ছোট বেলায় আমি খুব মা ঘেষা স্বভাবের ছিলাম (এখনো আছি)।আম্মু ছাড়া আমার একদ্বন্ডও চলত না।প্রতিদিনকার স্কুলে যাওয়া নিয়েও আমার খুব আপত্তি ছিল।আম্মুকে ছাড়া ঐ ক'ঘন্টা নিজেকে নীড় হারা পাখির ছানার মত অসহায় মনে হত।স্কুলে টিফিন,খেলার মাঝে খুব আনন্দে থাকলেও হঠাৎ আম্মুর কথা মনে হলেই সব অনর্থক মনে হত।কিছুই ভালো লাগত না।তাই স্কুল ফাঁকি দেবার বিভিন্ন উপায় মনে মনে বের করতাম।কোনদিন মাথা ব্যথা,কোন দিন পেট ব্যথা নতুবা পায়ে ব্যথা।অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই চালাকিগুলো ধোপে টিকত না।আম্মু ঠিক-ই ধরে ফেলতেন।
ছোট বেলায় ঈদের সময় বিকেলে আব্বুর সাথে বেড়াতে বের হতাম।হ্য়তো আব্বুর কোন বন্ধুর বাসায়।বেড়াতে যাওয়া পর্যন্ত ভালোই থাকতাম।কিন্তু যখন আপ্যায়নের সময় কিছু খেতে বলত তখন আমার আম্মুর জন্য পেট পোড়া শুরু হত।পেট পোড়ানো কাকে বলে!পারলে কেঁদেই দেই।ছোট বেলায় খাওয়া ব্যাপারটা আমার মনে ভীতি সন্ঞার করত।আর এমন একটা ভয়ঙ্কর সময় (!!!) আম্মু পাশে থাকবেনা তা কি হয়!?মনে আছে একবার এভাবে বেড়াতে গিয়েছি আব্বুর বন্ধুর বাসায়।আন্টি আমাকে এটা সেটা খাওয়ানোর জন্য জোর করতে লাগলেন।আমি যতই না বলি আন্টি ততই জোর করতে লাগলেন।এক সময় আর থাকতে না পেরে কেঁদেই দেই।
আম্মুর প্রতিটি ব্যাপারেই আমার খুব আগ্রহ ছিলো।তখন খুব ছোট ছিলাম বলে আম্মু আমার চুল বাড়তে দিতেন না।বছরে দু'একবার ন্যাড়াও হতে হত ।তখন আমার খুব আফসোস হত কেন আমার চুল আম্মুর মত লম্বা না।তাই মাথায় কাপড় পেচিয়ে আমি চুল বানাতাম।আরেকটা কাজ করতাম।আম্মুর সেসময় সুই-সুতার কাজের খুব সখ ছিল।সময় পেলেই সুই-সুতা দিয়ে শাড়িতে বিভিন্ন নকশা তুলতেন।আম্মুর সেই রেশমের সুতাগুলোর উপর ছিলো আমার ভীষণ লোভ।লুকিয়ে লুকিয়ে আমি সেই সুতাগুলোকে আমার চুল বানাতাম আর সেগুলোর বারটা বাজাতাম।আমার এহেন চুল প্রীতির জন্য যথারীতি আম্মুর মাইর উপঢৌকন হিসেবে মিলতো।তবে একথাও ঠিক যে আমি আমার লাইফ এ খুব কমই মার খেয়েছি।কারন আমি এতো অভিমানী ছিলাম যে আমাকে একটু বকলেই হলো,অভিমানে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যেতাম।মনে হত যেন আমার লাইফ শ্যাষ,আমার কেউ নাই কিছু নাই।
আম্মুর লিপস্টিকগুলো যে আমার কি প্রিয় ছিল কি আর বলব!জিনিসটাকে আমার এমনই আকর্ষণীয় লাগতো যে শুধু একটু চোখের দেখাতেই মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যেত,চোখ চকচক করত যেন কোন গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি।সুযোগ পেলেই সেগুলোর উপর এক্সপেরিমেন্ট করতাম।নিজের ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতাম আর নিজের রূপে নিজেই মুগ্ধ হতাম।অবশ্য এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে লিপস্টিক এমন ভাবেই দিতাম যে আমাকে একটা ক্লাউনের থেকে কম হাস্যকর লাগতো না।