দাগ নেই তো শেখাও নেই
-"বলছি...এহহে কৈ মাছটা মনে হয় এসেছে। তুই একটু বস।" বলেই মিলি খালা উঠে গেলেন।
এমন কথোপকথন মাঝ পথে থামিয়ে দিলেই তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। জয়িতা মিলি খালার পিছ পিছ রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো। খালা মাছের তরকারি নামিয়ে রাখছেন।
-আর কি ব্যাপার আছে?
-"উহুঁ, এখন আর এসব খুনোখুনি নিয়ে কোন কথা নয়।" খালা তার "ট্রেডমার্ক" লাল ফ্রাইং প্যানে কাবাব ভাজতে ভাজতে মাথা ঝাঁকালেন। "আগে গোসল,-খাওয়া শেষ করে নে। তারপর এটা নিয়ে কথা বলা যাবে।"
ক্ষণকালের জন্য জয়িতার মনে হলো রেগে তেতে উঠবে, কিন্তু তারপরেই বুঝলো জেদ করে লাভ হবে না। খালা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা থেকে তাকে নড়ানো যাবে না। জয়িতা ঝড়ের গতিতে গোসল শেষ করে, ডাইনিং টেবিলে বসে গেল। এমনিতে সে খুব একটা খেতে চায় না, কিন্তু আজ পারলে একেকবারে দুই-তিন গ্রাস মুখে পুরে ফেলে।
"শোন তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলেই তো হবে না। আমারও তো শেষ করতে হবে।" বলে খালা আরো দু চামচ ভাত জয়িতার প্লেটে তুলে দেন। জয়িতা প্রথমে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করেও থেমে যায়। কিছু না বলে চুপচাপ খেতে থাকে।
খাওয়া (এবং বাসন ধোয়া) শেষ করে খালা বারান্দার রকিং চেয়ারে গিয়ে বসলেন, হাতে উলের সোয়েটার। জয়িতা তার পাশেই ছোট একটা টুল নিয়ে বসলো।
-তোর প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে, আমাকে খুনটা নিয়ে বল। এই ঘটনাটার শুরু থেকেই তুই আছিস। ছোটখাট কোন ডিটেইলস-ও বাদ দিবি না।
জয়িতা বলতে শুরু করলো। তার স্মৃতিশক্তি ভালো, তার উপর এই বিষয়টা নিয়ে নিয়মিত লেখায় সবকিছু খুব গুছিয়ে বলতে পারলো। খালা সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, কি জানি ভাবছিলেন।
-কি হলো? কি ভাবছো বলো?
-দেখ এই খুনের ঘটনায় আমার প্রথম যে খটকাটা লেগেছে তা হলো, চায়ের দাগ লেগে থাকা চামচ দুটো। একটা মানুষ অযথা দুটো চামচ ব্যবহার করবে না। দুটো চামচ দাগ লেগে থাকার প্রধানত দুটো কারণ হতে পারে। এক: সে আগে একবার চা খেয়েছে। পরেরবার চা খাবার সময় অন্য চামচ ব্যবহার করেছে। কিন্তু এই ছেলেটার ঘর দেখলাম গোছানো; ঘরের পর্দা-চাদর পরিষ্কার, রান্নাঘরের প্রতিটি জিনিস ঝকঝক করছে। তারমানে এর পরিষ্কারের বাতিক আছে। সুতরাং আরেক কাপ বানানোর আগে সে অবশ্যই প্রথম চামচটা ধুয়ে ফেলবে। খালা সোয়েটার বুনতে বুনতে বলে চললেন:
