এক
মাঘ মাসের প্রবল শীতের রাত।কুয়াশা ঘেরা অন্ধকারে রত্না একা বসেছিল।আকাশে চাঁদ আছে।সেই চাঁদে কুয়াসায় মিলে এক ছায়া ছায়া ঘোলাটে আলোয় ডুবে আছে চারিদিক।রত্নার গায়ে শাড়ির উপর শুধুমাত্র একটি পাতলা চাদর।সেই চাদর খুব বেশি ওম বিলিয়ে দিতে পারছে না তার তরুনী শরীরে।রত্নার বেশ শীত করছে,ঘরে ফেরা দরকার।একবছরও হয়নি তার বিয়ে হয়েছে।খড়ের ছাওনি দেয়া নতুন মাটির ঘরে সন্ধ্যাবেলা মাটির মালশায় তুলে রাখা চুলার গরম কয়লা বেশ ভাল ওম বিলাচ্ছে।এই শীতে সেই ওম ওম ঘরে,মোটা কাঁথার নীচে স্বামীর উষ্ণ আলিঙ্গনের মাঝে শুয়ে থাকাই সবচেয়ে আরামের কাজ।কিন্ত রত্নার ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না।কারন তার স্বামী এখন অন্য একজনের ঘরে কাঁথার নীচে ওম বিলানোয় ব্যস্ত।
নিজের ভাগ্য দেখে রত্নার নিজের জন্যেই আজকাল করুনা হয়।ছোটকালে তার বাপ যখন মাকে ফেলে পালিয়ে গেল তখন থেকেই সে চাচার ঘরে মানুষ।খেয়ে না খেয়ে,লাথি ঝাঁটা অপমান সয়ে সে এতবড়টা হয়েছে।মা যখন নতুন ঘর বাঁধতে গেল তখন তাকে সাথে নেয়ার খুব বেশি গরজ দেখায়নি।চাচারাও বিনা পয়সার ফাইফরমাশ খাটার লোক হিসাবে তাকে রেখে দিয়েছিল।রত্না বয়সে যখন ডাগর হলো তখন চারিদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসত দেখে তার মনে হতো এইবার বুঝি দুঃখের দিন শেষ হলো।অবশেষে বিক্রমপুর গ্রামের এই গৃহস্থবাড়িতে তার বিয়ে ঠিক হলো।প্রথমে সব ভালই ছিল কিন্ত একদিন সে ভয়ানক সত্যটা আবিষ্কার করেই ফেলল।সে অবশ্য বিয়ের পর থেকেই তার স্বামী আর তার পাশের বাড়ির বিধবা বোনকে নিয়ে নানারকম কানাঘুষা শুনে আসছিল কিন্ত বিশ্বাস করেনি।কেনই বা করবে?বয়সে মহিলা তার স্বামীর চেয়ে বড়,সম্পর্কে আপন চাচাত বোন।স্বামীর মৃত্যুর পর মহিলা বাপের ভিটাতে এসে থাকছে বহুকাল হলো।বাড়িতে বুড়া,অচল মা ছাড়া আর কেউ নেই তাই তার উপর খবরদারি করার ও কেউ নেই।রত্না আরো শুনেছিল তার স্বামীর সাথে মহিলার সম্পর্ক নাকি তার বিয়ের আগে থেকেই ছিল।তাই তো স্বামী মরার পর আর শশুড়বাড়িতে থাকেনি যদিও তারা তাকে রাখতে চেয়েছিল।রত্নার স্বামী কেরামতের টানেই নাকি সে বাপের বাড়ি ফিরেছে।
প্রথমে রত্না লোকের কথায় কান দিত না কিন্ত খেয়াল করত তার স্বামী প্রায়ই গভীর রাতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।রত্না জিগাসা করলে সে উত্ত্র দিত যে ধানের খেত দেখতে যায়।রত্না তার স্বামীর কথা বিশ্বাস করত কিন্ত সেদিন রাতে তার ঘুম আসছিল না তাই ঘরের উঠানে পাটি পেতে বসে ছিল।সেদিন শেষ রাতের দিকে পাশের বাড়ির বিধবা বোনের ঘর থেকে বের হতে দেখে সে বুঝলো অন্যদের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি ছিল।