ধন্য ধন্য মেরা সিলসিলা,
এলো দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া
সাম্প্রতিক সময়ের অতি জনপ্রিয় একটি গান। বহুল প্রচলিত গানটি বর্তমানে যেভাবে গাওয়া হয়, তাতে এর অর্থ বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। আর অর্থ বের করা গেলেও, সেটা সঙ্গতিপূর্ণ লাগে না (পৃথিবীর সব গান কিংবা কবিতার যে নির্দিষ্ট কোন অর্থ থাকতেই হবে, এমন কোন আইন-ও নেই)। তবে "দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া" গানটির মাঝে একটা কাহিনী আছে। সেসব বিষয় নিয়েই আজকের পোস্ট। অবশ্য এই অলস সময়ে কাজের কথার চেয়ে গল্প হবে বেশি।
বেশিরভাগ শিল্পীর গানে যে কথাগুলো পাওয়া যায়, আগে সেটা দিয়ে শুরু করি-
ধন্য ধন্য মেরা সিলসিলা,
এলো দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া ৷
(সিলসিলা বলতে এখানে আধ্যাত্মিক চর্চার ধারাবাহিকতাকে বোঝাচ্ছে)
শয়নে স্বপনে দেখি আসিলো এক বুজুর্গান,
রাস্তার মাঝে কতো লোকে করিতেছে সন্ধান,
রাস্তা থামায়ে দিলো কাফেলা,
এলো দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া।
(বাংলায় "শয়নে স্বপনে" শব্দদ্বয় দ্বারা স্বপ্ন দেখা না বুঝিয়ে, সর্বক্ষণ বোঝায়। যাই হোক, গায়ক স্বপ্নে এক জ্ঞানী ব্যক্তির দেখা পেয়েছেন, যাকে "রাস্তার মাঝে" সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। )
মানত করেছি আমি বড় পীরের দরবারে,
কেমন করে দেবো চাদর দেহ-ওলীর মাজারে,
কেমন করে দেবো চাদর নিজামের ঐ মাজারে।
(গায়ক হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর মাজারে চাদর দেবেন। অনেকে এখানে গেয়ে থাকেন, "সওদাগরে কয় মানত করছি, বড় পীরের দরবারে"। বোঝা মুশকিল, তাদের গানের মাঝে হঠাৎ করে এই সওদাগরের কথা কোথা থেকে এলো!
প্রায় সবাই দ্বিতীয় লাইনটিতে দেহ-ওলী বলে থাকেন। এই শব্দটির আদতে কোন অর্থ নেই। নাসিরুদ্দির দেহেলভী নামে নিজামুদ্দিনের এক বিখ্যাত শিষ্য আছেন। তার কথাও হচ্ছে না, কারণ তৃতীয় লাইনে আবার নিজামুদ্দিনের নাম এসেছে।
গায়কের অভিপ্রায় ছিলো জিলানীর কবরে চাদর দেবেন। তার বদলে তিনি নিজামুদ্দিনের কবরে চাদর দিতে চাচ্ছেন না। প্রশ্ন হলো, তাকে কে নির্দেশ দিয়েছে, নিজামুদ্দিনের কবরে চাদর দিতে হবে!)
