বাজারটা ছোট হলেও ঐতিহাসিক। সকালের দিকে ভারি সুন্দর। মানুষে ভরা থাকে। পাশের বড় তিন চারটি বাজারে ডাকঘর নেই। এ গল্পটা অনেক আগের। আমার স্কুল জীবনের। তখন পর্যন্ত আশপাশের তিনটি ইউনিয়নের বড় একটি অংশের ডাকঘর ছিলো আমাদের বাজারে। সকালে অনেকে আসতো চিঠি পোস্ট করতে, অনেকে আসতো প্রিয়জনের পাঠানো চিঠি নিয়ে যেতে। দু’পক্ষের চেহারাতে চিঠি চিঠি ঝিলিক থাকতো। আর ডাকঘরের পিয়ন, সেতো ভারি ঝলমলে মানুষ। সকালে বাজারে আসা শত মানুষের ভিঁড়। কিন্তু ওই দূর থেকেও তাকে দেখা যেতো একেবারে স্পষ্ট। আশপাশের সবাই অনাকংখিত বলে ওদের জলছাপ দেখা যেতো।
আমার দু’মামা বিদেশ থাকতেন। পরবর্তীতে এক কাকা ও বোন জামাইও বিদেশ গিয়েছিলেন। ডাকঘরের সাথে আমাদের পরিবারের নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। মামা চিঠি পাঠাতেন। পিয়ন এসে আমাদের দোকানে দিয়ে যেতো। বাবা চিঠিটা উনার পুরোনো হিসেবের খাতার স্তুপের উপর রাখতেন। আমি সকালের দিকে একবার দোকানের গদিতে উঠে চেক করে যেতাম কোন চিঠি এসেছে কিনা। বাজার আর স্কুল পাশাপাশি। আবার আমাদের বাড়িও এর পাশেই। দৌড়ে গেলে দুই মিনিটের বেশি না। হাঁপাতে হাঁপাতে মা’কে গিয়ে বলতাম, মামার চিঠি এসছে। মা জানতেন বাবা চিঠি আমার কাছে দিবেন না, তবুও চিঠি নিয়ে গেলাম না কেন, এর জন্য বকা খেতাম। আসলে মা তার ভাইকে খুব ভালোবাসেন।
স্কুলের বিরতির সময় ভোঁ দৌড় মেরে ঘরে যেতাম। বাবার রুমের টেবিলের উপর রাখা চিঠি খুলে পড়া শুরু করতাম। তিনটা চিঠি থাকতো। বাবার একটা, মা’র একটা আর আমাদের ভাই বোনদের জন্য একটা। বাবারটা বড় হতো। প্রতিবারই কমন কিছু কথা দিয়ে বাবার চিঠিটা বড় করা হতো। চিঠির আকার দেখেও শিখতাম আমাদের পরিবারে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ! যখন আমি নতুন নতুন চিঠি পড়া শিখেছি, তখন আমার অংশটা একেবারে ছোট থাকতো। আমার বড় দু’বোনের অংশ বড় থাকতো। অন্তত ছয় সাত লাইনতো হবেই। আমার জন্য দু’লাইনের বেশি না। কিন্তু যখন থেকে আমিও মামার কাছে চিঠি লিখতে শুরু করলাম, মামা তখন খুশি হয়ে আমার জন্য একটা আলাদা চিঠি লিখতেন। ওটা অন্য কিছু না।ভাইগনা বড় হচ্ছে, সেটার উদযাপন। মামা নিজে চিঠি লিখতে পারতেন না। যাকে দিয়ে লেখাতেন, তার হাতের লেখা আমার চাইতে সুন্দর ছিলো। উনার লেখা নকল করতে করতে নিজের হাতের লেখা সুন্দর করেছিলাম। এ সুন্দর করার তাগিদ আবার অন্য কিছু ছিলো। বড়বোনের সাথে প্রতিযোগিতা। তার হাতের লেখা অনেক সুন্দর।
বাবা নিজের চিঠি নিজেই লিখতেন। মা’র চিঠি বড়বোনে লিখে দিতো। বড় হওয়ার পর জোর করে আমি নিয়ে নিতাম। মা পাশে বসে বসে বলতেন, আর লিখতাম। মা’র বলা অনেক সুন্দর ছিলো, তাই যা বলতেন তা লিখতাম। আমার মেজোবোন আবার এসব দিকে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু মা, বড়বোন আর আমার আগ্রহের শেষ ছিলো না।
