পশ্চিম ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরের উত্তর উপকূলবর্তী দেশসমূহ বাঁধাকপির উত্পত্তি স্থান বলে ধারণা করা হয়। পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর বিস্তার লাভ করেছে। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র বাঁধাকপির চাষ হয়। বাঁধাকপি Cruciferae পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সবজি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Brassica Oleracea Var. Capitata L. বাঁধাকপির অগ্রভাগের স্ফীত কচিপাতাসমূহই খাওয়ার জন্যই এর চাষ করা হয়।
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম বাঁধাকপিতে রয়েছে ১.৩ গ্রাম প্রোটিন, ৪.৭ গ্রাম শর্করা, ০.০৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন 'বি'-১, ০.০৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন 'বি'-২ ও ৬০ মিলিগ্রাম ভিটামিন 'সি'। তাছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম বাঁধাকপিতে ৩১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮ মিলিগ্রাম লৌহ, ৬০০ মাক্রোগ্রাম ক্যারোটিন ও ২৬ কিলোক্যালোরী খাদ্যশক্তি থাকে। আমাদের দেহের পুষ্টি সাধনে এসব পুষ্টি উপাদানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ফুলকপি, পালংশাক, মুলা ও ধনে শাকের চেয়ে বাঁধাকপিতে অধিক পরিমাণে 'বি'-১ (থায়ামিন) থাকে। এছাড়া বাঁধাকপিতে ফুলকপির তুলনায় বেশি পরিমাণ ভিটামিন 'বি'-২ (রাইবোফ্লেভিন) পাওয়া যায়। লালশাক ও ধনেশাকের চেয়ে বাঁধাকপিতে অনেক বেশি ভিটামিন 'সি' রয়েছে। ভিটামিন 'সি' দাঁত, মাড়ি ও পেশি মজবুত করে। তাছাড়া ভিটামিন 'সি' সর্দি-কাশি ও ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা করে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাই শরীরে ভিটামিন 'সি'র চাহিদা পূরণে বাঁধাকপিসহ অন্যান্য শাক-সবজি বেশি করে খাওয়া উচিত। লাউ ও ফুলকপি থেকে ক্যারোটিন পাওয়া যায় না। অথচ বাঁধাকপিতে অধিক পরিমাণে ক্যারোটিন থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাঁধাকপি এবং অন্যান্য উদ্ভিদ দেহে বিদ্যমান ক্যারোটিন মূলতঃ এক প্রকার লাল ও হলুদ রঙের রঞ্জক পদার্থ, যা খাওয়ার পর পাকস্থলিতে ভিটামিন 'এ' সৃষ্টি হয়। চোখের দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখা ভিটামিন 'এ'র প্রধান কাজ। শরীরে ভিটামিন 'এ'র অভাবে আমাদের দেশে এখনও প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায় এবং ১০ লাখ শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই শিশু ও ছোট ছেলে-মেয়েদের অন্ধত্ব ও রাতকানা রোগ প্রতিরোধে পরিমাণমতো তেল দিয়ে রান্না করে নিয়মিত বাঁধাকপি এবং অন্যান্য পাতা জাতীয় গাঢ় সবুজ ও হলুদ রঙের শাক-সজি বেশি করে খাওয়াতে হবে। এর ফলে শিশুদের ভিটামিন 'এ' এর ঘাটতি কমে আসবে এবং ভবিষতে তার অপুষ্টিও রোধ হবে।
মুলাশাকের চেয়ে বাঁধাকপিতে বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে। বাড়ন্ত শিশুর হাড় ও দাঁত গঠনের জন্য প্রচুর ক্যালসিয়াম দরকার। তাছাড়া সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় প্রসূতি মায়ের খাবারে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকা প্রয়োজন। আবার লাউশাক ও লালশাকে লৌহ নেই। অথচ বাঁধাকপিতে কিছু পরিমাণে লৌহ থাকে। দেহে লৌহের অভাব হলে শরীরে অপুষ্টিজনিত রক্ত শুন্যতা রোগ দেখা দেয়। ছোট ছেলে-মেয়েরা এবং গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা অতি সহজেই এরোগের শিকার হয়। কাজেই শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের সুস্বাস্থ্যের জন্য বাঁধাকপি অত্যন্ত উপকারী সবজি। বাঁধাকপিতে ভিটামিন 'ই' বা টোকোফেরল আছে। বন্ধ্যাত্ব নিবারণে এ ভিটামিন সহায়তা করে। তাছাড়া বাঁধাকপিতে ভিটামিন 'কে' থাকে। এ ভিটামিন Prothrombin নামক এক পদার্থ তৈরী করে যা শরীর কেটে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করার পাশাপাশি বাঁধাকপি দেহের রোগ-প্রতিরোধ ও নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাঁধাকপিতে রয়েছে ইনডলস নামক ক্যান্সার প্রতিরোধক উপাদান। ইনডলস অন্ত্র এবং মলদ্বারের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। তাছাড়া এসবজিতে প্রচুর জেনিষ্টেন রয়েছে। স্তন, প্রষ্টেট ও মস্তিষ্কের ক্যান্সার প্রতিরোধে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বাঁধাকপি খুবই উপকারী। বাঁধাকপি আলসার নিরাময়েও ভূমিকা রাখে। চিকিত্সা বিজ্ঞানীদের মতে, বাঁধাকপিতে গ্লুটামিন নামক এক ধরণের এ্যামাইনো এসিড রয়েছে, যা পাকস্থলীতে রক্ত প্রবাহ বাড়ায় এবং পাকস্থলীর আবরণী কলাকে কর্মক্ষম রাখতে সহায়তা করে। এভাবেই চিকিত্সা বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে সুনিশ্চিত হয়েছেন যে, বাঁধাকপি আলসার নিবারণ করে। বাঁধাকপিতে আঁশ থাকায় এটি দেহের হজমের কাজে সহায়তা করে। তাই পর্যাপ্ত বাঁধাকপি খেলে কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর হয় এবং শরীর সুস্থ থাকে।
বাঁধাকপি ব্যঞ্জন ও ভাজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। ইদানিং সালাদ হিসেবেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। সালাদ হিসেব বাঁধাকপি কাঁচা খাওয়া হয় বলে এতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানসমূহ অবিকৃত অবস্থায় আমাদের দেহ কর্তৃক গৃহীত হয়। সুতারাং দেহের পুষ্টি সাধন এবং দেহকে সুস্থ-সবল ও নিরোগ রাখার জন্য শিশু ও পূর্ণ বয়ষড় লোকের মৌসুমে সময় বেশি করে বাঁধাকপি এবং অন্যান্য শাক-সবজি খাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
* এই রকম আরও লাগলে একবার এখান থেকে ঘুরে আসুন ।