somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেখ মুজিব কেন যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছিলেন

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য খুব সোচ্চার এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এ বিচার শুরুও করা হয়েছে। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনাল দু’জনকে সাজা প্রদান করে রায় দিয়েছে। আরও কয়েকজনের বিচার চলছে। একজনের দন্ড যাবজ্জীবন হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেপথ্য ইঙ্গিতে শাহবাগে টানা ১৭ দিন চলেছে ফাঁসির দাবিতে সমাবেশ। সংসদে যুদ্ধাপরাধ মামলার আপীল সংক্রান্ত বিধানের সংশোধনীও ভুতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে পাস করা হয়েছে দ্রততার সঙ্গে। অথচ ইতিহাসের নির্মম সত্য হচ্ছে, এই আওয়ামী লীগই প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছিল।

এখন থেকে ৩৮ বছর আগে ১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ১৯৫ জন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীকে শুধু ছেড়েই দেননি, তাদের সহযোগী আলবদর, রাজাকার, আল-শামস বাহিনীর দালালদেরও জেল থেকে মুক্ত করে দেন। তাদের জন্য ঘোষণা করেন সাধারণ ক্ষমা। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব স্বাধীনতার দ্বিতীয় বার্ষিকীতে জেল থেকে মুক্তি দেন ৩০ হাজার দালালকে। তিনি ঘোষণা করেন—জনগণ যাতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ ভুলে গিয়ে নতুনভাবে শুরু করে, সেটাই তিনি চান। শেখ মুজিব এও বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ জানে কীভাবে ক্ষমা করতে হয়।’ এ ঘোষণার পরই তার আমন্ত্রণে বাংলাদেশে সফরে আসেন একাত্তরের প্রধান বেসামরিক যুদ্ধাপরাধী জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাকে দেয়া হয় রাজকীয় সম্মান। এর আগে ১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তানের লাহোরে গিয়েছিলেন ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলনে যোগ দিতে। লাহোর বিমানবন্দরে তার সঙ্গে আলিঙ্গন করেন ভুট্টো। তাকে জানানো হয় সামরিক অভিবাদন। একাত্তরে গণহত্যার নেতৃত্বদানকারী নরপিশাচ জেনারেল টিক্কা খান শেখ মুজিবকে স্যালুট করেন। টিক্কা খানের স্যালুট নিয়ে মুজিব তার সঙ্গে করমর্দন করেন। ওআইসি সম্মেলন শুরুর দিন সম্মেলন মঞ্চে শেখ মুজিব ভুট্টোর গালে প্রকাশ্যে চুমু খান। লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে এসে ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে দেয়া সাক্ষাত্কারে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালে যা হয়েছিল তা ভুলে যাওয়া দরকার।’

কলকাতার ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যানে সাক্ষাত্কারটি ছাপা হয়েছিল। মূলত এভাবেই শেখ মুজিব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর করলেন না।
ভারতের সিমলায় ইন্দিরা-ভুট্টো বৈঠকে যুদ্ধবন্দি প্রসঙ্গ
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৬ মাস পর ১৯৭২ সালের জুনে ভারতের সিমলায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৮ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত এ বৈঠক চলে। দুই দেশের মধ্যে এর আগে ১৫ বছরে এ ধরনের কোনো বৈঠক হয়নি। বৈঠকটি হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর এবং তার প্রেক্ষিতেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনী হিসেবে যোগ দিয়েছিল ভারত। তাই ভারতের আগ্রহেই বৈঠকটি হয়েছিল বলে তখনকার বিশ্লেষকদের মূল্যায়নে বলা হয়। এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষকদের মন্তব্য, একাত্তরের যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর সেই মুহূর্তে নীরবতা পালন ছাড়া ভারতের তেমন কোনো কাজ ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, যুদ্ধজয়ের পর এ অঞ্চলে সামরিক প্রাধান্য ভারতের অনুকূলেই নিশ্চিত হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসাই ছিল তখন ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশ্য। ‘ভারত পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চাইছে’—পাকিস্তানের এ বক্তব্য খণ্ডন করাও ছিল ইন্দিরা গান্ধীর লক্ষ্য। তাছাড়া পাকিস্তানের ৯০ হাজার সৈন্য নিজের হাতে রেখে দিয়ে কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তানের দাবি প্রত্যাহার করার চাপ প্রয়োগও ছিল ইন্দিরা গান্ধীর একটি কৌশল। একইসঙ্গে বিরাট সংখ্যক পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহের বোঝা বেশিদিন বহন করতেও রাজি ছিলেন না ইন্দিরা গান্ধী। ফলে সিমলা বৈঠকটি হয়। বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধী অতীতকে ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতের ভাবনা সামনে রেখে আলোচনা শুরু করেন।

