অজান্তেই জীবনের অর্থবহ কোন মেঠোপথের কিনার ধরে । তখনও জানতাম না আমার পরিনতি এই রকম হবে ।
নিদারুন অস্বস্তি নিয়ে আমি একটা একটা করে সময়ের সুতা ছিড়ে যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম আসলে নিজেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি । আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে উদাসীন হয়ে উদ্দেশ্যহীন হাটা আর মনের সরোবরে উদ্দেশ্যহীন ডুব সাতার দেওয়া এক কথা নয় তা আমি ভালই উপলব্ধি করতে পারছিলাম । যদিও সময়ের সাথে সাথে আমাকে আরও গভীর থেকে গভীরতর যন্ত্রনার অনুভুতি দিয়ে যাচ্ছিল তবুও কী এক অস্থির অবসাদে ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে টেনে আরও গভীর সাগরে নিয়ে যাচ্ছিলাম । যেন ধ্বংসেই আমার প্রকৃত জীবন লুকিয়ে আছে । আমি বারবার ফিরে ফিরে দেখছিলাম আমার নিজের প্রতিবিম্ব ওই সঙ্কির্ন সরোবরের ঘোলা জলে । তবুও যেই জলের উৎস দুঃখের মত নীল রঙা অশ্রু সাগরে, সেই সরোবরে ডুবতেও আমার কোন আপত্তি ছিল না ।
জানি না আমাকে কেউ কোনদিন দোষি সাব্যাস্ত করে কাঠগড়ায় দাড় করানোর চেষ্টা করবে কিনা । তবে আমি নিজের বিবেচনায় কখনও অপরাধের সীমানা স্পর্শ করিনি । হাঁটা পথে আর কী চাঁদে যাওয়া যায় বলো? মায়াবী চন্দ্রিমা সর্বদায় অসীম উচ্ছাসে আমাকে ডুবিয়ে রাখতো তার অশ্রু দিয়ে । কখনও আমার মনে হয়নি যে এই অশ্রুর উৎস কোনদিন শেষ হয়ে যাবে । কারন আমি ডুব সাতার দিয়ে দেখেছিলাম সেই অতলান্ত গহ্বরের শুরুটা । যেখানে ক্রমাগত ঝরছিল স্বাধীনতার অশ্রু । আমি কখনও ভাবিনি মুক্ত বিহঙ্গ কখনও সেচ্ছায় নিজেকে খাঁচায় বন্দি করতে পারে । তবে কি আমার উপলব্ধি ভুল ছিল? নাকি শৃঙ্খলিত স্বাধীনতা-ই প্রকৃত স্বাধীনতা?
গোলাপী সাগরের ধারে বসে বসে আমি এখন নিঃসঙ্গ সুর্যাস্ত দেখি । জানি আমার মত দুর্ভাগা মানুষের কপালে চিরদিন অশ্রুও থাকে না । সুখ তো আরও অনেক পরের কথা । গোধুলীর মায়াবি আলোকে বসে বসে হিসেব করে দেখি আমি কিভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম নিজের জমানো রক্তের সাগরে । মনকে যতই বোঝাই ততই অস্থিরতা বাড়ে । কখনও কি আমার নিজের একটা অশ্রু নদী হবে না? কখনও কি কেউ আমার রক্তঝরা সাগরের ক্ষত গুলিতে ভালবাসার পরশ বুলিয়ে দেবে না? মনকে প্রবোধ দিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি । অস্তমিত সুর্যের আলোতে আজ মনে হচ্ছে যে আমার জীবনের সুর্যটাও যদি এই রকম ভাবে ডুবে যেত এখনই । তাহলে কি সে খেয়াল করে দেখতো? নাকি আমার মতই আনমনা হয়ে তার দৃষ্টি এড়িয়ে যেত অনন্ত রক্তস্রোতের ক্রমবিনাশমান ফল্গুধারা । একদিন যখন শুকিয়ে যেত রক্ত সমুদ্রের হালকা গোলাপী আভা তখনও কি তা বোধোদয় হতো না? সে তো আমার মত স্বার্থপর ছিল না কোনদিনও ।
আমার সুরের আকাশে এখন মেঘ জমেছে । গতকাল রাত্রেও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল সেই গোলাপী রঙের সমুদ্রে । আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম নীল রঙের অশ্রু বৃষ্টি কিভাবে মিশে যাচ্ছিল গোলাপী রঙের রক্ত সাগরে । আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি । তখন পুর্নিমার চাঁদ পরিপুর্ন হয়ে আসবে । আকাশটাকে বিধৌত করে দিয়ে যাবে রঙ্গীলা সুরের মায়াজালে । সেদিনই আমি নিজেকে সঁপে দেব আমার নিজ হাতে গড়া রক্তের সমুদ্রে তলে । পচিশ বছর পূর্বের এই দিনটাতেই আমি এসেছিলাম এই রঙ্গভুমিতে । আজ আমার চুড়ান্ত ইচ্ছা পুরনের দিন । ইচ্ছা-মৃত্যুর দিন ।
স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোবো
পাহাড় হয়ে মেঘের বেশে,
স্বপ্ন ছিল সাগর হবো
বনের পরে নদীর শেষে ।
স্বপ্নগুলো নিজের হাতে
ডুবিয়ে দিলাম জলের পরে,
অশ্রু ভেজা কষ্টগুলো
রইলো শুধু মনের ঘরে ।
ইচ্ছে আমার সপ্ত সুরে
বইছে এখন ঘুর্নি জলে,
পিচকারিতে মৃত্যু নিয়ে
থাকবো আমি সাগর তলে ।