সকাল ৮ টা ৩০
ঝিমাতে ঝিমাতে এতক্ষন চলে গেছে টের ই পাইনি। অনেক সকাল হয়ে গেছে। উঠে পড়লাম মেট্রো স্টেশনের উদ্যেশ্যে । লিফট দিয়ে নেমে হাটা ধরলাম। ব্যাগ নিয়ে এসেছি সাথে ২ টা ক্যান্টন ফেয়ার এর ব্রশিয়ার কালেক্ট করার জন্য। ২য় ব্যাগটা চাকায় সমস্যা ছিল, সেই কারনে বিকট শব্দ করছিল চলার সময়। আশেপাশের মানুষজন তাকাচ্ছে দেখে কিছুক্ষন চাকা ছাড়া নেই আবার কিছুক্ষন চাকা সহ নেই, এভাবে চ্যাঙ্গাদোলা করতে করতে মেট্রো স্টেশনে পৌছালাম।
আমাকে যেতে হবে জিংন্যাংশি এলাকায়। আমি হোটেল টা নিয়েছি ওই যায়গায় ই। ওখানে হোটেল নেয়ার কারন হল ক্যান্টন ফেয়ার এলাকায় তারাতারি যাওয়া। আমার হোটেল থেকে একটা স্টেশন চেঞ্জ করলেই ফেয়ারে যাওয়া যাবে। তবে ওটা বিদেশিদের জন্য থাকার এলাকা নয়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই সান ইউয়ান লি এলাকায় থাকে। এখানে অনেক মুসলিম ও ভারতীয় হোটেল আছে খাওয়া দাওয়ার জন্য।
জিংন্যাংশী জেতে আমাকে একটা স্টেশন চেঞ্জ করতে হবে। এয়ারপোর্ট লাইনটা লাইন নাম্বার ৩। আমাকে ধরতে হবে লাইন ২। এই জন্য আমি জিয়াহে ওয়াংগান স্টেশন নেমে গিয়ে লাইন ২ ধরলাম। এবার ট্রেন চলছে বিদ্যুৎ গতীতে। ট্রেনের ভেতরে করোর ই দুনিয়াদারি সম্পর্কে খেয়াল নাই মনে হল, কারন সবাই দেখি মোবাইল এর দিকে চোখ আর মাথা। কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছে না। আমার মনে পরে গেল আমার গীন্নির কথা। সে সব সময় ই বলে আমি নাকি সারাদিন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকি



৩০ মিনিট মত লাগলো জিংন্যাংশি স্টেশনে আসতে। এখন হোটেল খুজতে হবে। এদিকে চায়নায় গুগল ম্যাপ, ফেসবুক সবই ব্লকড। তবে আমি ভিপিএন ডাউনলোড করে এনেছি দেশ থেকে। তাই গুগল ম্যাপ চালাতে সমস্যা হল না। আমি আগে থেকেই দেখে রেখেছিলাম স্টেশনের কোন গেট দিয়ে বের হলে আমার হোটেল পরবে। সেই মত গেট সি দিয়ে বের হলাম। চোখ মেলে দেখলাম চাইনিজ ভূমি। সবাই কত ব্যাস্ত। সবাই কোনো না কোনো কাজের দিকে দৌরাচ্ছে। তবে ক্যানো যেন আমার পুরুষের থেকে নারী বেশি চোখে পড়ল

গুগল ম্যাপ ধরে খুজে পেলাম আমার হোটেল। হোটেল টি একটা আবাসিক এলাকায়। আগেই বলেছি, এটা বিদেশিদের থাকার মত এলাকা না। তবে ট্যুরিস্ট ভীরভাট্টা নেই বলে এলাকাটা খুব ভাল লাগলো আমার। হোটেল এ ঢুকে পড়লাম বিপদে। ব্যাটারা তো চাইনিজ ছাড়া কোনো ভাষাই বোঝেনা