ততোদিনে আমাদের বাড়ির পাশের দু’একজন বিদেশে পাড়ি দিলেন। তারাও চিঠি পাঠাতেন। আশপাশের চার পাঁচ বাড়ির মধ্যে আমরা ভাইবোনরা ছিলাম পড়ুয়া। তাই প্রতিবেশীদেরকে চিঠি লিখে দিতে হতো এবং বিদেশ থেকে আসা চিঠিগুলো পড়ে শোনাতে হতো। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। মানুষের কতো গোপন কথা যে, শুনে ফেলতাম! চিঠি লেখা এবং পড়ার জন্য আমার বোনের ব্যস্ততা ছিলো দেখার মতো। আমি বড় হওয়ার পর বোন আমাকে রেফার করতো। ছেলের কাছে মা’র লেখা, ভাইয়ের কাছে বোনের কিংবা ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের চিঠিগুলো আমি লিখতাম। কৌতুহল ছিলো স্বামীর কাছে স্ত্রীর চিঠি লিখে দেয়া এবং স্ত্রীর কাছে পাঠানো স্বামীর চিঠিগুলো পড়ে দেয়ার বিষয়ে। বিয়ের পর যখন বড়বোন স্বামীর বাড়িতে বসত গড়লো, তখন প্রতিবেশীদের জন্য আমি ছাড়া আর কোন গতি ছিলো না।
পাশে বসে এক গৃহবধু তার স্বামীর উদ্দেশ্যে বলছে, “আপনার কথা আমার খুব মনে পড়ে। ঘুম আসে না। গভীর রাতে কান্না আসে...।“ কথাগুলো লিখতাম আর দুষ্টু দুষ্টু মনে কতো কিছু ভাবতাম! পাশের বাড়ির এক ভাবীর নাম ছিলো বুলবুলি। তার স্বামী তার কাছে লেখা প্রতিটি চিঠি শুরু করতো “ওগো আমার পরানের বুলবুলি” দিয়ে। ওই ভাবীকে আমি ডাকতামই ‘ওগো আমার পরানের বুলবুলি বলে।‘ বুলবুলিকে যে চিঠি লিখে দিতাম, তার শুরু হতো সেই চিরাচরিত লাইন দিয়ে। “প্রিয়তম, পত্রের প্রথমে আপনার প্রতি রইলো আপনার হাতে লাগিয়ে যাওয়া গন্ধরাজ ফুলের শুভেচ্ছা।“
এর মাঝেও ঘটনা ঘটে যেতো। পারিবারিক ঝগড়ার চিঠিগুলো বেশ বৈচিত্রময় হয়তো। শ্বাশুড়ি করতো বৌয়ের বদনাম, বৌ করতো শ্বাশুড়ির। আবার বিদেশ থেকে ছেলেও কম যায় না। বেশ বুদ্ধিমান। মাকে বকে বৌকে ঠিক করতো, বৌকে বকে মাকে। মনটা খুব আকুপাকু করতো বৌয়ের কথা শ্বাশুড়িকে বলে দিতে, শ্বাশুড়ির কথা বৌকে। আমার মা খুব জোর দিয়ে মানা করতেন। বলতেন ওদের সংসারে অশান্তির কথা। এসব বললে আগুন আরো জোরে জ্বলবে। তাই কখনো বলিনি।
এ চিত্র বেশিদিন ছিলো না। এলাকায় অনেক ছেলেমেয়েই তখন চিঠি লিখতে পড়তে পারতো। নাইন টেনে থাকতে স্কুল বন্ধুদের প্রেমপত্র লিখে দিতাম। ছোটবেলা থেকে কবিতা লিখতাম বলে প্রেম প্রেম বাক্য বেশ বানাতে পারতাম। আহারে, সেসব ন্যাকামো ন্যাকামো কথাগুলো! আর প্রেমের উপন্যাস থেকেতো শিখতামই।দশম শ্রেনীতে উঠে নিজের জন্য প্রথম প্রেমপত্র লিখি। গভীর রাতে লিখতে বসে মা’র হাতে ধরা খেলাম। বড় বোন বাঁচালেন। সে চিঠিতে একটি ইংরেজি বাক্য ছিলো। ‘আই লাভ য়্যু হার্ট এন্ড সোল!’ বন্ধু জয় এটা নিয়ে আমাকে খুব ক্ষ্যাপাতো। এখন মনে পড়লে নিজে নিজেই হাসি। ওই একটাই ইংরেজি বাগধারা শিখেছিলাম বোধহয়। তারও আবার ব্যবহার করে ছাড়লাম।