সেদিন থেকেই রত্নার জীবনটা কেমন যেন তেতো হয়ে যায়।শাশুড়ির কাছে নালিশ করলে সে বলে,তোরে ঘরে আনছি কি এমনি এমনি?নিজের স্বামীকে যদি বাইন্ধা রাখতে না পারস তো এই সোনার গতর দিয়া করবি কি হারামজাদি?রত্না বোঝে বিনা যৌতুকে তাকে ঘরে আনার রহস্য।তাকে আনা হয়েছে তার রূপ যৌবন দিয়ে দুশ্চরিত্র স্বামীকে বশ করার জন্য।সে চেষ্টাও তো রত্না কম করেনি কিন্ত মাঝ বয়েসি ময়না খাতুনের কাছে তার কচি দেহ বরাবরই পরাজিত হয়েছে।গ্রামের মুরুব্বি মহিলারা ময়নাকে আড় চোখে দেখিয়ে বলে ডাইনি,বুঝছিস বউ তোর ননদ একটা ডাইনি।সেই কচি বয়স থেইকা কেরামত ছোঁড়াটারে বশ করছে।তয় তার চে বড় ডাইনি তোর শাশুড়ি।সময়কালে পোলাডারে সামলায়নি আর এখন সব জাইনাশুইনাও তোরে ঘরে আনছে।তুইকি আর ওর লগে পারবি বউ? ঐ মাগী তো মন্ত্র জানে।সেই মন্ত্র দিয়াই তো নিজের স্বামীর জীবন শ্যাষ করছে আর বশ করছে তোর স্বামীরে।
রত্নার মনে হয় সেও যদি মন্ত্র জানত তাহলে এক নিমেষে জীবনের সব কষ্ট দূর করে দিত।হঠাত একটা প্যাঁচা হু হু শব্দে ডেকে উঠে।রত্না একটু চমকে উঠে।সে যে পুকুর পাড়ে বসে আছে সেটাকে পুকুর না বলে আসলে দীঘি বলাই ভাল।নামটাও বেশ সুন্দর,জলদীঘি।বহুকাল আগে এই গ্রামের জমিদারবাবু বিক্রমসিংহ জমিদারবাড়ি সংলগ্ন এই প্রকান্ড দীঘি কাটিয়েছিলেন।দীঘির অপরপ্রান্তে এখনও ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ির কঙ্কাল দাঁড়িয়ে রয়েছে।এই গ্রামে এতবড় জলের উতস আর একটাও নেই।রত্নার যখনই মন খারাপ হয় তখনই সে এই দীঘির নির্জন ঘাটে এসে বসে থাকে।এই দীঘি নিয়ে একটা ভয়ের গল্প প্রচলিত আছে তাই সন্ধ্যার পরে কেউই তেমন একটা এদিকে আসতে চায়না।গ্রামের লোকে বলে এই দীঘিতে দেও আছে।সেই দেও পুকুরে কেউ নামলে তার পা ধরে টানে।সুযোগ মত পেলে পা ধরে পাতালে টেনে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে মারে।
বিয়ের পরে পাড়ার মুরুব্বিদের মুখে রত্না শুনেছে অনেক আগে নাকি হামিদা বানু নামে এই গ্রামে এক সুন্দরী মেয়ে ছিল।হামিদা ছিল ধনী বাপের একমাত্র কন্যা।তাই অনেক খুঁজে তার বাবা বাইরে থেকে এক পাত্র আমদানি করলেন মেয়ের জন্য।বিয়ের পর বাপের বাড়িতেই বাস করতে লাগল নতুন দম্পতি।হামিদার সংসারে টাকার অভাব না থাকলেও অভাব ছিল একটা সন্তানের।পনের বছর পার হয়ে গেলেও কোন সন্তান আসল না তার কোলে।হামিদা নিজের ভাগ্যকে মেনেই নিয়েছিল তাই গ্রামের দু-চারজন গরিব ছেলেমেয়েকে নিজের কাছে রেখে,নিজের মত করে মানুষ করেই সে মাতৃত্বের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছিল।কিন্ত তার স্বামীর মনে ছিল অন্য রকম আশা।