২য় পর্বের পর
সকাল সাড়ে ৬ টায় ঘুম ভেংগে গেল অভ্যাসমত। চাকুরির সুবাদে এই একটা অভ্যাস ইচ্ছা না থাকা সত্বেও করতে হয়েছে। যার ফলে ছুটিতে এসেও সকালে কাকের গান শুনতে হয়। এদিকে কম্ভল গায়ে না দেয়ার কারনে এসির বাতাস ঢুকে মোটামুটি হিমালয় হয়ে গিয়েছে আমার বুক নাক। তাই আরো কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরে উঠে পড়লাম। গিন্নিকেও টেনে তুল্লাম। তারাতারি বের হতে হবে কারন মানালির বাসের টিকেট সকালের মধ্যেই কাটতে হবে নাহলে আজ আর মানালি যাওয়া হবেনা। এদিকে মনে পড়ল মোবাইল সিম কিনতে হবে, তাই গিন্নিকে রুমে রেখে বেড়িয়ে পড়লাম সিম কিনতে। সাথে নিলাম পাসপোর্টের কপি, ১ কপি ছবি, হোটেলের কার্ড। এই সিম কিনে আমার ২৫০ টাকাই লস হয়েছিল। ব্যাটা দোকানদার সমস্যাযুক্ত সিম দিয়েছিল যা সচল হয়েছিল আমাদের ফিরে আসার দিন । আমি সব সময় কলকাতা থেকে সিম কিনি, কারন ওখানে সিমের এইসব ঝামেলা নেই। এবার যেহেতু কলকাতায় থামা হয়নি তাই এই অবস্থা। যাহোক, সিম কিনে ফিরে এসে ২ জন ই চেক আউট করে রওনা দিলাম কাশ্মিরি গেট বাস টার্মিনালে।
কাশ্মিরি গেট বাস টার্মিনাল
টার্মিনালে ঢুকে আল্লাহর নাম নিয়ে হিমাচল রোড ট্রান্সপোর্টের কাউন্টারে গেলাম। খুব বেশি ভির ছিলনা। গিয়ে ভলবো বাসের টিকিট চাইলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য ভলভোর কোন সিট নেই আজ। আমাদের যেভাবেই হোক আজকেই মানালি যেতে হবে নাহলে সব প্ল্যান ফেইল। তাই নরমাল সেমি স্লিপার বাসের টিকেট পেয়ে গেলাম, দুজনের ১৪১০ রুপি। গাড়ি ৬.৪৫ এ। । ভাবলাম যাক যাওয়ার তো ব্যাবস্থা হল। কিন্তু এই জার্নি আমাদের কেমন হয়েছিল তা পরের পর্বে জানতে পারবেন
টিকেট পেয়ে নিচে নেমে এলাম। লাগেজ গুলো ক্লক রুমে রাখতে হবে। এখন ক্লক খুজে বের করতে হবে। ভারতে বাস, ট্রেন টার্মিনাল গুলোতে লাগেজ রাখার জন্য ক্লক রুমের ব্যাবস্থা রয়েছে। লাগেজ রেখে সারাদিন ঘুরে আসা যায়। ফি খুব ই সামান্য। বেশি খুজতে হলনা, টার্মিনালের ভেতরেই অন্যপাড়ে ক্লক রুম পেয়ে গেলাম।
আমাদের লাগেজ ২ টা ছিল, ২ টাই ক্লক রুমে রেখে রিসিট নিয়ে বের হয়ে আসলাম। যেহেতু ৭-৮ ঘন্টা সময় আছে তাই ভাবলাম দিল্লী ভ্রমন টা সেরে ফেরা যাক। আমি এর আগেও বহুবার ঘুরেছি, মূলত গিন্নিকে দেখানোর জন্যেই ভ্রমন। তখনো আন্দাজ করতে পারিনি গরমে আমাদের অবস্থা কি হবে।
