(এক) সকাল এগারোটা বাজে । গুটিগুটি পায়ে জানালার গা ঘেঁষে রোদ এসেছে । অনিক এখনো বিছানা হতে উঠতে পারেনি । কচুরির শেকড় যেভাবে আঁকড়ে রাখে ছোট ছোট চিংড়ি পনা ঠিক সেভাবে যেন অনিক কে আঁকড়ে রাখে তার বিছানা, বিছানার চাদর, উষ্ণতা । সুদর্শন দেখতে অনিক, তবে চোখের নিচটা সেই ছোট বেলা থেকেই কালো। কেউ যেন পাকাপাকি ভাবে কালি মেখে দিয়েছে । কারণটা অনিক জানে । তার নির্ঘুম রাত্রিগুলো ভুলে যাওয়ার মতো নয়।
ভার্সিটির সব বন্ধুরা মিস্টার নার্ভাস বলে ডাকে । তার হাতের পানে কেউ তাকিয়ে থাকলে এক কলমও আর লিখতে পারেনা । খুব কষ্ট করে ইদানিং একটু গুছিয়ে কথা বলতে পারে, নয়ত শুরু করলে তার শেষ পর্যন্ত কখনই পৌঁছানো যেন দায় । জীবনের এতোগুলো বছর কাটলো; কোন প্রকার আড্ডাবাজি নেই, অথবা এখনো কোন বন্ধুত্বই গড়তে পারেনি সে । ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরা, অতঃপর বিকেলটা কাটে পথে পথে, একা একা, একটি পথ থেকে আরেকটি পথ, আর মনে মনে ভাবে “ এই পথ চলায় যদি ভালো কোন বন্ধু পাওয়া যায়।” আসলে আবেগের হাওয়ায় বাস্তবের একটি পাতাও দোলেনা । তাই যদি হতো, তবে একা একা এই পথ হাটা সেই ছোট বেলা থেকেই থেমে যেতো ।
জীবনের এমন ভারসাম্যহীনতা খুব সাধারণ একটি রাত্রি দিয়ে শুরু অনিকের, প্রায় এক যুগ অর্থাৎ ১২টি বছর আগের একটি রাত্রি। ঢাকা শহর। তবুও ঘরে ঘরে ডিসএন্টেনা আসেনি তখনো। কয়েকটি বারি পেরুলেই মেঝো চাচার বাড়ি, সেখানে অনিক প্রায়ই টিভি দেখতে যেতো। বিশেষ করে রাত এগারটায় সনি টিভির “আহাট” সিরিয়ালটি । সাদা ধবধবে একটি মহিলা, খুব স্বচ্ছ হীরের মতো প্রায়, একটি পাথর যেন তার কপালে কেউ টিপের মতো ঠেসে দিয়েছে । অপঘাতে মৃত এমন কোন লাশের কাছে দাঁড়ালেই মৃত মানুষটির আত্মা সেই মহিলাটির শরীরে প্রবেশ করতো । আর অনর্গল বলে যেতো তার মৃত্যুর রহস্য আর শেষ ইচ্ছাটি। লাশটির আত্মীয় জানতে পেত অনেক অজানা তথ্য। আত্মাটি শরীর ছাড়লেই মহিলাটি কেমন যেন দুর্বল আর কুঁজো হয়ে যেতো।” এই দৃশ্যগুলো দেখে অনিক খুব ভীত না হলেও ভেতরে ভেতরে কেমন যেন ঘেমে যেত । এমনি একটি দৃশ্য দেখার সময় অনিকের মা হঠাৎ একদিন পেছন থেকে চমকে দিয়ে বলে ”কিরে অনিক ঘুমোতে যাবিনা ? ঘুমোতে আয় নয়তো দেখবি ঐ মহিলাটি তোর স্বপ্নে আসবে ।অনিক সাথে সাথে বাড়ি ফিরলো তবে সেই মহিলাটি তার স্বপ্নে এসে উকি দিলো ঠিকই, সেই থেকে অনিক চোখ বুজে থাকলেও আজ অব্দি নির্ঘুম রাত্রি কাটায়, ঘড়ির কাটার শব্দ শুনতে শুনতে এখন সে চোখ বুজেই বুঝতে পায় রাত্র ক’টা বাজে । যেটুকুই চোখ বুজে ঘুম আসে অনিক দেখতে পায় প্রতিদিন ঠিক একই স্বপ্ন, সেখানে সেই মহিলাটি তার সামনে দাঁড়িয়ে , মহিলার ভেতর আত্মা প্রবেশ করলেই সেই আত্মাটি অনিক কে আঘাত করতে তেড়ে আসে, অনিক এখানে সেখানে দৌড়ে পালায়। তবে প্রতিবারি ব্যর্থ হয় আর প্রতিবারি বড় বড় নখ দিয়ে বুকের পাঁজরে আঁচর দিয়ে যায়, সকাল বেলা বিছানা থেকে সেই ক্ষতের চিহ্নটি নিয়ে উঠে অনিক। কালো দাগ, তবে কোন ব্যথা নেই ।