সে টাকার লোভ দেখিয়ে গ্রামের বেশ কয়জনকে বশ করে হামিদার কাছে পাঠায়।তারা হামিদাকে বোঝায় স্বামীর আর একটা বিয়ে দিতে।হামিদা এমন প্রস্তাবে মোটেও রাজি ছিলনা কিন্ত তার স্বামীর প্রতি ভালবাসা ছিল অন্ধ।বাবা-মা গত হয়েছে তাই আত্মীয়হীন হামিদাকে সুপরামর্শ দেয়ার কেউ ছিলনা।অবশেষে হামিদা রাজি হয় এই শর্তে যে নতুন বউ আসার পর স্বামীর ভালবাসা বা যত্নে কোনো ঘাটতি হবে না।হামিদার স্বামীর বিয়ে হয়,বাড়িতে নতুন বউ আসে।নতুন বউয়ের সাথে স্বামীর প্রেমলীলা দেখে হামিদার বুক কষ্টে ভেঙ্গে যেতে থাকে কিন্ত সে বুকে পাথর চেপে চুপ করে থাকে।বছর পেরিয়ে যায় তবু সংসারে নতুন সন্তানের আগমনের কোনো বার্তা শোনা যায় না।এদিকে হামিদার স্বামী তার ও্য়াদা ভুলে তার প্রতি চুড়ান্ত অবহেলা করতে শুরু করে।হামিদা বুঝতে পারে তার সব ত্যাগ ব্যার্থ হয়েছে।দিনদিন সে পাগলপ্রায় হয়ে যেতে থাকে।চাইলে সে তার বাড়ি থেকে অনায়াসেই তার স্বামী এবং সতীন কে বের করে দিতে পারত কিন্ত অন্ধ ভালবাসা তার রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।তারপর একদিন যখন সে শুনতে পায় তার স্বামী নতুন বউ এর সাথে হামিদাকে চিরতরে পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার আলোচনা করছে তখন হামিদার দৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়।ধুতুরার কোনো অভাব ছিলনা বাড়ির পাশের জঙ্গলে।তরকারিতে তার বিষ ইচ্ছামত মিশিয়ে দিয়ে হামিদা সাজতে বসে।পরনে বিয়ে লাল বেনারসীখানি জড়িয়ে সে অঙ্গে পড়ে নেয় যত সোনা-রূপার গহনা।ধনী বাপের একমাত্র মেয়ে তাই তার গহনাই নাকি ছিল দুইশ ভরীর উপরে।সমস্তটাই নাকি সে অঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে চলে আসে জলদীঘির ঘাটে।বর্ষাকালের দীঘি তখন পানিতে টুইটম্বুর।অভিমানি হামিদা সেই এক গা গয়না নিয়ে দীঘিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর সেই গহনার ভরেই সে তলিয়ে যায় জলদীঘির অতলে।তলিয়ে যাওয়ার আগে সে নাকি প্রতিজ্ঞা করে যায় তার দূর্ভাগ্যের জন্য দায়ী কাওকেই সে ছেড়ে দেবে না,সকলকে নির্বংশ করে ছাড়বে।
রত্না শুনেছে হামিদার লাশ নাকি আর পাওয়া যায়নি।যাবেই বা কিভাবে?সাবেকি আমলে কাটা দীঘি,অতল গভীর।তাছাড়া এরপর থেকেই দীঘির জলে ডুবে মানুষ মরতে থাকে।অনেকেই বলে দীঘিতে নামলে কে যেন নিচ থেকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে।দু একজন দাবী করে তারা জলে ডুব দিয়ে লাল শাড়িপড়া এলোচুলের হামিদাকে তার সামনে দাঁত বের করে হাসতে দেখেছে,ভাগ্যের জো্র ছিল তাই তারা বেঁচে ফিরেছে।অনেকে বলে তারা গভীর রাতে লাল শাড়ি পড়া একটি বউকে দীঘির জলের উপর দিয়ে হাঁটতে দেখেছে।