হাসানে কয় লালমিয়া ভাই কোন খবর পাইছোনি,
বালুরঘাটে কে আসিলো ইসরাঈল শাহ নিজামী,
রাস্তা থামায়ে দিলো কাফেলা,
এলো দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া।
(কোন একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির আগমনের কথা এখানে বলা হচ্ছে। ইয়ে মানে, প্রথম অন্তরার বুজুর্গ ব্যক্তির কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় অন্তরায় যে চাদর দিতে চেয়েছিলো, তার কি হবে? হু কেয়ার্স! স্টোরিলাইন অসম্পূর্ণ রেখে, একদম বিপরীত এক প্রসঙ্গের অবতারণা করে গান শেষ হয়ে যায়।)
এবার আসা যাক মূল পোস্টে। সুফী সাধকদের মতে সিদ্ধিলাভের চারটি স্তর আছে - শরীয়ত, তরীকত, হকিকত ও মারফত। শরীয়তের সব কথা মেনে জীবন-যাপনের পর, একজন আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করাই তরীকত। চিশতীয়া-ও তেমনি এক তরীকত পন্থা। আফগানিস্তানের চিশত শহরের থেকে এই নামটি এসেছে। আর একে জনপ্রিয় করে তোলেন মঈনুদ্দিন চিশতী; যার কবর আজমীর শরীফ নামে পরিচিত।
এই মঈনুদ্দিনের প্রধান শিষ্য ছিলেন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার (যার নামে আমাদের ফরিদপুর জেলার নাম হয়েছে)। কুড়ি বছরের এক পিতৃহীন যুবক সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন এই বাবা ফরিদের ভক্ত বনে যান। টানা তিন বছর পাঁচশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ফরিদউদ্দিনের কাছে যাবার পর, নিজামুদ্দিন তার কাছ থেকে চিশতীয়া তরীকা প্রচারের অনুমতি (খিলাফত) পান। নিজামুদ্দিন দিল্লীতে ফিরে এসে ধর্ম প্রচারের কেন্দ্র গড়ে তোলেন। গানে তার এই প্রত্যাবর্তনের কথা উঠে এসেছে।
মূল গানটি আসলে এরকম:
ধন্য ধন্য মেরা সিলসিলা,
এলো দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া।
ভারতের এক সওদাগর একিনে মানত করে,
নিজের হাতে চাদর দিবে বড় পীরের মাজারে,
রাস্তায় থামাইয়া দিলো কাফেলা,
এলো দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া।
(একিন বা ইয়াকিন মানে বিশ্বাস আর বড় পীরের মাজার ইরাকের বাগদাদে অবস্থিত।)
সওদাগর স্বপনে দেখে আসিয়া এক বুজুরগান,
রাস্তার মাঝে অনেক বিপদ বলিতেছে তার সন্ধান,
নিজামীর মাজারে চাদর দাও গিয়া।
(সওদাগরের স্বপ্নে এক বুজুর্গ তাকে ইরাকে যেতে নিষেধ করেন। কারণ পথিমধ্যে সওদাগরের বিপদ হবে। তার বদলে চাদরটি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কবরে দিতে বলেন।
এখানে মজাদার এক ব্যাকরণগত বৈপরীত্য পাওয়া যায়। আউলিয়া শব্দটি আসলে আরবী ওলী-এর বহুবচন, যার অর্থ বন্ধুগণ। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় আউলিয়া কথাটি একবচন হিসেবে প্রচলিত। অপরদিকে বুজুর্গান হলো বাংলা বুজুর্গ শব্দটির বহুবচন। সম্ভবত গীতিকার ভুলবশত এখানে বুজুরগান শব্দটি ব্যবহার করেছেন।)
সওদাগর কয়, মানত করছি বড় পীরের মাজারে,
কেমন করে দেবো আমি দেহেলীরো মাজারে,
বুজুরগান ধমক দিলো রাগ হইয়া।
(সওদাগর নিজামুদ্দিনের কবরে চাদর দিতে চাচ্ছেন না। দ্বিতীয় লাইনের দেহেলী বলতে দিল্লী বোঝানো হচ্ছে, যেটা কিনা দিল্লীর আদি নাম। সেখানে নিজামুদ্দিনের কবর অবস্থিত।