লিপস্টিকের আরেকটা ব্যবহার ছিল,বলা ভালো আরেক খানা এক্সপেরিমেন্ট।সেটা হল লিপস্টিক আই শ্যাডোর মত করে চোখের উপর লাগানো যায় কিনা।সেটা করার পর এক চোখ বন্ধ রেখে আরেক চোখে দেখতাম কেমন হল আই শ্যাডো দেওয়া।আমার এই সং মাখা চেহারা দেখে আম্মু তখন খুব রেগে যেতেন।আর আব্বুটা ছিলো আমার সব দুষ্টোমির প্রশ্রয় দাতা।আয়নায় যখন আমি হাস্যকর অঙ্গভঙ্গি করে আইশ্যাডো কেমন হল দেখার চেষ্টা করতাম তখন আব্বু হেসেই খুন হতেন।
পিচ্চিকালে আমার শাড়ি পড়ার খুব শখ হত।তাই আম্মু আমাকে ছোট ছোট শাড়ি কিনে দিতেন।সেই শাড়ি পড়ে,মাথায় কাপড়ের চুল বানিয়ে আমি আম্মুর মত করে রান্না করতাম ছোট ছোট হাড়ি-পাতিল দিয়ে।
ছোট বেলা থেকেই আমার ডাক্টার হবার স্বপ্ন ছিল।আমার একটা স্যুয়েটার ছিল যেটা দেখতে অনেকটা অ্যাপ্রোনের মত ছিল।সেটা পরে আমি আমার সব পুতুলগুলোর ট্রিটমেন্ট করতাম।
ছোটবেলায় আমি স্বভাবে কিছুটা চুপচাপ ধরনের থাকলেও আমার ভাইয়াটা ছিল খুবই চন্ঞল স্বভাবের।হেন দুষ্টামি ছিলনা যা তার রেকর্ডে ছিলনা।নিত্যনতুন দুষ্টামির আইডিয়া সে কোথা থেকে পেতো তা আল্লাহ-ই জানতেন।তবে আর কেউ না বুঝুক তার গূণের মর্যাদা শুধু আমিই বুঝতাম।তাই আমি ছিলাম তার বিশাল ফ্যান।তবে ভাইয়ার সাথে খেলতে গিয়ে যদি কোন কারণে ব্যথা পেতাম তখন আমার রাগ দেখতো কে!ভাইয়ার পিঠে আম্মুর উত্তম মধ্যম না পড়া পর্যন্ত শান্ত হতাম না।আমার ভাইয়ার একটা প্রিয় খেলা ছিল।সাইজে পিচ্চি ছিলাম দেখে আমার ভাই আমাকে চেস্ট অব ড্রয়ার এ ঢুকিয়ে আটকে দিত।এই ভিতীকর খেলাটা কেন যে আমার আর ভাইয়ার প্রিয় খেলা ছিল তা এখন আমাদের দু'জনেরই বোধগম্য নয়।
আমি আর আমার ভাই পিঠোপিঠি বয়সের।ছোট বেলায় এই দুই পিচ্চিকে সামলাতে আম্মুর হিমশিম খেতে হত।অথচ কোন ক্লান্তি নেই আম্মুর মাঝে।আমার জন্মের পর আম্মু আমাদের মানুষ করার জন্য নিজের টিচিং লাইফ ছেড়ে দিয়েছিলেন।
আব্বু সারাদিন অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।সন্ধার আগে তাই আমরা আব্বুকে পেতাম না।তাই আমাদের দুই ভাইবোনের সারাদিনের সারাদিনের অত্যাচার আম্মুকে সহ্য করতে হত।সন্ধায় আব্বু ঘরে ফিরে আসলেই আমরা দুই জন এক ছুটে আব্বুর কোলে।আম্মু যদি আমাদের সারাদিনের দুষ্টোমির ফিরিস্তি দিতো তখন আব্বু আমাদের বকা দেবার ছলে খুব আদর করে দিতেন।সেই জন্য সন্ধার পরের দুষ্টোমিগুলো আব্বুর জন্য মজুদ থাকতো।আমরা দুই জন খুব ছোট থাকলেও এটা বুঝে গিয়েছিলাম যে আম্মু আব্বু আমাদের দুষ্টোমিগুলো খুব উপভোগ করে।
আমরা দুই ভাই বোন আমাদের মা বাবার আদরে আজ কত বড় হয়েছি।কিন্তু এখনও যেন আমরা তাদের কাছে ছোট্টই আছি,ছোট্ট হয়েই থাকতে চাই।সবাই আমাদের আম্মু আব্বুর জন্য দোয়া করবেন যেন তারা আমাদের সুইট অত্যাচার সহ্য করার জন্য শত বছর বেঁচে থাকেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৩৩