তারও অনেক পরে দারুন ঘটনায় বরিশালের শারমিন আপুর সাথে পরিচয় হলো। আপু তখন সিলেটে বেড়াতে এসেছিলেন। ওই ফ্ল্যাটে আমার এক বন্ধুর বোন থাকতো। সে বোনের সাথে শারমিন আপুর ভালো ভাব ছিলো। বন্ধু সিলেটে বেড়াতে গেলে ফোনের দুষ্টুমিতে শারমিন আপুর সাথে ভালো সম্পর্ক হলো। আপু বলেছিলেন বরিশাল গিয়েই আমার কাছে চিঠি লিখবেন। বলেছিলাম আমি আগে লিখবো। জেতার জন্য আর বরিশাল না গিয়ে সিলেট থাকতেই অদ্ভুত সুন্দর এক চিঠি আমাকে পাঠালেন। সাথে একটি গ্রিটিংস কার্ড। এ প্রথম আত্মীয় স্বজনের বাইরের কারোর চিঠি হাতে পেয়ে এক কথায় আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। কতোবার যে ওই চিঠি পড়েছি, তার কোন সঠিক হিসাব নেই। ওটা ছিলো আমার মন খারাপের অষুধ। টনিকের মতো কাজ করতো।
শারমিন আপুর সাথে আমার অনেক চিঠি চালাচালি হয়েছিলো। কত যত্ন করে সেসব চিঠি লিখতাম! বেশিরভাগ সময় চিঠির প্যাড নিজে বানিয়ে নিতাম। অথবা দোকানের সবচেয়ে সুন্দর প্যাড থেকে একপৃষ্ঠা নিয়ে যেতাম। ঠিক এ মুহূর্তে চিঠি লেখার সেই স্বাদ আমি পাচ্ছি। অসাধারণ বলেই ক্ষান্ত হই। ওই সময় আমাদের বাজারে একটা মাত্র মোবাইল দোকান। কলরেট ১০ টাকা মিনিট। সাধ্যে কুলাতো না। তবুও মাসে অন্তত একদিন ত্রিশ বত্রিশ মিনিট কথা না বললেই নয়। শুধুতো শারমিন আপু না। উনার মা বাবা, ভাবী, ভাতিজা ভাতিঝি সবার সাথে কথা হতো। কিন্তু আজ পর্যন্ত উনার সাথে দেখা হয়নি। উনার ভাতিজা শাওনের সাথে দেখা হয়েছে একবার সিলেট বেড়াতে গিয়ে। এবার নিশ্চিত দেখা হবে। কারণ উনার শ্বশুর বাড়ি খুলনা, আমারো। এরমাঝেও অবশ্য দু’বার দেখা করতে চেয়েও হয়নি। আমি খুলনা গেলে উনি বরিশাল থাকেন।
এরপর আর নয়। কাউকে কখনো চিঠি লেখা হয়নি। শারমিন আপুই শেষ। এক সময় প্রেমিকার জন্য প্রায়ই চিঠি লিখতাম, কিন্তু সেসব চিঠি পাঠানো হতো না। প্রতিটি এ ফোর সাইজের অফসেট পেপারের এপিঠ ওপিঠ ভরা থাকতো তাকে হারানোর ভয়। এ ভয়েরই জয় হয়েছিলো। সে চিঠিগুলো এখনো আমার কাছে আছে। গ্রামের বাড়িতে পুরোনো কোন কাগজের স্তুপে আছে হয়তো।
তবে আমি এখনো চিঠি পাই। বৌয়ের সাথে ঝগড়া লাগলে বৌ আমাকে চিঠি দেয়। বৌয়ের চিঠি বলে নয়, কেবল চিঠি বলেই নিমিষে ওর প্রতি আমার রাগ নিভে যায়। এরকম অপ্রচলিত আচরন কার না ভালো লাগে বলুন। গোমরা মুখ নিয়ে কাছে এসে নিচের দিকে তাকিয়ে ভাঁজ করা চিঠিটা বাড়িয়ে দেয়। প্রথমদিন ভ্যাবচ্যাকা খেয়েছি। পরে যতোবার দিয়েছে ততোবারই একটা মুচকী হাসি দিয়ে চিঠিটি নিয়েছি। যদিও চিঠি ভর্তি থাকে অভিযোগের সুরতে তার যতো ন্যাকামি, তবুও চিঠিটি পড়ার পর আমি আমার ন্যাক্যামোগুলো বাতিল করে দিই। তার সাথে স্বাভাবিক হয়ে যাই।
এখনো চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে। খুব বেশি ইচ্ছে করে মৃত বড়বোনের কাছে লিখতে। যার কাছে চিঠি লেখা শিখেছি। যে ছিলো আমার লেখালেখির প্রথম মনযোগী পাঠক। বলেছিলো কবিতার বই বের করার টাকা দিবে। সে অসমাপ্ত পান্ডুলিপি পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিলাম। পান্ডুলিপি শেষ হওয়ার আগে আপু শেষ হয়ে গেলো। তাকে একটা চিঠি লিখতে চাই। কিন্তু কবরে চিঠি পাঠানোর কোন ডাকঘর নেই, ডাক হরকরা নেই! যদি থাকতো তাহলে সে ডাকঘরের নাম হতো "কবরবাড়ি ডাকঘর।"