আরেকটা কারণ হলো: তার সাথে আরেকজন ছিল। দুটো কাপ তাই দুটো চামচ। টেবিলে একটা টি-ব্যাগ ছিল, পরে তোর তোলা ছবিতে দেখলাম ট্র্যাশবিনে আরেকটা টি-ব্যাগ। এইসব এলাকাতে দুপুরের মাঝেই ময়লা নিয়ে যায়। তার মানে এটা সকালের কোন টি-ব্যাগ নয়, এই টি-ব্যাগটা বিকালের পরে ব্যবহার করা হয়েছে। হতে পারে, রুলিন যার সাথে শেষ কাপ চা খেয়েছে সেই খুনী। এই চায়ের দুটো চামচ থেকেই সন্দেহ হলো, পরের ছবিগুলো দেখলাম।
ক্ষুরধার
লাশের ছবিগুলো দেখ, আঘাতের চিহ্নগুলো লক্ষ্য কর। কোপানো হয়নি বরং অনেক ধারালো কিছু ব্যবহার করা হয়েছে। সম্ভবত খুব ধারালো একাধিক ছুরি ইউজ করেছে, যেটা কিনা খুব সহজেই জামার নিচে লুকিয়ে রাখা যাবে। একাধিক ছুরির কথা কেন বলছি? শরীর আর গলায় প্যাটার্ন মেনে নিখুঁতভাবে ছুরি চালানো হয়েছে আর মৃত্যু সেকারণেই হয়েছে। প্রথম নাইফটা এই কাজে লেগেছে। এই নাইফের ফলাটা একটু চিকন আর কাটার দাগগুলো আড়াআড়িভাবে বাম থেকে ডানের দিকে নেমে এসেছে।
এই প্যাটার্নটাকে ঢেকে দেবার জন্য, এলোপাতাড়িভাবে স্ট্যাব করা হয়েছে। ব্যবহার করেছে মোটা ফলার একটু ভারি ছুরি। এখন প্রশ্ন হল: প্রথম ছুরির আঘাতেই যদি মরে গিয়ে থাকে, তবে স্ট্যাবিং কেন করা হলো? উত্তরটা সহজ!
প্রথম ছুরির আঘাতগুলো অনেক প্রেসাইজড। কিন্তু এতো নিখুঁত ক্ষতের দাগ দেখলে অটোপ্সির সময় ডাক্তারের সন্দেহ হবে। যাকে আঘাত করা হচ্ছে, সে তো ভালো মানুষের মতো শুয়ে খুন হওয়ার কথা না। প্রশ্ন জাগবে, তবে কি খুনের সময় ভিকটিম অচেতন ছিল? কিন্তু মাথায় তো আঘাত করা হয়নি। তারমানে খুনী ঘুম পাড়িয়েছে বা অন্য কোনভাবে বেহুশ করেছে।
খুনী বেশ সাবধানী। টি-ব্যাগ ফেলে দিয়েছে, চায়ের কাপ সে ধুয়ে রেখেছে। খুব সম্ভবত সে চায়ের মাঝে খুব কড়া কোন ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রেখেছিল। এতে করে পুলিশ পরিচিত কাউকে সন্দেহ করবে না। রুলিন অনলাইনে পরিচিত ছিল। দেশে পরপর কিছু ব্লগার খুন হয়েছে, রুলিনও হুমকি পাচ্ছিল। আরেকজন ব্লগার খুন হলে, সন্দেহটা স্বাভাবিকভাবেই হুমকিদাতার উপরে গিয়ে পড়বে। খুনী কপিক্যাট ক্রাইমের এই সুবিধাটা নিতে চেয়েছে। কিন্তু চামচটা সে ধোয়নি। হয়তো গুরত্বই দেয়নি। ভেবেছে, এই সামান্য জিনিস নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।
খালা থামলেন। জয়িতা এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। তার মাথায় চিন্তার ঢেউ। সেই ঢেউ পরিণত হল স্রোতে।
-"কিন্তু রুলিনকে খুন করার কি কারণ?"
-মোটিভ তো এই মুহূর্তে নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না, তবে অনুমান করা যায়। POE এর নাম শুনেছিস তো?
-রাইটার?
