
সুপার হিরো হতে কে না চায়। আমিও চাইতাম। ছোটবেলায় সবারই কোন না কোন প্রিয় সুপার হিরো থাকে। আমারো ছিলো। সেই শুরু থান্ডার ক্যাটসের লিয়ন ও থেকে। লিয়ন ও হবার জন্য একটা লাঠির এক মাথায় আর একটা ছোট লাঠি বেঁধে তলোয়ার বানিয়ে মাঠে চড়ে বেড়ানো ছাগলগুলোকে তাড়িয়ে এলাকা ছাড়া করে দিয়ে এসেছি কতবার সেটা গুনে বলা যাবে না। একবার তো লিয়ন ও সেজে দুষ্টের দমন করতে গিয়ে যখন উচু টেবিল থেকে লাফ দিয়ে পুরো আছাড় খেয়ে পড়লাম মেঝেতে। ঠোট টোট ফেটে পুরা রক্তারক্তি। আর তখন আমার কান্না দেখে কে। এরপর অবশ্য বড় ধরনের অপারেশনে যেতাম না। কম উঁচু জায়গা থেকে ছোট খাটো একটা দুটো লাফ দিয়েই দুষ্টের দমন চালিয়ে নিতাম।
এরপর আমার হিরো হয়ে এলো সুপারম্যান। গলার সাথে পেছন দিকে গামছা বেঁধে আমিও সুপারম্যানের মতো উড়ার চেষ্টা করি। নেহাত দু’টো পাখার অভাবে ঠিক মতো উড়তে পারি না। আমার সুপারম্যান হওয়াও বেশীদূর এগুলো না আচমকা ম্যাকগাইভারের আগমনে। তখন আমার কল্পনার জগত জুড়ে কেবল ম্যাকগাইভার। নিজেকে ম্যাকগাইভার বানাতে আমার চেষ্টার অন্ত নেই। আর আমার তৈরী করা নানান রকম ম্যাগাইভারী ফাদে পড়ে বাসার সবার ত্রাহী মধূসুদন আবস্হা। যদিও বেশীর ভাগই খুব ছেলে মানুষী টাইপ ফাঁদ।
ম্যাকগাইভার ও বেশীদিন টিকলো না। এরপর একে একে আরো অনেক সুপার হিরো এলো আর গেলো। সেই স্পাইডার ম্যান থেকে শুরু করে বাকের ভাই পর্যন্ত সবাই ই কল্পনার জগতের বাসিন্দা। বাস্তব জীবনে আমি সুপার হিরোদের খুঁজে বেরাই। যদি তাদের দেখা পাই। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় একজন কে পেলাম। যে কিনা সত্যি ই আছেন। এবং কি অদ্ভুত, এই বাংলাদেশে। তিনি একজন লেখিয়ে। চমৎকার গল্প লেখেন। কেবল মাত্র গল্প লেখার জন্য তাকে সুপার হিরো বানিয়ে দেয়াটা ঠিক হবে না। তিনি যে সত্যিই সুপার হিরো সেটা আমি বুঝতে পারলাম যখন দেখলাম তিনি ছোট খাটো অন্যায় নিয়ে বেশ উচ্চকিত। আরো বড় ব্যাপার তিনি একজন আবিষ্কারক। আর যখন জানতে পারলান তিনি আবার ছবিও আঁকতে পারেন তখন আর তাকে সুপার হিরো মানতে আমার কোন আপত্তি থাকলো না। তাই আমি ঘোষনা করে ফেললাম যে আমি সেই সুপার হিরোর সাথে দেখা করতে চলেছি।
কিন্তু চাইলেও তো আর দেখা করা যায় না। তিনি একটা পাঠশালাতে পড়ান। তাই আমি ঠিক করলাম আমি তার সেই পাঠশালায় ছাত্র হবো। তাই যেই আমি কখনো বাসার বাইরে একটা রাত কাটতে ভয় পেতাম সেই আমি পরিবার পরিজন ছেড়ে বাক্স পেটরা নিয়ে হাজির হলাম এক পাহাড় ঘেরা শহরে। সেই পাঠশালায় ভর্তি হতে।
প্রথম দিন যখন তাকে দেখলাম বেশ অবাক হলাম। তিনি খুব সাধারন। আরও অবাক হলাম কয়েকদিন পর যখন তিনি আমাদের সাথে পিকনিকে রওনা হলেন। অবাক হলাম যখন আমরা ফুটবল ম্যাচে জিতবার পর আমাদের সাথে আমাদের ক্লাশের পার্টিতে চাঁদা দিয়ে চলে এলেন। সবচেয়ে অবাক হতাম যখন তিনি একটা সাধারন চপ্পল পড়ে কাঁধে একটা লালচে রংয়ের স্কুল ব্যাগ নিয়ে ক্লাশে আসতেন। না, আমি তাকে কখনো স্পাইডারম্যানের মতো দালানের পাশ বেয়ে উপরে উঠে যেতে দেখিনি, কিংবা আমার সেই ছোট বেলার সুপার হিরো লিয়ন ও এর মতো তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেও দেখিনি।
ধীরে ধীরে জেনেছি তিনি আসলে সুপার হিরো নন, তিনি আমারি মতো একজন মানুষ। যিনি খুব সহজে মিশে যেতে পারেন তার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে। সবচেয়ে বড় কথা স্বপ্ন দেখাতে পারেন। আমাদের এই অস্থির সময়ে চারপাশে যখন ভালো লাগার মতো বা আশা করার মতো একটাও জিনিস খুঁজে পাওয়া যায় না, তখনো তিনি বলতেন স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখো। হয়তো তার ঐ পাঠশালা থেকে কেউ সুপার হিরো হয়ে বের হবে না, কিন্তু আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি যে যাদের তিনি তার মতো করে স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছেন, তারা কোনদিন সেই স্বপ্নটাকে হারাবে না। তাকে দেখেই শিখলাম, সুপারহিরো রা মানুষই হয়।
আমার সেই এক লাফে কল্পনার সুপার হিরো থেকে সাধারন মানুষ হয়ে যাওয়া শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।