আমার হোটেল
চেক ইন করে উঠে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে ভাবলাম একটু রেস্ট নেয়া যাক। হোটেল রুমটা বেশ ছোট। একটা খাট, আর একটা চেয়ার এটেছে কোনো মতে। টিভি ওয়াল মাউন্টেড। আমার তো এর বেশি দরকার নেই। বাজেট হোটেল এরকম ই হয়। টান হয়ে শুয়ে পড়লাম
টানা ক্লান্তিতে আবারো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দুপুর ১ টায় ঘুম ভাংলো। বিছানা থেকে উঠে যে অনুভুতিটা হল সেটা হল পেট বাবাজি কথা
বলতে চায়। মানে পেটে কিছু দিতে হবে আরকি। চীনে এসে পেট বাবাজি কে ভালই কষ্ট করতে হয়েছে। এ সম্পর্কে সব পর্বেই লিখবো।
বাথরুমে গিয়ে যেটায় প্রথমে আমার চোখ গেল সেটা হল কমোডের হ্যান্ড ফ্লাশ আছে নাকি। আমি অবশ্য জেনেই এসেছি এখানে ওটা আশা করা যাবেনা, তাই ছিলও না। আমার রুমের থেকে সম্ভবত বাথরুম সাইজে বড়। চিন্তা করলাম, ডিজাইনার কি বুঝে এতো ছোট রুম আর এতো বিশাল বাথরুম বানিয়েছে



ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পড়লাম বাইরে। প্ল্যান করলাম একটা মার্কেটে যাব। চায়নায় আসা ব্যাবসায়ীক কারনে। তাই আগে থেকে জেনে আসা একটা ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেটে যাব চিন্তা করলাম। মেট্রো ম্যাপ বের করলাম। আমি আগে থেকেই গুয়াংজু মেট্রো ম্যাপ মোবাইলে ডাউনলোড করে এনেছি যাতে তাৎক্ষনিক রুট দেখতে পারি। আমার মার্কেট টা পরেছে লাইন ৫ এ। সেজন্য আমাকে লাইন ২ থেকে লাইন ৫ এর ইন্টারচেঞ্জ স্টেশনে যেতে হবে। হাটা দিলাম মেট্রো স্টেশনের দিকে। হোটেল থেকে বের হয়েই কিছু খাবার হোটেল দেখতে পেলাম, তবে সেগুলো চাইনিজ। কি যেন একটা ঝুলিয়ে রেখেছে, কাছিম, না হাশ কিছু বুঝলাম না, চাইনিজ গুলা দেদারসে কিনছে সেইগুলো। বুঝতে গিয়ে একটা বিকট গন্ধ এলো যা আমার পেটকে আলোরিত করে তুলল

যেতে যেতে খেয়াল করলাম আমাদের মত ওদের দেশেও অনলাইন খাওয়ার ডেলিভারির লোকজন রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ডার পেলেই কালেক্ট করে পৌছে দেবে গ্রাহকের কাছে। কন্সেপ্টা অবশ্য এদেরমত দেশ থেকেই আমাদের দেশে গেছে।
একটা স্টেশন চেঞ্জ করে পৌছে গেলাম নিউ এশিয়া ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেটে। মার্কেটে ঢুকতেই একটা ফ্রেশ ফলের জুসের দোকান। মনে পড়ে গেল কিছু তো খাওয়া হয়নি। ব্যাপারটা আসলে আমার খাওয়ার মত তখনো কিছু পাইনি। তাই জুস টার্গেট করলাম। এই জুস আমার ৬ দিনের ৪ দিন পেট ভরিয়েছে। মানে জুসের ওপরে ছিলাম আর কি

জুস নিয়েই মার্কেটে ঢুকলাম। এটা মূলত মোবাইল এক্সেসরিজের পাইকারি মার্কেট। এটা নান ফ্যাং মার্কেটের সাম্নের মার্কেট। নান ফ্যাং গুয়াংজুর অনেক প্রাচীন একটা মার্কেট। আমি অনেক্ষন ঘুরলাম। মার্কেট টা সম্ভবত ১২ তলা। যত উপরে উঠব দাম তত কমবে। অনেক ভারতীয়, বাংলাদেশি কে দেখা গেল যারা এখান থেকে বস্তায় বস্তায় মাল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে মাল নিতে হলে অবশ্যই দামাদামি জানতে হবে। আমি পন্যের পাশাপাশি আরো কিছু জিনিস দেখলাম সেটা হল, প্রায় ৯০ শতাংশ দোকনদার মেয়ে। ছেলে আছে কিন্তু সংখায় মেয়েদের থেকে কম। মেয়েরা তাদের সন্তানকে নিয়ে এসে দোকানদারি করছে। এমনকি দুপুরে খাইয়ে সন্তানকে দোকানের এক কোনে বিছানা পেরে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে আর ব্যাবসা করছে। নিজেরাই বস্তা প্যাকিং করছে। মেয়েরা এখানে ছেলেদের থেকে বেশি স্বাবলম্বি। হাটতে হাটতে হঠাৎ একটা দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। চাইনিজ একজন নামাজ পড়ছে। একটু দাড়ালাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য। আমি জানি যে চায়নায় মুসলীম দের ওপর অনেক নির্যাতন করা হয়। কিন্তু মার্কেটে সবার সামনে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে দেখে মন ভাল হয়ে গেল।
অনেক্ষন ঘোরার পর পেট বাবাজি আর মানতে চাইলো না। নেমে এলাম। গুগল ম্যাপ্সে দেখাচ্ছে আশে পাশেই খাওয়ার দোকান আছে। রাস্তা পার হয়ে গেলাম খাওয়ার হোটেল খুজতে। মার্কেট থেকে বের হয়েই এক ভিখিড়ি সামনে পড়ল। যাব্বাবা, চায়নায় ও ভিখিড়ি আছে ?