বৈঠকে সম্পাদিত চুক্তিতে ইন্দিরা-ভুট্টো দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতা কিংবা শান্তিপূর্ণ অন্য যে কোনো উপায়ে তাদের সব বিরোধ নিষ্পত্তি করার বিষয়ে সম্মত হন। কূটনৈতিকভাবে ওই বৈঠকে দুই নেতাই জয়লাভ করেন। বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবন্দি সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও এই সিমলা চুক্তিই ছিল পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দিদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ। তাছাড়া উপমহাদেশের তিনটি দেশ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলার প্রেক্ষাপটও ছিল এই সিমলা চুক্তি। এই চুক্তির ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশ এক যৌথ ঘোষণায় উপমহাদেশের তিনটি দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমন ও পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি হয়; এতে বাংলাদেশ একমত পোষণ করে। এই চুক্তি অনুযায়ী ‘সব মানবিক সমস্যার সমাধান করা’ হবে বলে একটি ঘোষণা দেয়া হয়।

এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই স্বীকৃতির পর ১৯৭৪ সালের ৫-৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং অংশ নেন। এ বৈঠকে যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জন সামরিক অফিসারের বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে দেখা যায়, মানবিক কারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বেসামরিক লোকজন এবং ভারতে পাঠানো ৯০ হাজারের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে ১৯৫ জন চিহ্নিত ও বিচারের অপেক্ষায় থাকা যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সামরিক অফিসারকে মুক্তিদানের ব্যবস্থা হয়। এ কাজটি করার জন্য এর আগেই জুলফিকার আলী ভুট্টো অতীতের ভুল-ত্রুটি ভুলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং তার উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমানও ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জানে কীভাবে ক্ষমা করতে হয়।’ তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। একইসঙ্গে ভারত থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানে চলে যায় ৯০ হাজার পাক যুদ্ধবন্দি।

১৯৭২ সালে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, অর্থাত্ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার, তারাই যুদ্ধাপরাধীদের কোনো বিচার করেননি। সে সময় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য যেসব দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদের সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ যে সত্যি সত্যিই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি এবং বিচার চায়নি তার বড় প্রমাণ ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে ভারত থেকে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে বিচারের দাবিও তারা করেনি। পরে চুক্তির মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে তাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। একাত্তর সালের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় ও প্রধান যুদ্ধাপরাধী ছিল ভুট্টো। কিন্তু ভুট্টোকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা তো দূরের কথা, তাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে সফরে এনে সম্মান দেখানো হয়েছে। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও চিন্তক বদরুদ্দীন উমরের ‘বাংলাদেশের রাজনীতি’ শীর্ষক বই থেকে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে গিয়ে প্রকাশ্য মঞ্চে জুলফিকার আলী ভুট্টোর গালে চুমু খেয়ে নিজের পরম বন্ধু হিসেবে তাকে ঢাকায় আমন্ত্রণ করেছিলেন। ভুট্টোর ঢাকা সফরের মধ্য দিয়েই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইতি ঘটেছিল।