ধীরে ধীরে এমনি সব গল্প চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে মানুষকে আতংকিত করে ফেলে।এদিকে দীঘিতে ডুবে অনেকের মৃত্যুও হতে থাকে।যারা বেঁচে যায় তাদের সকলের একই দাবী,কে যেন তাদের পা ধরে টেনে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছে।একসময় ভয়ে সকলে দীঘিতে নামা বন্ধ করে দেয়।তবে এসব কয়েক পুরুষ আগের কথা,অনেকটা যেন গল্পের মত।এখন অনেকেই এসব বিশ্বাস করেনা।অনেকে বলে হয়ত হামিদা স্বামী আর সতীনকে খুন করে দেশান্তরী হয়ে গেছে সব গহনা নিয়ে।কিংবা হয়ত লোভী কোনো প্রতিবেশি হামিদাকে মেরে লাশ গুম করে ঘটনা এমন ভাবে সাজিয়েছে যেন মনে হয় হামিদাই এর জন্য দায়ী।এখন জলদীঘিতে মাছ চাষ হয়,এর চারিদিকে পনের-বিশটি ঘাট বানিয়ে গ্রামের লোক ইচ্ছামত দীঘির জল ব্যবহার করে কিন্ত বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সকলেই সন্ধ্যার পর আর দীঘিতে নামতে চায়না।বিশেষ করে দীঘির যে দিকে হামিদা বানুর পরিত্যাক্ত ভিটা গাছ আর আগাছায় ঢেকে গিয়ে বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে।রত্না অবশ্য এই জায়গাটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে,সুযোগ পেলেই এখানে এসে বসে।
আজ গভীর রাতে হামিদা বানুর ঘাটে বসে রত্নার হৃদয় কেন যেন হামিদা বানুর জন্য কেঁদে ওঠে।কে জানে এই নামে আসলেই কেউ ছিল কিনা কিন্ত যদি গল্পগুলি সত্যি হয় তবে হামিদা তারই মত অভাগী ছিল।রত্নার স্বামী কেরামত আজকাল রত্নার গায়ে হাত তোলে।শুধু যে হাত তোলে তাই না,পিটিয়ে আধমরা করে ফেলে তবে তার শান্তি হয়।আজও একচোট পিটিয়ে নিয়ে সে অভিসারে বের হয়েছে।স্বামীর প্রহারের জ্বালা যদিও বা সহ্য হয়,সহ্য হয়না ময়না খতুনের ব্যঙ্গ করা হাসি।রত্নাকে দেখলেই সে বাঁকা হেসে বলে ও বউ,তোর স্বামীকে ঘরে বাইন্ধা রাখতে পারস না?আজকাল বড্ড জ্বালায়!!সেই অপমানের কথা মনে হতেই এই রাতেও রত্নার চোখে জল এসে যায়।মনে হয় কি ভালই না হতো যদি ঐ দুজনকে কেটে ভাসিয়ে দিয়ে হামিদা বানুর মত সে এই দীঘির জলে ডুবে মরতে পারত।এসব ভাবতে ভাবতেই সে চমকে উঠে দেখে পুকুরধারে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।কুয়াশার জন্য ভাল করে দেখা যায় না তাই রত্না উঠে দাঁড়ায়।সেই ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে থাকে আর রত্নার কানে আসে অসংখ্ায অলংকারের নিক্কন।কাছাকাছি আসার পর রত্না খেয়াল করে লাল শাড়ি পড়া, সমস্ত গায়ে অলঙ্কার জড়ানো অচেনা একটি বউ।তার রূপের ছটায় যেন চারিদিক মূহুর্তের মধ্যে আলোকিত হয়ে যায়।সে রত্নায় দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে তারপর সিঁড়ি দিকে ধীরে ধীরে দীঘির পানিতে নেমে যায়।কি এক আকর্ষনে রত্নাও তার পিছু নেয়,তার মনে হতে থাকে সামনেই মুক্তি,সামনেই শান্তি,এজগতে লালশাড়ি পড়া বউটিই তার একমাত্র সমব্যাথী।