একটা চাইনিজ মুসলীম হোটেলে ঢুকলাম। এখানেও চাইনিজ মুসলীম মেয়ে এবং ছেলে ২ জনেই দোকানদারি করছে। একটা টেবিলে বসে দেয়ালে চিপকানো মেন্যু গুলা দেখছিলাম। ছেলেটা আমাকে দেখে মেন্যু গুলর দিকে ইশারা করলো। বুঝাতে চাইলো কোনটা খাব। আমি একটা বিফ ফ্রাইড রাইস অর্ডার করলাম। মুসলিম হোটেল তাই বিফ অর্ডার করলাম। একটু পরেই নিয়ে এলো। রাইস টা খেতে ভাল লাগলেও বিফটা মোটেও ভাল লাগলো না। অনেক দিন ফ্রিজে রাখলে আমাদের এখানে যেরকম গন্ধ গন্ধ লাগে, ওই রকম

খেয়ে দেয়ে বিল আসলো ১২ আর আম। বিল মিটিয়ে বের হয়ে এলাম। এখন আর মার্কেটে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হল না। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তবে মার্কেটের পিছনেই পার্ল নদী। খুব ই বিখ্যাত এই পার্ল নদী। তাই সন্ধায় ব্যাস্ত শহরের মাঝখানের নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ কোনমতেই হাতছারা করা যাবেনা। মার্কেটের ভেতরে দিয়ে পেছনে এলাম। কি দারুন দৃশ্য এই পার্ল নদীর ধারে। ২ পাশে ব্যাস্ত শহর, মাঝখানে নদী। নদীর ধারের সিড়িতে গিয়ে বসলাম। আমার মত অনেক চাইনিজ ই বসে আছে, সময় কাটাচ্ছে। রাতের নদীর দৃশ্য সত্যি খুব সুন্দর। মাঝে মাঝে লাইটিং করা বড় বড় বোট যাচ্ছে নৌ বিহারে। বোট গুলো অপূর্ব সুন্দর লাগছে।
আমি অনেক্ষন বসে থাকলাম। বেশ কিছু জিনিস খেয়াল করলাম। চাইনিজরাও আমাদের মত পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে ভালবাসে। মানে ফ্যামিলি বন্ডিং প্রায় আমাদের মতই। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুরতে এসেছে অনেকেই। কেউ বা প্রেমিকা নিয়ে এসেছে সময় কাটাতে। আবার আমাদের মত বন্ধুদের সাথেও অনেকে এসে সময় কাটাচ্ছে নদীর ধারে। আমি প্রায় রাত ৯ টা পর্যন্ত বসে ছিলাম।
৯ টার পরে উঠে এলাম। মেট্রো তে করে ফিরে এলাম আমার গন্তব্য জিংন্যাংশি। নেমেই সেভেন ইলেভেন স্টোর থেকে কেক কিনে নিলাম রাতের ডিনারের জন্য । হ্যা শুধু কেক

এই সেই কেক

এদিকে আগামী কালের প্ল্যান ব্যাপক। কান্টন ফেয়ারে যেতে হবে। তাই সকালে উঠতে হবে। তাই হোটেলে এসে গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। টিভি টা চালু করলাম, কিন্তু এটা কি টাইপের টিভি তাই বুঝতে পারলাম না। চ্যানেল গুলা শুধু চাইনিজ, আর তাছারা চ্যানেল চেঞ্জ ও করতে পারছিনা ল্যাংগুএজের কারনে। ধ্যাত্তোরি

চলবে .....
৩য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৩৩