উচ্চারণের ভুলে অনেক গানের অর্থই পাল্টে যায়। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে রাধারমণ দত্তের "ভ্রমর কইয়ো গিয়া" গানের কথা। রাধারমণ এই গানের অন্তরায় লিখেছিলেন, "মাথার কেশো দুই ভাগ করি, রাখিতাম বান্ধিয়া রে ভ্রমর..."। বোধকরি ছন্দের সুবিধার্থে রাধারমণ "কেশো" লিখেছিলেন। দুই বাংলার অনেক শিল্পীই শুনলাম "মাথার কেশর দুই ভাগ করি" বলছেন। সিংহ, ঘোড়ার ঘাড়ের চুল হলো কেশর। বাঙালী জাতি যতোই তেজী/সাহসী হোক না কেন, আমাদের মাথার চুলকে কেশর বলার জো নেই। অনেক হিল্লি দিল্লি করলাম, আবার গানে ফিরে যাই)
বাগদাদে আমি হইলাম মাহবুবে সোবহানী,
দিল্লীতে আমি হইলাম মাহবুবে এলাহী,
সওদাগর ভয়ে উঠলো কাঁপিয়া।
(এই অন্তরাটির খুব বেশি ব্যাখ্যা না করাই ভালো। এখানকার মূল কথা হলো, মর্যাদাগত দিক থেকে দুটো মাজারই সমকক্ষ।)
রাত্র যখন প্রভাত হলো ফজরেরই আজান দেয়,
চাদর লইয়া সওদাগরে নিজামীর মাজারে যায়,
নিজের হাতেই দিলো চড়াইয়া।
হাসানে কয়, লাল মিয়া ভাই বুঝলাম না কিছুই আমি,
বালুরঘাটে কে আসিলো ইসরাইল শাহ নিজামী,
ইশারায় নিও সবে বুঝিয়া,
এলো দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া।
(সাধারণত লোকগীতির শেষ অন্তরায় গীতিকার নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন। এভাবে নিজের নাম জুড়ে দেওয়াকে "ভণিতা" বলে। এই গানটি লিখেছেন হাসান চিশতী নিজামী। লাল মিয়া বলতে এখানে সম্ভবত গায়ক লাল মিয়া বয়াতিকে বোঝানো হচ্ছে। আর ইসরাইল শাহ নিজামী তরিকার একজন পীর। লালবাগের জগন্নাথ সাহা রোডে তার মাজার আছে।)
এই ছিলো দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া গানের গল্প। লক্ষ্য করবেন, মূল গানের সেতুবন্ধনে "নিজামুদ্দিন আউলিয়া"-এর সাথে ছন্দ মেলাতে প্রতিবার নতুন বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে (চাদর দাও গিয়া, ভয়ে উঠলো কাঁপিয়া, ইশারায় নিও সবে বুঝিয়া ইত্যাদি)। কিন্তু সবাই গাওয়ার সময় প্রতিবার একই সেতুবন্ধন ব্যবহার করে (রাস্তায় থামাইয়া দিলো কাফেলা, এলো দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া)। গীতিকারের নাম উল্লেখ করা দূরে থাক, তার গানের কথাও পাল্টে ফেলেছে সবাই। এই গানের মাধ্যমে মূলত আব্দুল কাদির জিলানী, নিজামুদ্দিন ও ইসরাইল শাহকে একই সিলসিলার কাতারে ফেলা হয়েছে।
যাযাবরের দৃষ্টিপাতে নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে নিয়ে মজার এক গল্প পাওয়া যায়। নিজামুদ্দিনের মাত্রাতিরিক্ত জনপ্রিয়তার কারণে তিনি তৎকালীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। সুলতান এই পথের কাঁটাকে সরানোর আগেই খবর এলো বাঙাল মুলুকে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সুলতান ঘোড়া ছোটালেন সেদিকে।
বাংলা জয় করে সুলতান দিল্লীর পথে পা বাড়ালেন। ভক্তরা নিজামুদ্দিনকে সালতানাৎ ছেড়ে পালাতে অনুরোধ করলে, তিনি মৃদু হেসে বলেন : "দিল্লি দূর অস্ত", দিল্লী এখনো বহুদূর। নিজামুদ্দিনের কথা ফললো। দিল্লী পৌঁছানোর আগেই গিয়াস উদ্দিন এক দুর্ঘটনায় মারা পড়লেন। জয় হলো নিজামুদ্দিনের।
পাদটীকা :
১. এই লেখার মাধ্যমে কোন ধর্মীয় ব্যক্তিকে তারিক অথবা বিদ্রূপ করার অভিপ্রায় আমার নেই। লেখায় প্রচুর ভ্রান্তি (তথ্যগত, ব্যাখ্যাগত) থাকার কথা। এমন কিছু পেলে সূত্রসহ জানাবেন, শুধরে দেব।
২. নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে নিয়ে বিভিন্নস্থানে পরস্পরবিরোধী তথ্য পেয়েছি। আইন-ই-আকবরী বইতে নাকি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জীবনী আছে। বইটি লিখেছেন সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল। এই পোস্টটি লেখার উদ্দেশ্যে সেই বইটিও পড়েছি। আইন-ই-আকবরী'র প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে এমন কিছু নেই। তৃতীয় খণ্ডে শুধুমাত্র নিজামুদ্দিনের মাজারের উল্লেখ আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ডটি সহজলভ্য নয়।
আবুল ফজল ছিলেন আকবরের নবরত্নের একজন। তার আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে আকবরের শাসনামলের বিভিন্ন তথ্যের পাশাপাশি, রাষ্ট্রনীতি নিয়েও অনেক কথা বলেছেন। বইটাতে তাই বেশ একটা ম্যাকিয়াভেলিয়ান স্বাদ আছে। আবুল ফজল খিচুড়ী দারুণ ভালোবাসতেন। তার বাড়িতে নাকি প্রতিদিন ৩০ মণ খিচুড়ী রান্না হতো। যে কেউ এসে সেই খিচুড়ি খেতে পারতো। তার বইতেও খিচুড়ীর সাতরকম রেসিপি পাওয়া যায়। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আইন-ই-আকবরী'র অনুবাদক জনাব আহমদ ফজলুর রহমান। ব্যক্তিগত জীবনে সরকারী আমলা এই ভদ্রলোক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী থাকাকালীন অবস্থায় গ্রন্থটি অনুবাদ করেন।
৩. ইবনে বতুতা তার সফরকালে তাবৎ সব পীর-ফকির-আউলিয়াদের মাজার দর্শন করেছেন। তার বই এসব আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের স্তুতি ও তাদের অতি-প্রাকৃতিক ক্ষমতার বর্ণনায় পরিপূর্ণ। ভারতে আসার পথে বতুতা নিজামুদ্দিনের গুরু বাবা ফরিদের মাজার ঘুরে আসেন। এমনকি সিলেটে এসে হযরত শাহ জালালের সাথেও দেখা করেছেন। সেই ইবনে বতুতার বইতে নিজামুদ্দিন সম্পর্কে কোন কথা আমার চোখে পড়েনি। অথচ বতুতা দিল্লীতে ছয় বছর অবস্থান করেছিলেন। সেখানে তিনি গিয়াস উদ্দিনের পুত্র মোহাম্মদ বিন তুঘলক (যার কারণে "তুঘলকি কাণ্ড" শব্দটি এসেছে)-এর অধীনে বিচারক হিসেবে চাকরি করেন। এতদিন দিল্লী থেকেও নিজামুদ্দিনকে তার এমন ঔদাসীন্য আমাকে বিস্মিত করেছে।
৪. বড় পীর আব্দুল কাদির জন্মেছিলেন ইরানে। মাতৃভাষায় তার নাম লেখার সময় ফার্সি "گ (গাফ)" হরফটি ব্যবহৃত হয়, যার উচ্চারণ বাংলা "গ"-এর মতো। আরবীতে তার নাম লেখার ক্ষেত্রে "ج (জিম)" হরফটি ব্যবহৃত হয়, যার উচ্চারণ বাংলা "বর্গীয় জ"-এর মতো। কিন্তু যেহেতু আমরা তাকে আব্দুল কাদির গিলানি না বলে জিলানি বলি, তাই পোস্টেও জিলানি লেখা হয়েছে।
৫. দিল্লীতে নিজামুদ্দিন আউলিয়া গানের অনুকরণে অন্তত আরো দুটো গানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। একটা হলো "মাথার ব্রেন খাটায় বানাইসে জেলখানা"। আরেকটি হলো, শরীফ উদ্দীনের "ও বন্ধু লাল-গোলাপী"। গানটি "অ্যাট 18 : অলটাইম দৌড়ের উপরে" টেলিফিল্মের কল্যাণে রাতারাতি সবার মুখে ছড়িয়ে যায়। শরীফ উদ্দীনের "বোরকা পড়া মেয়ে", তাবিজ ফারুকের "ভালোবাসি কানে যায় না", ওয়েস্টার্ন মিলনের "তুমি যেন আমার এ দুটি আঁখি" গানগুলো বছর দশক আগে সামু ব্লগের ক্রেজ ছিলো। সেই দিনগুলোর কথা কি কারো মনে পড়ে?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৩:০৫