দুই
মধ্যদুপুর।জলদীঘির ঘাটগুলোতে গ্রামের বউদের কর্মচঞ্চলতার উতসব লেগেছে।কাজের সাথে সাথে চলছে গল্প।সকলের মুখেই এক কথা,রত্নার রহস্যময় অন্তর্ধান।দীঘির ঘাটে পরে থাকা চাদরটি সাক্ষ্য দেয় সে মাঝরাতে দীঘির পাড়ে এসেছিল কিন্ত এরপর আর তার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।দীঘিতে জাল ফেলে যতটা সম্ভব খোঁজা হয়েছে কিন্ত তার লাশও মেলেনি।এ নিয়ে একেক জন একেক মতবাদ দিয়েছে কিন্ত রহস্যের কোনো সমাধান হয়নি।অনেকে ব্লছে তাকে দীঘির দেও টেনে নিয়ে গেছে।এসব নিয়েই আলোচনা চলছিল এমন সময় ময়নাকে ঘাটে নামতে দেখে সবাই থেমে যায়।ময়না তাদের কোনো পাত্তা না দিয়ে ঘাটের একপাশে বসে কাপড় কাচতে থাকে।আর মনে মনে ভাবে আসলেও তো গেল কোথায় মেয়েলোকটা।তা যাক যেখনে ইচ্ছা।তার পথের কাঁটা দূর হয়েছে তাতেই সে খুশি।তার কাজ শেষ করে সে যখন পানিতে নামে তখন ঘাট প্রায় ফাঁকা।পানিতে নেমে ডুব দিয়ে সে গা ভিজায়।তারপর আঁচলের গিট থেকে একটুকরো সুগন্ধি সাবান বের করে আঁচল দিয়েই সে গা ডলতে থাকে।গা দলা শেষ করে যখন সে ডুব সাঁতার দিয়ে আর একটু গভীরে যায় ঠিক তখনি তার মনে হয় একটা হাত যেন তার পা দুটো চেপে ধরে নিচের দিকে টানছে।সে প্রানপনে পা ছুটিয়ে নিতে চায় কিন্ত পারেনা কিন্ত বিস্ফোরিত নেত্রে লক্ষ্য করে,এ যে রত্না!ডুরে শাড়ি পড়া রত্না তার পা ধরে টানতে টানতে খিল খিল করে হাসছে।প্রচন্ড ভয় হয়ত ময়নাকে শক্তি জোগায়।সে এক ঝটকায় পা ছুটিয়ে নিয়ে উপরে উঠে আসে,পানির উপরে মাথা তুলে চেঁচিয়ে উঠে প্রানপনে।ঘাটে থাকা বউ দুজন অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়।আবার তলিয়ে যেতে যেতে জ্ঞান হারানোর আগে সে দেখে রত্নার সাথে লালশাড়ি পড়া একটি বউ তীব্র ঘৃনার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
তিন
কেরামত বাজার থেকে বাড়ি ফিরছে।সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেক আগে এখন রাত প্রায় দশটা।কেরামতের হাতে কিছু ফলমূল,গ্লুকোজের প্যাকেট।এইসবই সে ময়নার জন্য কিনেছে।দুদিন আগে পুকুরে জ্ঞান হারিয়ে ডুবে যাওয়ার পর থেকে তার ভীষন জ্বর,সেইসাথে সে ক্রমাগত প্রলাপ বকছে।কি সব আবোল তাবোল কথা।রত্না নাকি তাকে ডুবিয়ে মারতে চাইছিল,তার সাথে নাকি হামিদাও ছিল।এইসবই লোকের ঐসব উদ্ভট গল্পের ফল।নিজের শাড়িতে পা জড়িয়েই যে বোকা মেয়েলোকটা ভয় পেয়েছে এব্যাপারে কেরামত নিশ্চিত।ঐসময় বউদুটি ঝাপিয়ে পড়ে তাকে উদ্ধার না করলে ময়না জ্ঞান হারিয়ে পানিতে ডুবেই মরত।এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে গিয়ে কেরামত নরম কি যেন একটা জিনিসে পা দেয়।দূর্গন্ধেই বুঝতে পারে বস্তুটা মানুষের বিষ্ঠা।জঘন্য একটা গাল বকে আক্কেলজ্ঞানহীন লোকের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে সে রাস্তা ছেড়ে জলদীঘির দিকে হাঁটা দেয়।কাছের ঘাটের দিকে যেতে যেতে সে ভাবে রত্না আবার দীঘিতে আসবে কি করে?নিশ্চয় মাগী পুরোনো কোনো প্রেমিকের হাত ধরে ভেগেছে।যাই হোক ভালই হয়েছে তার যন্ত্রনা কমেছে।হাতের প্যাকেট পাড়ে রেখে কেরামত ঘাটে নেমে কচলে কচলে তার পা ধুতে থাকে।হঠাত সে লক্ষ্য করে তার সামনের পানিতে আলোড়ন।সেদিকে তাকিয়ে সে দেখে একটা কালো নারীমূর্তি ধীরে ধীরে মাথা তুলছে।তার ভেজা গা থেকে,খোলা চুল থেকে ফোটায় ফোটায় পানি পড়ছে।ভাল করে লক্ষ্য করে সে বুঝতে পারে এযে রত্না!কিন্ত এত রাতে সে পানিতে কেন?তার চোখমুখ কেমন কালচে,ফোলা ফোলা।যেন পানিতে ভেজা লাশের মত।সে খনখনে একটা হাসি দিয়ে বলে, কিরে কেরামত,আমার জন্য তো কোনোদিন উপহার আনস নাই,ঐ ময়নার জন্য এত দরদ।কেরামত ভয়ে কাঠ হয়ে যায়।রত্না তার অস্বাভাবিক ঠান্ডা হাত দিয়ে কেরামতের পা জড়িয়ে ধরে।কেরামত প্রানপনে চিতকার করে উঠে দৌড়ে পালাতে চায় কিন্ত সামনে তাকিয়ে দেখে লালশাড়ি পড়া একটি বউ ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।সে অলংকারের নিক্কন তুলে কেরামতের দিকে এগিয়ে আসে,তার আর পালিয়ে যাওয়া হয় না।
কেবল সন্ধ্যা লেগেছে।রহিমুদ্দি তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দীঘিতে জাল ফেলতে এসেছে।তার বুক ভয়ে দুরু দুরু করছে।সবাই বলাবলি করছে জলদীঘির দেও জেগেছে।প্রথমে রত্নার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া তারপর ময়নার ভয় পেয়ে পাগল হয়ে যাওয়া এরপর কেরামতের পানিতে ডুবে মৃত্যু সবই নাকি ঐ দেও এর কাজ।আজ সন্ধ্যায় হঠাত করে তার বড় জা্মাই এসেছে, তাকে খাওয়াতে মাছ লাগবে তাই সে নিরুপায় হয়ে জাল ফেলতে এসেছে।নইলে সে এ সাহস করত না।রত্না বড় ভাল মেয়ে ছিল।সেই তো রত্নার বিয়ের ঘটকালি করেছিল।সে সবই জানত কেরামরতের ব্যাপারে কিন্ত কেরামতের মা এমন করে অনুরোধ করল যে সে ফেলতে পারেনি।ভেবেছিল বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।আহারে!সবই অভাগীর কপালের দোষ!দুইবার জাল ফেলে বড় মাছ না পেয়ে সে আর একবার জাল ফেলে আর গভীরে।এবার জাল টানতে গিয়ে সে বুঝতে পারে বেশ বড় মাছ উঠেছে।তার এই খুশি আর থাকে না যখন জাল টানতে অস্বাভাবিক কষ্ট হতে থাকে।তার মনে হয় পানির ভেতরে জাল যেন কিছুতে আটকে গিয়েছে।দুই বাপ-বেটা মিলে গায়ের জোরে টানতে থাকে,একসময় জাল উঠে আসতে থাকে।কিন্ত!একি!জাল টানার সাথে সাথে জালের প্রান্ত ধরে উঠে আসছে দুই রমনী।তাদের ভেজা এলোচুল পিঠময় ছড়ানো।খিল খিল শব্দে হাসতে হাসতে তারা জাল ধরে উঠে আসে।