-নাহ, অ্যালান পো না। পি.ও.ই বা প্রসেস অফ এলিমিনেশন ব্যবহার করে মোটিভ বের করা যায়। ধরে নিচ্ছি, আর্থিক কোন কারণে খুনটা করা হয়নি। সে সচ্ছল ছিল। স্বাস্থ্য দেখে সেটা বোঝা যায়। তাছাড়া রেগুলার বাড়িভাড়া দিত। আবার গ্রামের জমি-জমা সংক্রান্ত কিছুও না। কারণ রুলিনের ঘর দেখলে বোঝা যাচ্ছে, সে সচ্ছল কিন্তু ধনী না। তাছাড়া গ্রাম থেকে এতো প্ল্যান করে এসে কেউ মার্ডার করবে না। শত্রুতা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, বাড়িওয়ালার ভাষ্যমতে রুলিন চুপচাপ থাকতো, বেশি বন্ধু ছিল না। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায়, নারী সংক্রান্ত কারণে খুন করা হয়। মাৎসর্য মানে বুঝিস তো? মাৎসর্য কাজ করে। আর কোন মেয়ের জন্য খুনটা করা হয়েছে, এটা বলার পিছনে আরেকটা কারণ আছে। রুলিনের বাথরুমে দেখলাম আরেকটা চিরুনি, ছোট দাঁতের। আর সেই চিরুনিতে মেয়েদের চুল প্যাঁচানো। মেয়েরা বড় দাঁতের চিরুনি ইউজ করে না, যেমনটা রুলিনের টেবিলে ছিল। সুতরাং ওর বাসায় রেগুলার কোন মেয়ের যাতায়াত ছিল, যার কিনা চিরুনির দরকার পড়তো। আমি কি বলতে চাইছি, বুঝতে পারছিস তো?
জয়িতা মাথা দোলালো। সে ছোট বাচ্চা না। জয়িতা আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। রিপোর্টটা কেঁচে গণ্ডূষ করতে হবে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে জয়িতা এতটাই মত্ত ছিল যে, খালার অসাধারণ বিশ্লেষণী ক্ষমতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করার বদলে আগের বিষয় নিয়েই কথা বলতে থাকলো।
-তারমানে খুনী রুলিন আর তার বান্ধবী, দুজনেরই পরিচিত...
-এবং ডাক্তার। কারণ অজ্ঞান করার জন্য যেভাবে সিডেটিভ বা ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে আর যেভাবে শরীরে "অপারেশন" চালিয়েছে, মনে হচ্ছে খুনটা কোন ডাক্তার, মোস্ট প্রোবাবলি একজন সার্জন করেছে।
জাহেদের জীবন
ডা: জাহেদ (এম.বি.বি.এস; এফ.সি.পি.এস : জেনারেল সার্জারি) কিছুটা বিরক্ত। গত এক সপ্তাহে সে তিনবার আইরিনকে ফোন করেছে, কিন্তু মেয়েটা একবারও ফোন ধরেনি। এখন তো সেই পথের কাঁটাটাও নেই, যে আইরিনের পিছু পিছু ঘুরতো। জাহেদ সমস্যাটা ধরতে পারছে না।
জাহেদ বরাবরই সমস্যাটা ধরতে পারে না। তার আটত্রিশ বছরের জীবনে কখনো ধরতেও পারেনি। সে খুব ভালো ছাত্র। সেকেন্ডারি, হায়ার সেকেন্ডারি, মেডিকেল, পোস্ট-গ্র্যাড সব পর্যায়ে ভালোভাবে পাশ করেছে। তার চারপাশের সবাইকে সে মেধার বিচারে মূল্যায়ন করতো এবং হতাশ হয়ে আবিষ্কার করতো প্রায় সবাই নিম্ন বুদ্ধিসম্পন্ন। “যত্তসব ডিজগ্রেসফুল ক্রিয়েচার্স!” আর তার এই ধারণাটা সে লুকিয়েও রাখতো না, আচার-আচরণে প্রকাশ করে দিত। এ কারণে কখনোই কোন বন্ধু হয়নি। বিয়ের জন্য যে সব প্রস্তাব আসতো, সেই মেয়েরা "কেন যেন" একবার জাহেদের সাথে কথা বলেই প্রস্তাবে না করে দিত। হাহ্, ওদের লস! এই সব মেয়েরা কখনোই তাকে বুঝবে না। একমাত্র মা তাকে ঠিকমতো বুঝতো। কিন্তু এখন মার সাথেও আগের মত দেখা হয় না। সবাই বলে মা নাকি নেই। এই অদ্ভুত কথাটা বিশ্বাস করার মত কারণ জাহেদ খুঁজে পায়নি।