দালালদের যেভাবে ছেড়ে দেন শেখ মুজিব

একাত্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর গণহত্যা, অসংখ্য নারী ধর্ষণ, লাখ লাখ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এ কাজের মূল হোতা তারা হলেও তাদের এই জঘন্য কাজে সহযোগিতা করেছিল এদেশের কিছু বেসামরিক লোক—রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনী গঠন করে। সেদিন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লোকেরা যেমন মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করেছে, তেমনি অপরাধ করেছে তাদের সহযোগী এদেশিয় দালালরা। এ দালালদের বিচার করার জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ ১৯৭২ নামে একটি আইন হয়। এ আইনের মাধ্যমে কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কিংবা কতজনকে সাজা প্রদান করা হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ‘বাংলাদেশ : শেখ মুজিবের শাসনকাল’ শীর্ষক বইয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, এর আনুমানিক সংখ্যা ছিল ৫০ থেকে ৬০ হাজার। তেমনি এর প্রায় সমান সংখ্যক ব্যক্তি পলাতক ছিল। কিন্তু তত্কালীন মুজিব সরকারের আমলেই এই দালাল আইনের অপব্যবহার হয়েছিল। আওয়ামী লীগের লোকেরা এই আইন নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। তারা ঘুষ নিয়ে সত্যিকার দালালদের তখনই আড়াল করে ফেলে।

দালালদের একটি বিশেষ অংশ আওয়ামী নেতাকর্মীদের সহায়তায় গাঢাকা দিতে সক্ষম হয়। একদিকে তারা বিপুল সংখ্যক সত্যিকার দালালকে সহায়তা দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সরবরাহ করে বাঁচিয়ে দেন, অন্যদিকে যারা একাত্তরে দেশত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের প্রতি এমন অবহেলা দেখান—যার ফলে মনে হয় তারাই যেন দালাল। এভাবে আওয়ামী নেতাকর্মীরা ঘুষ-দুর্নীতিতে আসক্ত হয়ে পড়েন। বহুক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দালাল আইনের সুযোগ নিয়ে তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি পারিবারিক শত্রুদের কারাবরণে বাধ্য করেছিলেন। এই আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সেদিন সর্বপ্রথম প্রতিবাদ জানান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতাসীনরা এই আইনের অপব্যবহার করে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে। এরপর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের আগে শেখ মুজিব দালালদের ক্ষমা করে দেন। স্বাধীনতার দ্বিতীয় বার্ষিকীতে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয় ৩০ হাজার দালালকে। যারা পলাতক ছিল তারাও শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমায় প্রকাশ্যে আবির্ভূত হন। ১৯৭২ সালের দালাল আইনে লক্ষাধিক লোককে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের সবাইকেই গ্রেফতারের ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৪৭১ জনের নামে মামলাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিব সরকারের সিদ্ধান্তেই তাদের আর বিচার করা হয়নি, ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল।

যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ১৯৭১-এর পর শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকার দ্বারা সম্ভব হয়নি, পাক হানাদার বাহিনীর সহচর যে দালালদের শেখ মুজিব ক্ষমা করে দেন এবং জেল থেকে মুক্তি দেন তাদের বিচার আবার আওয়ামী লীগের দ্বারা সম্পন্ন করা এক প্রকার রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজি। আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আসল উদ্দেশ্য।

মুজিব-ভুট্টোর লাভ-লোকসান ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

১৯৭৩ সালে দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরের পর স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রশ্নটা চাপা পড়ে যায়। অন্যদিকে সেদিন ভুট্টো যা চেয়েছিলেন, তা-ই তিনি পেয়েছেন। ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীসহ নব্বই হাজারেরও বেশি যুদ্ধবন্দীকে ভুট্টো ফেরত নিয়েছেন। ভারতের অসন্তুষ্টির মুখে তিনি শেখ মুজিবকে টেনে নিয়ে গেছেন ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে, নিজের ইচ্ছানুযায়ী সময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, কোনো কমপ্রোমাইজ না করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল করিয়েছেন। সর্বোপরি পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী অবাঙালিদের দায়ভারও তিনি বহন করেননি। প্রথম দিকে কেবল যুদ্ধবন্দীদের ফেরত আনার আগ্রহে ভুট্টো ভারতের সিমলায় গেলেও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণেই দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। শেখ মুজিব ব্যর্থ হলেও কূটনীতিতে সফল হয়েছিলেন ভুট্টো।
ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিবের যোগদান সম্পর্কে শেখ হাসিনার স্বামী মরহুম বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করুন, বেগম মুজিব চাননি। আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদও ওই সময় বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানের লাহোরে যাওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। ভারতও বিষয়টি জানত না। কিন্তু তিনি লাহোরে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানে সিদ্ধান্ত নেন। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিন বিশেষ বিমান পাঠান শেখ মুজিবকে ঢাকা থেকে লাহোরে নেয়ার জন্য। ওই বিমানেই তিনি লাহোরে যান। ১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লাহোর বিমানবন্দরে বাংলাদেশে গণহত্যার নেতৃত্বদানকারী জেনারেল টিক্কা খান তাকে স্যালুট করেন।