একটা সি এন জি নিয়ে লাল কেল্লার সামনে চলে এলাম। বাস টার্মিনাল থেকে লাল কেল্লা অল্প দুরত্তের পথ। লাল কেল্লার সামনে থেকে বহু ট্যুরিস্ট বাস ছেরে যায় যারা সারা দিল্লীর সব ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরিয়ে আনে। লাল কেল্লায় নেমেই একটু সামনে হেটে পেয়ে গেলাম ট্যুরিস্ট বাস। নরমাল বাস, যাতে সবাই ভারতীয়। ভারা নিল ১৩০ টাকা করে। আমি ভেবে পাইনা এতো সস্তায় তারা কিভাবে পরিবহন পরিচালনা করে। বাসে উঠেই আমাদের গাইড আমাদের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিল কিভাবে সে ট্যুর টা পরিচালনা করবে। আমাদের গাইড একজন ফটোগ্রাফার, সে বাসে গাইড দেয়ার পাশাপাশি ছবি তুলতে চায় সেটা তুলে দেয় এবং প্রিন্ট করে দেয়। এ তার একটা সাই্ড ব্যাবসা যা সে প্রথমেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। বিষয় টা সুন্দর। আমাদের প্রথম স্পট টি অবধারিত ভাবেই ছিল লাল কেল্লা কারন এর সামনেই বাস দাঁড়িয়ে ছিল। সময় দিল ৪০ মিনিট। আমরাও বের হয়ে লাল কেল্লার দিকে ছুটলাম।
টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। এবার দিল্লীর গরমের প্রচন্ডতা টের পেলাম। আমরা সাধারনত এতো তাপে থাকতে অভ্যস্ত না। তাই ৪৩ ডিগ্রি তাপ মাত্রায় আমাদের ২ জনের অবস্থা মোটামুটি করুন হয়ে গেল। এই গরমে যতই হাটি ততই পানির পিপাসা লাগে। তাই ১ লিটার পানি ও সুগার এর অভাব পূরনের জন্য ১ লিটার লিমকা কিনে নিলাম। এই লিমকা ই দিল্লীতে আমাদের প্রান বাচিয়েছিল।
লাল কেল্লার ভেতরে।
লাল কেল্লাটা মূলত আর্মি এলাকা। তাই এখানে আর্মির উপস্থিতি বেশি। সন্ধায় নাকি এখানে খুব সুন্দর লাইট এন্ড সাউন্ড শো হয়। আমাদের তো আর দেখা হবেনা । বেশিক্ষন ঘুরতে পারলাম না গরমের কারনে। ২৫ মিনিট ঘুরাঘুরি করে কিছু ছবি নিয়ে বের হয়ে বাসে উঠে পাখার বাতাস খেতে লাগলাম।
কিছুক্ষনের মধ্যে সবাই উঠে এলে বাস রওনা দিল রাজঘাট মহাত্মা গান্ধীর ভি আই পি সমাধির দিকে। গাইড খুব সম্মানের সাথে তাদের রাষ্ট্রপিতা মহাত্মা গান্ধীর সমাধির নাম নিয়ে আমাদের তার বর্ননা দিতে লাগলো। বিষয়টা আমার খুব পছন্দ হল, তারা তাদের দেশ গড়ার কারিগরদের সম্মান দিতে কখনই পিছপা হয়না হোক সে বাসের গাইড অথবা ধনিক শ্রেনী। আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
সমাধিতে এসে আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হল। এখানে খালি পায়ে ঢুকতে হয়। কিন্তু রোদের তাপ এতই তীব্র যে আমরা কেউ ই ঠিক মত পা ফেলতে পারছিলাম না। মোটামুটি তপ্ত পাথরে পা ফেলা নিয়ে তুর্কি নাচন চলছিল। কিছুদিন আগে ইউটিউবে দেখেছিলাম ভারতে সূর্যের তাপে ডিম ভাজা হচ্ছে। আমাদের পা আরেকটু নরম হলে হয়তো কাবাব ই হয়ে যেতো।
রাজ ঘাট
আমাদের পরের গন্তব্য ছিল রাষ্ট্রপতি ভবন যা রাইসিনা হিলস নামে পরিচিত। এখানেই ভারতের পার্লামেন্ট এবং রাষ্ট্রপতির বাসভবন অবস্থিত। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রি এবার ভারত সফরে এসে এই রাইসিনা হিলসেই ছিলেন। এখানে সব সময় এখন বাস থামতে দেয়না নিরাপত্তার কারনে। কারন কোনো না কোনো ভি ভি আইপি এখানে আসছেন সময়ে সময়ে। তাই গাইড আমাদের সেভাবেই বলল যে সল্প সময়ে দেখে নিতে। আমরাও নেমে রাষ্ট্রপতি ভবন দেখা শুরু করলাম।