এক সময় জাহেদ বিয়ে করবে না বলে ঠিক করে। কিন্তু সব পাল্টে গেল করিম স্যারের মেয়ের হলুদে গিয়ে। আইরিন! তার হাসির শব্দে যেন অনুষ্ঠানের মেয়েদের কাচের চুড়িগুলো সব ভেঙে যাচ্ছে। সে রাতে আইরিন যেদিকে যেদিকে গেল, জাহেদও সেদিকে যেতে থাকলো। এক সময় খেয়াল করলো, আইরিনের পিছে পিছে আরেকটা ছেলে যাচ্ছে। ছেলেটার ভাবখানা এমন, যেন সেও আইরিনের বন্ধু। "আরে, আইরিন তো তোকে পাত্তা দিচ্ছে না, ওর কাছ থেকে সরে যা নির্লজ্জ কোথাকার!" কিন্তু ছেলেটা সরলো না। জাহেদ বুঝলো, সরাসরি আইরিনকে অ্যাপ্রোচ করলে মেয়েটা ভুল বুঝবে। এক্ষেত্রে পাশের "ছ্যাঁচড়া ছোকরাটাকে" কাজে লাগানো যেতে পারে। শুধুমাত্র আইরিনের কাছে যাবার আশায়, রুলিনের মতো একটা "লো-লাইফ"-এর সাথে বন্ধুত্ব করলো জাহেদ।
কৌশলটা বেশ কাজে এলো। আইরিন আর জাহেদ মিলে অনেক জায়গায় খেতে আর ঘুরতে গেল (সাথে সাথে অবশ্য রুলিন ছেলেটাকেও নিতে হতো)। জাহেদের পৃথিবীতে অপার্থিব আনন্দ নেমে এলো। আইরিনের মতো কোন মেয়ের সঙ্গ সে আগে পায়নি। আর কেউ তার সাথে এতটা হেসে, ভালোবেসে কথা বলেনি। এর মাঝে রুলিনকে ফেসবুকে আর মোবাইলে হুমকি দিতো শুরু করলো কেউ একজন। তাই রুলিন আর খুব বেশি বাইরে বের হতে চাইতো না। ফলে আইরিনের সাথে দেখা হবার সুযোগটাও কমে আসতে থাকলো। কিন্তু সেটা তো জাহেদ হতে দিতে পারে না। একদিন আইরিনকে একা পেয়ে নিজের মনের কথা জানালো সে। আইরিনের রিঅ্যাকশন দেখে অবাক হয়ে গেল জাহেদ। আইরিন তাকে ভালো বন্ধু মনে করে (শুধুই একজন ভালো বন্ধু! কিন্তু কেন?) আর রুলিনকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে (জাহেদের মত ছেলে থাকতে রুলিনকে বিয়ে করবে কেন! কিছুই বুঝলাম না)।
প্রথমে রেগে গেলেও, পরে মাথা ঠাণ্ডা হলে পুরো বিষয়টা জাহেদের কাছে পরিষ্কার হলো। আইরিনের এটা স্রেফ ইনফ্যাচুয়েশন। সে মনে করছে সে রুলিনকে ভালোবাসে। ভুল! আইরিন তার অবচেতন মনে আসলে জাহেদকেই চায়, কিন্তু এই সত্যটা এখনো সে জানে না। আর এই রুলিন শু*রের বাচ্চাটা বেঁচে থাকতে সেটা জানবে বলেও মনে হচ্ছে না। এত হুমকি দিচ্ছে, কিন্তু ওকে মারছে না কেন! অকর্মার ঢেঁকি সবগুলা! এদিকে সময়ও বেশি নেই। শোনা যাচ্ছে, আইরিন আর রুলিন নাকি যে কোন দিন কাজী অফিসে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে আসবে। নাহ্, ঐ বেকুবগুলার আশায় বসে থেকে আর লাভ নেই। আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হবে।
