
ছোট বেলায় বড়দের বিশেষ করে দাদা-দাদীর কাছে শুনেছিলাম মানুষ নাকি মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়। মফস্বল শহরে বিদ্যুৎ বলতে গেলে থাকতোই না। তাই সন্ধ্যা হলে আকাশ জুড়ে যখন তারারা জেগে উঠতো, আমি অবাক হয়ে দেখতাম তাদের আর ভাবতাম হায়রে কত কত মানুষই না মরে তারা হয়ে গেছে। অন্য সব নাতি নাতনীরা শহরে থাকতো বলে হয়তো আমি আমার দাদার আদরটা একটু বেশী পেয়েছিলাম। তাই তিনি যখন মারা গেলেন আমি আকাশ জুড়ে তাকে খুঁজে বেড়াতাম।
বরিশাল থেকে ঢাকা আসার সবচেয়ে নিরাপদ উপায় ছিলো তখন লঞ্চ। বাবা মা এর সাথে প্রায়ই তখন ঢাকা আসতাম। মাঝরাতের দিকে যখন লঞ্চ বিশাল সব নদীতে পড়তো, তখন বিশাল বিশাল লঞ্চ, চারিদিকের নিকশ অন্ধ্কার আর লঞ্চের সাইরেন ছাপিয়ে আমার মনে হতো আকাশটাই যেন পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করছে। যতদূর চোখ যায় কেবল আকাশ আর তারার আনাগোনা। ততদিন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি। বুঝে গিয়েছি এই তারাগুলো মরে যাওয়া মানুষ জন নয়। তারপরও চারিদিক ছাপিয়ে গ্রাস করা আকাশটা আমাকে খুব টানতো।
এরপর এক সময় বাবা মার সাথে স্থায়ী হলাম ঢাকায়। এখানে আকাশ দেখা যায় না। আকাশ দেখতে ঘাড় যতখানি কাত করতে হয় আমার মাথা ততদূর যায় না। বাসার কাছেই ছিলো মতিঝিলের মোহামেডান মাঠ। এখন তার অনেকটা জুড়েই দাঁড়িয়ে আছে বাফুফে ভবন। বাসার নানান সমস্যায় যখন একটু পালাতে চাইতাম, ছুটে যেতাম সেখানে।। চারিদিকে অসংখ্য আকাশ ছোঁয়া দালানের মাঝে একটু উঁকি দেয়া আকাশটা দেখতাম। শহরের ধূলো বালিময় বাতাসে খুব ভালো দেখা যেত না তারা গুলো। তারপরও চেয়ে থাকতাম। কথা বলার চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে যখন একটা দুটো মিটি মিট করে জানান দিতো, তারাও আমার কথা বুঝতে পারছে।
ধীরে ধীরে আমি বড় হই। আমি বদলাই, চারাপাশের সব কিছু বদলায়। কিন্তু এই আকাশটা বদলায় না। তারারাও বদলায় না। এক সময় ভার্সিটিতে পড়ার কারনে চলে যাই সিলেট। সেখানে প্রায়ই আমরা ক’জন মিলে রাতের আকাশ দেখতে বের হতাম। হাটতে হাটতে চলে যেতাম সুরমা নদীর পাড়ে। যায়গাটার নাম কানিশাইল। কত রাত গেছে একটা নৌকা নিয়ে আমরা মাঝ নদীতে চলে গিয়েছি আকাশ দেখতে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে একলা হাটতে হাটতে চলে যেতাম আম্বরখানা থেকে কানিশাইল। একলা নদীর পারে বসে আকাশ আর তারার সাথে কথা বলেছি কত রাত।
খসে পড়া তারা দেখলে নাকি মনে মনে কিছু একটা চাইতে হয়। তখন যেটা চাওয়া হয় সেটা নাকি পূরণ হয়। সে বার আমরা বন্ধুরা মিলে কুয়াকাটা যাচ্ছিলাম। ঢাকা থেকে বরিশাল লঞ্চে করে। বিশাল এক লঞ্চ। সবাই তখন কেবিনে জম্পেশ তাস পেটাচ্ছে। একলা আমি তখন লঞ্চের ছাদে। বহুদিনের পুরনো আকাশের সাথে একটি বার দেখা করতে। তখনই দেখলাম তিন চারটি খসে পড়া তারা। প্রথমবার বুঝে উঠতে না পারলেও মনে মনে যা চাইবার তা চেয়ে ফেললাম। সত্যি কথা বলি, যা চেয়েছিলাম তা কিন্তু ঠিকই পেয়েছিলাম তিন চার বছর পর। আবারো এই চির বন্ধু আকাশটা তার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলো। জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা পেয়ে গেলাম।
অর্থের খোজে এখন আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। ঘরের মাঝে ঘরকুনো আর অনেকটাই অসামাজিক এই আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা দেশে সম্পূর্ণ অপরিচিত কিছু মানুষের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। সারাদিন আজব সব সমস্যার সমাধান করে হোটেলে ফিরে ততোধিক আজব সব খাবার পেটে চালান দিয়ে যখন রুমে আসি, রুমের জানালা দিয়ে আকাশটা দেখি। এত সব অপরিচিত কিছুর মাঝে এই আকাশটাই পরিচিত। বদলেছি আমি , আমার বন্ধু বদলেছে, দেশ বদলেছে কিন্তু সেই আকাশটা একটুও বদলায় নি। তাই প্রতিটা এক ঘেয়ে দিনের শেষে রুমের জানালা দিয়ে আকাশের পানে তাকাই আর তারার সাথে কথা বলি। কেননা জানি , এই আকাশটা কোনদিন বদলাবে না।
---------------------------------------------------------------------------------
(অনেক দিন পর ব্লগে এলাম। নানান ঝামেলায় আমি আমার এই প্রিয় জায়গাটা থেকেও অনেক দূরে সরে যাচ্ছি)