পার্লামেন্ট এলাকা
এরমধ্যে গরমে আমরা ২ টা লিমকা আর ২ লিটার পানি শেষ করে ফেলেছি।
আমাদের পরবর্তি গন্তব্য ইন্ডিয়া গেট। ইন্ডিয়া গেট একটি সুপরিচিত ট্যুরিস্ট স্পট। অনেকে দিল্লী চেনেই কুতুব মিনার আর ইন্ডিয়া গেটের ছবি দেখলে। যায়গাটাও অনেক সুন্দর। কিন্তু গরমের প্রচন্ডতায় আমরা কিছুই ঠিক ভাবে ইনজয় করতে পারছিলাম না।
ইন্ডিয়া গেট।
ইন্ডিয়া গেট থেকে বাস আমাদের নিয়ে গেল বিখ্যাত কুতুব মিনার। কুতুব মিনারে ঢোকার আগে এর পাশের একটা ঢাবায় থামলো লাঞ্চ করার জন্য। গাইড নামার আগেই এখানে খাওয়ার বিল কত আসবে তা জানিয়ে দিল। ১০০ টাকায় থালি, বেশ সস্তা। এখানে গাইড গুলো দেখতে যেরকম ই মনে হোক, প্রচন্ড প্রফেশনাল তারা। সব কিছু প্রফেশনাল ভাবে হ্যান্ডেল করে। ভারত এমনি এমনি ট্যুরিসমে এগিয়ে যায়নি।
দুপুরের লাঞ্চ। বাঙ্গালী থালি ১৩০ টাকা।
মোটামুটি ৩০ মিনিটের সময় ছিল কুতুব মিনার দেখার। প্রচন্ড গরমে আমি ও গিন্নী ২ জনেই কাহিল। ভেতরে বেশিক্ষন দেখা হয়নি। কয়েকটা ছবি তুলেই আমরা বের হয়ে এসেছিলাম। এর ই মধ্যে আরেকটি লিমকা শেষ করেছি। এখন পর্যন্ত গিয়ে দাড়াল ৩ লিটার। সারাদিনে অবশ্য ২ জনে ৬ লিটার পানি ও লিমকা খেয়ে ছিলাম। কিন্তু কারোও ই ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার হয়নি। এর মানে হল যা খেয়েছি তা কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘাম দিয়ে বের হয়ে গেছে। কি অবস্থা বুঝুন ।
কুতুব মিনার
ঘড়িতে সময় দেখলাম। বাজে দুপুর আড়াইটা। এদিকে ৬ টার মধ্যে কাশ্মিরি গেটে থাকতে হবে বাস ধরার জন্য। গাইড কে জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে যাব, সে এর পরবর্তি গন্তব্য লোটাস টেম্পল থেকে মেট্রোরেলে যাওয়ার পরামর্শ দিল। আমরাও রাজি হয়ে গেলাম।
দিল্লী শহরটা বিশাল। এতোটাই বিশাল যে এর অনেক যায়গায় এখনো বসতি ই গড়ে ওঠেনি, ইন্তু সব যায়গায় ই প্রশস্ত রাস্তা রয়েছে। আর দিল্লীর রাস্তা হল জীলাপির প্যাচের চেয়েও কটিন। এর প্যাচ বুঝতেই কারো ৬ মাসের বেশি লাগবে। এরকম ই প্যাচানো রাস্তা দিয়ে আমরা পৌছে গেলাম লোটাস টেম্পল, হিন্দিতে কালকাজি মদির। এখানে ঢুকতেই মেট্রো স্টেশন রয়েছে যা গাইড বাসের ভেতরে এসে আমাকে দেখিয়ে দিল।
লোটাস টেম্পলে বেশিক্ষন থাকিনি। এতে ঢুকতেই প্রায় ১ কিলোমিটার লাইন। কোনো মতে ঢুকে কয়েকটা ছবি তুল্লাম আমাদের। গরম না থাকলে এই সুন্দর যায়গায় আরো কিছুক্ষন থাকা যেত।