একদিন ফোন দিয়ে জাহেদ নিজেই রুলিনের বাসায় গেল। প্রথমে ভেবেছিল, ইনজেকশন দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে ফেলবে। কিন্তু চাইলেই তো কাউকে এভাবে ইনজেকশন দিয়ে দেওয়া যায় না। তাই প্রথমে রুলিনকে চিনি আনতে বলে, ওর কফি মগে ঘুমের ওষুধ মেশালো। রুলিন ঘুমিয়ে পড়তেই ওর শরীরে Propofol ইনজেক্ট করলো। খুব কড়া অ্যানেস্থেটিক, তাই কাজ করতে বেশি সময় নিলো না। বাকি সব বেশ আরামসেই শেষ করলো। পুরো রুমে কোন ক্লু রয়ে গেলো কিনা সেটা যখন জাহেদ দেখছিলো, তখন বাথরুমে একটা জিনিস তার চোখে পড়লো। হাতের মগ নামিয়ে সে বাথরুমে ঢুকলো। একটা চিরুনি আর তাতে আইরিনের চুল লেগে আছে। আইরিনের চুলের গড়ন, ঘ্রাণ সব তার মুখস্থ। কিন্তু এখানে আইরিনের চুল এলো কি করে! তার মানে কি আইরিন আর রুলিন...নাহ সে আর ভাবতে পারে না। জাহেদ কতক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল, তা বলতে পারবে না। আর সময় নষ্ট করা যাবে না। তাড়াহুড়ো করে মগ ধুয়ে, টি-ব্যাগটা ট্র্যাশবিনে ফেলে বেরিয়ে গেল সে। বেশ আমুদে মেজাজে আছে জাহেদ। রবীন্দ্রনাথের একটা একটা গান শিস্ দিতে দিতে যাচ্ছে। অন্য কোন গান জাহেদ জানে না, গায়ও না (জাহেদের পৃথিবীতে কল্পনার কোন স্থান নেই)। শুধুমাত্র এই গানটার সাথে সে নিজের খুব মিল খুঁজে পায়।
তারপর এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে, আইরিনকে ফোন দিতে শুরু করে। কিন্তু বোকা মেয়েটা তো ফোনই ধরছে না। এখন বোধহয় মনটা খারাপ। এই মন খারাপ দুদিনেই ঠিক হয়ে যাবে। সে ফেসবুক ওপেন করে। জাহেদ ফেসবুকে খুব অ্যাক্টিভ নয়। বিভিন্ন জার্নাল আর মেডিকেল রিলেটেড পোস্ট শেয়ার করে। আর নিজের পড়া বইগুলো নিয়ে লিখতে ভালো লাগে তার (অবশ্যই নন-ফিকশন বই। একটু আগেই তো বললাম, ওর পৃথিবীতে কল্পনার কোন জায়গা নেই)। কিন্তু আজ স্ক্রল করতে করতে একটু পরেই জাহেদের আঙুল থমকে যাবে। কারণ তার এক বন্ধু জয়িতা আহমেদ নামে এক মেয়ের স্ট্যাটাস শেয়ার করেছে। আর সেই স্ট্যাটাসটায় জাহেদের জন্য চরম এক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে।
পেনাল্টিমেট
জীবনে সবকিছু গল্পের মতো হয় না। জয়িতার প্রথম রিপোর্টটা সৌমিত্রদা নিজে ইনিশিয়েটিভ নিয়ে ছাপিয়েছিলেন। অথচ এই রিপোর্টটা তিনি ছাপালেনই না। উল্টো জয়িতাকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলেন। পুলিশ ইতোমধ্যে একজনকে ধরে ফেলেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখে বোঝা যায় সেই খুনটা করেছে। সেখানে এমন সেনসিটিভ কেস নিয়ে জয়িতার এত জল ঘোলা করার কোন দরকার আছে বলে তিনি মনে করেন না। শুনেই জয়িতার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। "জল ঘোলা" মানে কি! সামিরী এক্সট্রিমিস্ট। সে সম্ভবত সত্যিই খুন করতো, তাই ওর শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু ফাঁকতালে আসল খুনী বেরিয়ে যাবে, তা তো হতে পারে না। সেই রাতেই জয়িতা পুরো রিপোর্টটা ফেসবুক নোট হিসেবে পোস্ট করলো। এতটা রেসপন্স আসবে, সেটা ও ভাবতেও পারেনি। এত এত লাইক পেতে তার ভালোই লাগছে।