চার
কয়েক বছর পর।বিক্রমপুর গ্রামে শহর থেকে কয়জন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়ে বেড়াতে এসেছে।গ্রামে এসে সকলেই লাফিয়ে ঝাপিয়ে হৈ হুল্লোড় করে সময় কাটাচ্ছে কিন্ত নাদিয়ার মনে আনন্দ নেই।তারা সবাই হয় ক্লাসমেট বা সমবয়সী বন্ধু।নাদিয়া শুনেছে রিফাতের দাদা এই জমিদার বাড়ি সংলগ্ন জমি আগেই কিনে রেখেছিল,রিফাতের বাবা তাতে বাগানবাড়ি করেছে ছুটি কাটানোর জন্য।রিফাতই এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে তাদের সবাইকে দাওয়াত করে এনেছে গ্রাম দেখাবে বলে।গ্রামে এসে এরা সবাই যেমন বিভিন্ন জিনিস দেখে আহা উহু করছে,নাদিয়ার গা জ্বলে যাচ্ছে তা দেখে।মেয়েরা যেন এসেব আলগা ঢঙ্গের ব্যাপারে বেশি এক্সপার্ট।বিশেষ করে রিয়া।আরে শহরে বড় হয়েছিস বলে কি এটাও জানবি না যে ডাব আর নারিকেল একই গাছে ধরে?যত্তসব!!
নাদিয়ার ছোটবেলাটা গ্রামেই কেটেছে তাই তার মাঝে এসব আদিখ্যেতা নেই।মিডিলক্লাস ফ্যামিলির মেধাবী সুন্দরী মেয়েরা যেমন হয় নাদিয়াও ঠিক তেমনই নম্র এবং ভদ্র।নাদিয়া মনে মনে ভাবে তবুও সে কেন যে এসবের মাঝে জড়াতে গেল!আসলে রিফাত ছেলেটির ব্যক্তিত্ব এমনি যে সহজেই সকলকে টেনে নেয়।দু একজন অবশ্য নাদিয়াকে রিফাতের সাথে মিশতে না করেছিল কিন্ত সে কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারেনি।এখন সে রিফাতের আনন্দভ্রমনে এসে খুবই বিরক্তবোধ করছে।যতসব ঢঙ্গী আর স্টুপিড ছেলেমেয়ের সাথে রিফাতের বন্ধুত্ব।নাদিয়া এখানে এসেছে শুধু রিফাতকে একটু একা পাওয়ার জন্য।রিফাতের সাথে তার খুব জরুরী একটা কথা আছে।কিন্ত সে রিফাতকে এক মূহুর্তের জন্যেও একা পাচ্ছে না সবসময় তার সাথে আঠার মত চিপকে থাকছে ঐ রিয়া মেয়েটা।এদের প্রতি বিরক্ত হয়ে নাদিয়া হাঁটতে বের হয়।বাগানবাড়ির সামনের গাছ-গাছালী ঘেরা বাগান পেরিয়েই রয়েছে একটা বিশাল সুন্দর দীঘি।জমিদারের আমলে বাঁধানো ঘাট যদিও অনেক ভেঙ্গে গেছে তবুও এখানে বসে থাকতে খুব ভাল লাগে।ঘাটের দুপাশে দুটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে।নাদিয়া সেই দীঘির উঁচু পাড় দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