(দুই) আজ অনিকের ২২ তম জন্মদিন। তবে জন্মদিনের কথা সে নিজেই ভুলে গিয়েছিলো, গত রাতে স্বপ্নের সেই মহিলাটি অনিককে খুব আবেগ দিয়ে বলছিলো, “তুই আমার সন্তানের মতো, ঠিক ২২ বছর বয়সে আমার ছেলেটিও আত্মাদের আঘাতে মারা গেছে, সেই সাথে মারা গিয়েছিলো পরিবারের সবাই, আজ তোর ও ২২তম জন্মদিন, চেয়ে দেখতো গুনে গুনে, তোর পরিবারের সব্বাইকে খুঁজে পাচ্ছিস কি না!“ স্বপ্নের মাঝে অনিক আচমকা দেখতে পায়, তার চারিপাশ ঘিরে পরিবারের সব সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছে। সবাই অদ্ভুত রকম ধবল সাদা, বাবা..... মা... সবার কপালেই মহিলাটির মতো একটি করে পাথর সেটে আছে । চোখ গুলো একেবারেই ঝিম কালো। এই প্রথম অনিক স্বপ্নের মাঝে দৌড়ে পাললনা। হয়তো তার সমুখে সব আপন জনরাই ছিলো বলে। অনিকের মা অনিককে বলল “বাবা.. আমরাতো এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছি তবে তুই এই পৃথিবীতেই থাকবি”। একথা শুনতেই অনিকের ঘুম ভেঙে যায় । ঘড়িতে তখন ভোর ৬টা বাজে। গা’টা মোচর দিতেই পুরো শরীরটা যেন গোঁড়া থেকে উঠে এলো। বিছানায় ডুবে থাকার এতো বছরের জড়তা আজ আর একটুও টের পেলনা অনিক। প্রতিদিনের মতো নিয়ম করে পাঁজরে নতুন কোন চিহ্ন এসেছে কিনা দেখতে গেল। অবিশ্বাস্য ! নতুন এমনকি পুরনো আঁচর গুলিও কোথাও যেন লুকিয়ে গেছে । তবুও সে অবাক হয় না, অনেক বছর পর টলমল সকাল দরজায় দাঁড়িয়ে। আনন্দে হয়তো তার সকল স্বাভাবিক প্রশ্ন গুলো, ভোর বেলা উকি দেয়া হলুদ পাখির মতো হয়ে গেল । বাসার কাউকে ডাকাডাকি না করেই তড়িঘড়ি করে বাইরে চলে যায় হাঁটবে বলে। সেই পুরনো অভ্যাস তবে আজ সময়টা সকাল, আশ্চর্য রকম ভালোলাগা । আজ যেন তার আশ্চর্য হওয়ারই দিন। পথে বেরুতেই দেখতে পেলো তার বয়সী অনেক ছেলে হাটাহাটি করছে । অনিকের উপস্থিতি পেয়েই সবাই কেমন যেন বন্ধু সুলভ। সবাই কাছে ডাকছে । কথা বলতে চাইছে । অনিক বাকরুদ্ধ ছাড়া কিছু্ই হতে পারছে না, অনিকতো এদের কাউকেই চিনেনা । তবুও এতো দিনের যে অদ্ভুত আবেগ যেখানে নিজ থেকেই পুরোন হতে যাচ্ছে , কথা বলতে ক্ষতি কি। কী অদ্ভুত! আজ অনিকের কথা বলাতে একটুও জড়তা নেই, নিজেকে খুব সাহসী এবং সর্বসুখি মনে হচ্ছে । এই প্রথম অনিকের এমন আড্ডাবাজি, আড্ডায় আড্ডায় সকাল থেকে কখন যে দুপুর গড়িয়ে এলো অনিকের সেই উপলব্ধিই ছিলো না । অবশেষে বাসায় ফিরলো। বাসায় ফিরে দেখতে পেলো অনেক লোকের সমাগম । পুলিশ, র্যাব, সি আইডি সহ মিডিয়ারও উপস্থিতি; সেই সাথে প্রতিবেশী প্রায় সবাই । অনিক অবাক হয়ে ভীরের সবাইকে প্রশ্ন করতে লাগল ”কী হয়েছে ? কী হয়েছে ?” তবে কেউ কোন উত্তরই দিচ্ছে না। এতো ভীর তাই চোখ বুজেই ভীরের মাঝে গা ভাসিয়ে আরেকটু ভেতরে গেলো। যেতেই দেখতে পেলো তার পায়ের কাছে পরিবারের সব সদস্যরাই লাশ হয়ে পরে আছে। বুকের পাঁজরে এলোমেলো ক্ষত চিহ্ন, রক্তের মাখামাখি । অনিক চিৎকার দিয়ে বসে পড়লো। তবুও তাকে সামলাতে বা সান্ত্বনা দিতে কেউই এগিয়ে এলোনা। পুলিশকে একজন জিজ্ঞেস করলো “সব্বাই মারা গেছে ? কেউ বেচে নেই ?” পুলিশটি শুধু দীর্ঘশ্বাসে মাথাটি নিচুই করল । অনিক চিৎকার করে বলতে লাগল, ”আমি.. আ..আ. আমি বেচে আছি, এসব কিভাবে হলো, কে করলো ? ” অথচ অনিকের পানে কেউই দৃষ্টিও দিলো না । অনিকের চিৎকার যেন আকাশ অব্দি পৌছাতে লাগলো, মেঘেদের গায়ে আঘাত আঘাতে ঝুম করে বৃষ্টি নেমে এলো। তবুও উপস্থিত কেউই যেন শুনতে পেলোনা অনিকের চিৎকার । আর কখনই শুনল না কেউ।