রবিবার দুপুর বারোটার দিকে হঠাৎ করে জয়িতাকে ফোন দিলেন মিলি খালা।
-জয়ী, কানাডা থেকে প্রিয়ন্তী ফোন দিয়েছিল। তুই নাকি ফেসবুকে কি সব লিখেছিস।
-"হুঁ, একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম।" লাইকের নেশায় গতকাল জয়িতা একটা ভয়ানক স্ট্যাটাস দিয়ে বসেছ।
-কি লিখেছিস?
-"তেমন সিরিয়াস কিছু না।" আসলে স্ট্যাটাসটার কন্টেন্ট যথেষ্ট সিরিয়াস। জয়িতার স্ট্যাটাসটা ছিল এরকম : "খুনী কে তা আমি জানি। মি : সার্জিক্যাল স্পেশালিস্ট, পুলিশ এখনো আপনার খোঁজ পায়নি। তাই বলে মনে করবেন না যে আপনি বেঁচে গিয়েছেন"।
-এখন সিরিয়াস কিছু না বললে হবে। শোন, আজ আর হেঁটে আসার দরকার নেই। সিএনজিতে করে আসবি। একদম বাসার সামনে নামবি। বুচ্ছিস?
-আচ্ছা ঠিক আছে, খালা। তুমি এত টেনশন করোনা।
জয়িতা সিএনজি করেই রওনা হল। কিন্তু বাসার কাছাকাছি আসতেই সিএনজিটা গেল নষ্ট হয়ে। আর মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। এটুকু আর রিকশা নেবার দরকার নেই। বাজার পার হবার পর সে শুনতে পেলো, কে যেন চেনা একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর শিস্ দিতে দিতে যাচ্ছে। জয়িতা ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো, মুখটা দেখতে পেলো না। খালার বাসার সামনের গলিটা সারা বছরই অন্ধকারে ডুবে থাকে। সিটি কর্পোরেশনের স্ট্রীট লাইট এখানে নেই। শিষের শব্দটা এখন অনেক কাছে চলে এসেছে। জয়িতা কিছু বোঝার আগেই তার পিঠে ছুরি বসিয়ে দিল শব্দের উৎস। তারপরের সবকিছু যেন স্লো-মোশনে হলো। জাহেদ আরেকবার ছুরি বসানোর আগেই, ঘটাং করে আওয়াজ হলো। জাহেদ আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো। জ্ঞান হারানোর আগে আবছা আলোয় জয়িতা শুধু একটা জিনিসই দেখতে পেলো- একটা লাল ফ্রাইং প্যান।
অতঃপর রিপোর্টার
জয়িতা হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়ে এখন বাসায় ফিরেছে। আজ অফিসের সবাই তাকে দেখতে এসেছিল। জয়িতা এখন একাই চলা-ফেরা করতে পারে। তবে, আরও দুই সপ্তাহের আগে অফিসে যাওয়া যাবে না। খালার কঠিন বারণ। জয়িতার বাবা-মা যশোর থেকে এসেছেন। সে আরেক নাটক। মা তো কিছুতেই জয়িতাকে আর চাকরি করতে দেবেন না। পরে বাবা আর মিলি খালা মিলে মাকে শান্ত করেছেন। মা আজ বাবাকে নিয়ে বসুন্ধরায় গিয়েছেন শপিং করতে। অফিসের সবাই চলে যাবার পর, আবীর আরও কিছুক্ষণ রয়ে গেল।