বাগানবাড়ির উঠানে ক্যাম্পফায়ারের আগুন জ্বলছে,বাতাসে বারবিকিউ এর গন্ধ।বিদেশি গানের তালে তালে একদল তরূন তরুনী উদ্দাম নেচে চলেছে।কিন্ত উঠানের সামনের বাগান পেরিয়ে যে দীঘির ঘাট সেখানে এক তরুনী ভগ্ন হৃদয়ে বসে রয়েছে।সেই তরুনী হচ্ছে নাদিয়া।আজ সে শেষ পর্যন্ত রিফাত কে কথাটি জানিয়েছে।আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কথাটি শুনে রিফাত একটুও চমকায়নি।খুব সহজ স্বরে বলেছে এবরশান করে ফেল।নাদিয়া এযুগের মেয়ে।সে এটুকু জানত যে তাকে এপথেই যেতে হবে।সে তা করতে প্রস্তুতও ছিল কিন্ত তাই বলে এভাবে?এত সহজে?সে রিফাতের কাছে এমন আচরন আশা করেনি। অন্তত একটু টেনশন,একটু সমবেদনা, একটু শান্তনা দেয়া এটুকু তো রিফাত করতে পারত।সব কিছুর জন্য দায়ী ঐ রিয়া।রিফাতের জীবনে সে আসার পর থেকেই রিফাত অন্য রকম হয়ে গেছে।নাদিয়া বোঝেনা এই মেয়েগুলো কেমন যে অন্যজনের সাথে সম্পর্ক আছে জানার পরেও তারা নিজের রূপ দেখিয়ে ছেলেদের কাছে ঘেষতে আসে।আর এই বড়লোকের ছেলেগুলোই বা কেমন।এতদিনের সম্পর্কের মাঝে অনায়াসেই অন্য মেয়ের আগমন হয়েছে কিন্ত তার ভাব এমন যেন কিছুই হয়নি।যে এত বড় খবরটা সে দিল কিন্ত তার কোনো রিয়াকশনই যেন রিফাতের মধ্যে নেই।এখানে আশার আগ পর্যন্ত সে রিফাতকে রিয়ার কোমর জড়িয়ে নাচতে দেখেছে।অথচ কিছুদিন আগেও সে নাদিয়াকে একটুও কাছছাড়া করত না।আর কত প্রতিশ্রুতি!বলত সবসময় তোমার পাশে থাকবো।এই বুঝি পাশে থাকা?
কাঁদতে কাঁদতে নাদিয়ার সমস্ত কান্নাও যেন শুকিয়ে গেছে।সে বুঝতে পেরেছে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি ছিল রিফাতের সাথে জড়ানো।দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত,কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত নাদিয়া মনে মনে ভাবে তার বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই।খুব ভাল হতো যদি দুপুরে গ্রাম্য বুড়ির মুখে শোনা জলদেও এর কিংবদন্তী সত্যি হতো।যদি দীঘির দেও তাকে টেনে নিয়ে ডুবিয়ে মারত তবে এ পরাজয়,এ লজ্জা তাকে বয়ে বেরাতে হতো না।নাদিয়া মরে গেলে রিফাত তখন বুঝত সে কাকে অবহেলা করেছে।হঠাতই নাদিয়ার চিন্তার ভুল ভাঙ্গে।না,নাদিয়ার মৃত্যু হলে রিফাতের কিছুই এসে যাবে না।এটা ভেবেই নাদিয়ার আবার কান্না পায়।হঠাতই অলংকারের নিক্কনে নাদিয়া মাথা তুলে তাকায়।পূর্নিমা চাঁদের ঝকঝকে আলোয় সে দেখে সিঁড়ির শেষ ধাপে পানিতে পা ভিজিয়ে দুই নারী দাঁড়িয়ে আছে।একজনের লালবেনারসী জড়ানো গায়ে রাজ্যের অলংকার।অন্যজনের পড়নে তাতের ডুরে শাড়ি,নাকে নোলক।দুজনেই অসম্ভব রূপবতী,তাদের রূপের ছটায় যেন চারিদিক আলোকিত হয়ে আছে।তারা দুজনেই নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে মোহনীয়ভাবে হাসে।নাদিয়ার মাঝে এক অমোঘ আকর্ষনের জন্ম হয়।তার মনে হত থাকে এরা তার খুব আপন জন।সে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় জলদীঘির অতল জলের দিকে।