লোটাস টেম্পল
বের হয়ে সোজা মেট্রো স্টেশনে চলে এলাম। স্টেশনটির নাম কালকাজি মন্দির। এখানে মেট্রো স্টেশন গুলোতে টিকেট কাটার জন্য কিয়স্ক মেশিন রয়েছে। যেখানে স্টেশন এবং যাত্রীর সংখ্যা সিলেক্ট করে টাকা ঢুকিয়ে দিলেই টিকেট চিপস বের হয়ে আসে। আমি কাশ্মিরি গেট স্টেশন সিলেক্ট করে ১০০ টাকা ঢুকিয়ে দিলাম। খুব সুন্দর মত আমাকে টিকেট চিপস সহ ৪০ টাকা ফেরত দিল মেশিন।
মেট্রো তে কাশ্মিরি গেট পৌছাতে আমাদের ৩০ মিনিটের মত লাগলো যা সিএনজি নিলে ২ ঘন্টার কমে হতো না। টার্মিনালে এসে ক্লক রুম থেকে লাগেজ নিয়ে নিলাম। খরচ পড়ল ৪০ রুপি। খুব ই সস্তা। লাগেজ নিয়ে চলে এলাম হিমাচল রোড ট্রান্সপোর্টের টার্মিনালে। এখানে স্টেট ভেদে টার্মিনাল ভাগ করা আছে। হিমাচলের টার্মিনাল হল ২০, ২১ নাম্বার। এসে দেখি বাস দাড়িয়েই আছে। বাস দেখে মোটামুটি আমার আক্কেল গুরুম। টাটার নরমাল একটা বাস যেগুলা আমাদের ঢাকায় টাউন বাস হিসেবে চলে। এই সেমি স্লিপার বাস? এই বাসেই ১৬ ঘন্টা যার্নি করতে হবে, তাও আবার এই তপ্ত গরমে। ভেবেই শিরদারা দাঁড়িয়ে গেল। জার্নিতে আরাম আয়েসে এরা আমাদের ধারে কাছে নেই। যেহেতু কিছু আর করার নেই তাই উঠে পড়লাম। ঠিক সময়েই বাস ছেরে দিল।
বাসে বসে রাতের দিল্লী শহর দেখতে ভালই লাগছিল। আস্তে আস্তে কিছু বাতাস ও পাচ্ছিলাম। রাতে কুরুক্ষেত্রে একটা পাঞ্জাবি ঢাবায় গাড়ি থামলো ডিনার করার জন্য। আমি এর আগেও ঢাবা দেখেছি, তাই ঢাবা বলতে আমি আধা পাকা কাচা হোটেল ই বুঝতাম। ঢাবার অবস্থা যে এতো উন্নত হয়েছে তা আমার জানা ছিল না। মোটামুটি এটাকে ঢাবা না বলে এয়ারপোর্টের ভেতরের কোনো রেস্টুরেন্টের সাথে তুলনা করা যায়।
এই সেই ঢাবা
ডিনার করে নিলাম পাঞ্জাবি থালি খেয়ে। বিল আসলো ২৮০ টাকা। ২ জনেই ১ থালিতে হয়ে গেল। খেয়ে দেয়ে আবারো বাস ছেরে দিল। কিছুক্ষন চলার পরই বাসে সমস্যা দেখা দিল যা আমাদের যাত্রাকে প্রায় ২ ঘন্টা পিছিয়ে দিল। মধ্যরাতে হাইওয়েতে মেকানিকের দোকানে বাস থামলো। সবার সাথে আমিও নেমে গেলাম। গিয়ে বসলাম দোকানের এক পাথরের ওপর। সাথে সাথেই দোকানী বলে উঠলো "আরে আরে কিস পার ব্যাঠ গায়া, জ্যায় শিব শাঙ্কার হায় জি, উঠ যাও।" আমি পরি কি মরি উঠে বসলাম। বাপরে বাপ, এরা যে কোন বস্তুকে কি ভেবে পুজা করে তা আমি ঠাহর করতে পারিনি। তার পরে আমি আবার মুসলিম। দুঃখ প্রকাশ করে বাসে ফিরে গেলাম তারাতারি। অবশ্য আর কিছু হয়নি। প্রায় ২ ঘন্টা পর বাস ছেরে দিল। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম
বি দ্র ঃ মেট্রো স্টেশনের ছবি গুলো গুগল থেকে নেয়া। যেহেতু সেখানে ছবি তোলা নিষেধ, তাই আমি আর রিস্ক নেই নি।
চলবে
৪র্থ পর্ব