ডা: জাহেদ এখন জেলে। সে এখনো কিছু স্বীকার করেনি।প্রোপোফলের হাফ লাইফ দুই থেকে চব্বিশ ঘন্টা। তাই, অটোপ্সির সময় রুলিনের রক্তে অনেক বেশি মাত্রায় প্রোপোফল পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কিছুতেই মূল খুনের সাথে এটাকে লিঙ্ক আপ করতে পারছিল না। জাহেদ ধরা পড়ায় পুরো বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে যায়। জাহেদের বাসায় সার্জিক্যাল নাইফ আর ছোরা পাওয়া গিয়েছে। ছোরায় লেগে থাকা রক্তের গ্রুপ রুলিনের ব্লাড গ্রুপের সাথে ম্যাচ করেছে। রুলিনের বাসার নিচের সিগারেটের দোকানদার জাহেদকে খুনের দিন সন্ধ্যায় দেখেছে বলে আইডেন্টিফাই করেছে। রুলিনের বাসায় একটা চায়ের চামচে আর চিরুনিতে জাহেদের আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। জাহেদ চিরুনি কেন ধরেছিল, ডিবির তদন্তকারী অফিসাররা অনেক চিন্তা করেও এটার যৌক্তিক কোন উত্তর খুঁজে পাননি।
গত কয়েকদিনে পত্রিকা আর টিভির বদৌলতে Locus of Control আর Schizophrenia এর মতো শব্দের সাথেও সবাই পরিচিত হয়ে পড়েছে। জাহেদের স্থান জেলে হওয়া উচিৎ নাকি মানসিক হাসপাতালে, এটা নিয়ে টক শোর গেস্ট থেকে ছয় নাম্বার বাসের যাত্রী সবাই অনেক উদ্বিগ্ন।
আবীরকে বিদায় জানাতে বাসার গেট পর্যন্ত গেল জয়িতা।
-আচ্ছা জয়ী, একটা ব্যাপার বল তো। এই যে দুটো চামচ বা স্ট্যাব করার ধরণ দেখে বোঝা গেল খুনী একজন ডাক্তার, এসব নিয়ে এত দেরিতে কেন লিখলি?
-আরে এসব তো আমার মাথাতেই আসেনি। খালা বলার পরেই না বুঝলাম।
-বাহ, তোর খালা তো দারুণ ইন্টেলিজেন্ট! ওনার সাথে কথা বলে তো মনেই হলো না, এসব ব্যাপারে তার কোন ইন্টারেস্ট আছে।
-হুঁ, খালাকে দেখে আসলেই কিছু বোঝা যায় না।
-"আচ্ছা যাই।" বলে মোটরসাইকেলের চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে আবীর নেমে গেল।
হাসপাতালে থাকতেই এটা নিয়ে জয়িতা ভেবেছে। খালা লাশ দেখে যেভাবে অ্যানালাইসিস করেছেন, অ্যানাটমি বা মেডিকেল সায়েন্সে গভীর জ্ঞান না থাকলে সেটা সম্ভব না। জয়িতা দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে গেল। পোলাও রান্না করা হয়েছে, রান্নাঘর জুড়ে সেই পোলাওর বাসনা। খালা নেই। মনে হয় বাথরুমে গিয়েছেন। রান্নাঘরে খুলে রাখা বইটার দিকে হাত বাড়ালো জয়িতা। এমন ঢাউস ও বিশাল আকৃতির রান্নার বই জয়িতা কখনো দেখেনি। সে বইটার নাম দেখার জন্য কভার পেজে গেল: The Hospital Autopsy: A Manual of Fundamental Autopsy Practice (2nd ed.) by Julian N Burton & Guy N Rutty। হতবিহবল জয়িতা বইটা আগের জায়গায় রেখে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলো।
-কিরে এমন স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন?