শাহবাগের রাজনীতি

বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে যাদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে, তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহচর অর্থাত্ দালাল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। কাদের মোল্লাকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর এ দণ্ড ঘোষণার পরই সৃষ্টি হয়েছে শাহবাগের রাজনীতি। ট্রাইব্যুনালের এ দণ্ড তারা মানেন না। ফাঁসির রায় চান। এই দাবিতে টানা ১৭ দিন শাহবাগে সমাবেশ হয়েছে। ট্রাইব্যুনালকে চাপে রাখতে শাহবাগের এ সমাবেশ ইতোমধ্যে নানা বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে বক্তব্য এসেছে যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্যই অত্যন্ত সুকৌশলে গণজাগরণের নামে তার সাংস্কৃতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো ব্যবহার করে এটা করেছে। শাহবাগের বিতর্কিত এ সমাবেশ ভয়ংকর এক খারাপ নজির সৃষ্টি করেছে। স্কুলের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের এ সমাবেশে এনে স্লোগান দেয়ানো হচ্ছে ‘ফাঁসি চাই, জবাই কর’। এ বয়সে যে শিশুদের শেখার কথা ‘সদা সত্য কথা বলিব’ তাদের মুখে ‘ফাঁসি চাই, জবাই কর।’ এর ভবিষ্যত পরিণতি যে কি হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। (সুত্র- আমারদেশ)

লেখক- সৈয়দ আবদাল আহমদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:২৪
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ওয়াকফ: আল্লাহর আমানত নাকি রাজনীতির হাতিয়ার?

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৫৯


"একদিকে আমানতের আলো, অন্যদিকে লোভের অন্ধকার—ওয়াকফ কি এখনও পবিত্র আছে?"

আমি ইকবাল হোসেন। ভোপালে বাস করি। আমার বয়স প্রায় পঁইত্রিশ। জন্ম থেকে এখানেই বড় হয়েছি, এখানেই আমাদের চার পুরুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনুসের সরকার..........দীর্ঘ সময় দরকার!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:২৫



সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির সারজিস আলম ড. ইউনুস সম্পর্কে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। সে মোটাদাগে যা বলতে চেয়েছে তা হলো, ড. ইউনুসের আরো পাচ বছর ক্ষমতায় থাকা উচিত। অত্যন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেমন মুসলিম ??

লিখেছেন আরোগ্য, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:০৫



বিলাসিতায় মগ্ন মুসলিম জাতি তার আরেক মুসলিম ভাইয়ের নির্মম হত্যার সংবাদ শুনে কেবল একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেদের রাজভোজ আর খোশগল্পে মনোনিবেশ করে। হায় আফসোস! কোথায় সেই মহামানব যিনি বলেছিলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবাবিল পাখি আরবদেরকে চর্বিত তৃণের ন্যয় করবে! ছবি ব্লগ

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৯


ফিলিস্তিনকে বোমা মেরে ছাতু বানিয়ে ফেললো ইসরাইল, অর্ধলক্ষ মানুষকে পাখি শিকারের মতো গুলি করে হত্যা করলো তারপরও মধ্যপ্রাচ্যের এতোগুলো আরব রাস্ট্র শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে আর ভাবছে আমার তো কিছুই... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা (বোনাস পর্ব)

লিখেছেন সামিয়া, ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৪:০৮



চারদিক হাততালিতে ভরে উঠলো।
বর্ষা আপু চিৎকার করে বলে উঠলো, "ইশান-অহনা!! অফিস কাপল অফ দ্য ইয়ার!!"
বুলবুল ভাই অহনাকে বললেন, “এখন বলো আসলেই সাগরে ঝাঁপ দিবা, না এই হ্যান্ডসাম যুবকটারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×