-কিছু না খালা। ক্ষুধা লেগেছে।
-"আচ্ছা বস।" বলে খালা পোলাও, কাবাব, মুরগির মাংস এনে দিলেন। জয়িতা বুভুক্ষু মতো প্লেটের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
-আরে এখনি পেট ভরে খেয়ে ঢেঁকুর তোলার দরকার নেই। আরো আসবে। এটা তো সবে শুরু।
***১৯ ফেব্রুয়ারি একই দিনে পৃথিবী হারালো অসাধারণ দুই লেখককে- হারপার লি আর উমবার্তো একো। হারপার লি'র মকিং বার্ড আর এক কিশোরের মনে অ্যাটিকাস ফিঞ্চের প্রভাব ছিল বর্ণনাতীত। সব সময় ভাবতাম, কোনদিন বাবা হলে যেন গ্রেগোরি পেকের কাছাকাছি কিছু হতে পারি (আর বাচ্চাদের সাথে আমার সম্পর্কটা যেন হয় মডার্ন ফ্যামিলির ফিলের মতো)।
কিছুটা বাধ্য হয়েই এই অংশটুকু জুড়ে দিচ্ছি। লেখাটার একটা চরিত্রের উপর যে ক্রিস্টি'র মিস মার্পলের প্রভাব আছে, সেটা আলাদা করে উল্লেখ করে দেওয়াটা বাহুল্য মনে হয়েছে। তারপরও দিলাম, কারণ অনেকে শুভ মহরত সিনেমাটার কথা বলছেন। শুভ মহরতের রাঙা পিসি আর আমার মিলি খালার সোর্স সেইম- ক্রিস্টির মার্পল! এছাড়া আরও অনেক বিখ্যাত গোয়েন্দার চরিত্রকেও পাওয়া যাবে। যেমন: সৌমিত্র সত্যজিতের ফেলুদার রেফারেন্স আর আবীর শরদিন্দুর ব্যোমকেশে রেফারেন্স। তেমনি আইরিন ছিল কোনান ডয়েলের।
যখন প্রথম অ্যাগাথা ক্রিস্টি'র মিস মার্পল পড়ি, আই ওয়াজ সিম্পলি ব্লোওন অ্যাওয়ে! এমন চরিত্র তৈরী করা আর তাকে দিয়ে রহস্যর সমাধান করানোর মতো চিন্তাধারা শুধুমাত্র ক্রিস্টির পক্ষেই সম্ভব। তখনি ঠিক করে রেখেছিলাম, কখনো সুযোগ পেলে এমন একটা চরিত্র নিয়ে লিখবো যে সোয়েটারের উল বুনতে বুনতে রহস্যর জট খুলবে। ব্যাপারটা শুধু আমার একার ক্ষেত্রেই হয়নি। ঋতুপর্ণও ক্রিস্টিতে মুগ্ধ হয়ে মিস মার্পলের আদলে একটা ছবি বানান, "শুভ মহরত"। তো আমার এক কাজিন এই লেখাটা পড়ে আমাকে বলছিল, নিজের কোন ক্যারেক্টার তৈরী করাই তো ভালো। তখন কথা প্রসঙ্গে উমবার্তো একোর উদাহরণ টেনেছিলাম। কোনান ডয়েলের হোমস তাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, তিনি এমন একটা ক্যারেক্টার তৈরী করেন যার আচরণ, বিশ্লেষন, হাতে আতশ কাঁচ, নেশার বাতিক সব নিখুঁতভাবে শার্লকের সাথে মিলে যায় (আর মিচ কালিন তো সরাসরি শার্লক হোমসকে নিয়েই লিখেছেন)।
আমার মিলি খালাও তেমনি। এই চরিত্রটা পুরোটাই শ্রদ্ধা থেকে লেখা, ক্রিস্টির প্রতি আমার ভালোবাসার অর্ঘ্য।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৫:০৪