দু’দিন আগে ব্লগার হাসান মাহবুবের একটি গল্প (প্লাস্টিকের ফুল আর খেলনা একতারার গল্প) পড়ছিলাম। ভীষণ নাড়া খেয়েছিলাম গল্পটি পড়ে।সত্যি কথা বলতে কি এতো ছোট পরিসরে গভীরতা, গল্পের ফরমেট এবং এর প্লটে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।গল্পটির সমালোচনায় মন্তব্য আকারে বলেছিলাম (১৭২ নম্বর মন্তব্য), আমি মোহিত কিন্তু লেখক হাসান মাহবুব তার সামাজিক দ্বায়-বদ্ধতার দিক থেকে সফল হতে পারেননি।ওনার প্রতিউত্তরটা ছিলো এরকম যে, সামাজিক দ্বায়-বদ্ধতার ব্যর্থটার অভিযোগটা মেনে নিতে ওনার আপত্তি নেই।আবার একটা নাড়া খেলাম।আর সেই ঝাঁকুনী থেকেই এই পোষ্টের উৎপত্তি।হামা ক্ষমা করবেন মন্তব্যটা পোষ্ট আকারে দিলাম বলে।মন্তব্য হিসেবে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলো।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের একটি বই পড়েছিলাম 'নো ওয়ান রাইটস টু দ্যা কর্নেল'। অনেকেই পড়েছেন, তবু প্রাসঙ্গিক জন্য আলোচনায় আনছি।বইটাতে একজন বৃদ্ধ রিটায়ার্ড কর্ণেল তার বৃদ্ধা স্ত্রী সহ পেনশনের চিঠির জন্য অপেক্ষা করে। দিনের পর দিন অপেক্ষা করে কিন্তু ডাক বিভাগের কোন সরকারী কর্মকর্তার চিঠি তার বাসায় পৌছেঁনা।কোন ডাক বাহকও তার দরজায় কড়া নাড়েনা।কর্ণেল কিন্তু আশা ছাড়েনা।একপর্যায়ে তাদের সঞ্চিত সব কিছুই শেষ হয়ে যায়, খাবারও ফুরিয়ে যায়।বইটির শেষ লাইনে বৃদ্ধ কর্নেলকে তার বৃদ্ধা স্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, 'কাল আমরা কি খাব?' বৃদ্ধ উত্তর দেন 'গু' (শীট)।
আরেকটি গল্প।এ গল্পটি সম্ভবত সাকীর (এইচ এইচ মানরো)।গল্পটির নাম ভুলে গেছি, অনেক আগের পড়া।গল্পটিতে ছেলেটি একজন ছবি আঁকিয়ে। আর মেয়েটি দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত।ডাক্তার বলেছে মেয়েটি বেশীদিন বাঁচবেনা।মেয়েটিও তা জানে।সে শুধু নিষ্পলক চোখে জানালা দিয়ে জানালার পাশের একটি গাছের দিকে তাকিয়ে তার দিনাতিপাত করে।শীতের বাতাসে গাছটির পাতা ঝড়ে পড়তে থাকে।মেয়েটির ধারনা হয়, যেদিন গাছটির শেষ পাতাটি ঝড়ে যাবে সেদিন তার মৃত্যু হবে।ছেলেটিও মেয়েটির এই উপলব্ধির কথা জানে।এভাবে আরও কিছুদিন বয়ে যায় এক পর্যায়ে গাছটিতে আর একটি মাত্র পাতা অবশিষ্ট থাকে।মেয়েটি অপেক্ষায় থাকে কখন তার জীবন নি:শেষিত শেষ পাতাটি ঝড়ে পড়বে। কিন্তু দিনের পর দিন যায়, পাতাটি খসে পড়েনা।মেয়েটি সন্দেহ নিয়ে দিন পার করে, বিছানায় শুয়ে এক দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে পাতাটির দিকে।কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে পাতাটি তখনও রয়ে যায়।এভাবে একটা সময় আসে যখন মেয়েটির ধারনা বদলাতে শুরু করে।সে বাঁচতে চায়, আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখতে থাকে, তার বিশ্বাস জন্মে যে এ পাতাটি আর পড়বেনা এবং সেও মরবেনা।এক পর্যায়ে গাছে নতুন পাতা আসতে শুরু করে, ডাক্তারও বলে মেয়েটি ভালো হয়ে উঠছে।মেয়েটি শুধু অবাক বিস্ময়ে ভাবে ওই পাতাটি কেনো পড়লোনা।এর কোন উত্তর সে খুঁজে পায়না, কিন্তু একটা ঘটনা ওর মনে পড়ে যায়, যখন গাছের পাতা একেবারেই কমে আসছিলো, তখন একদিন ওর আাঁকিয়ে ছেলে বন্ধুটি অনেক দেরী করে বাড়ী ফিরেছিলো।
সাহিত্য বা শিল্পে এরকম অনেক উদাহরন আছে যা জীবনে আশাবাদের ছবি দেখায়।শ্রদ্ধেয় প্রয়াত চিত্র শিল্পী এস এম সুলতানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, ‘আচ্ছা আপনার ছবিতে নারী/পুরুষ নির্বিশেষে কৃষকেরা এতো সবল কেন? আমাদের মাঠের কৃষকেরাতো এতো সবল নয়’ উনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওদের পেশীতে যে শক্তি আমি ফুটিয়ে তুলি, ওটা আসলে ওদের মনের শক্তি, ওদের বাঁচার প্রয়াস’।
শিল্পী নিজে যেমন একটি সত্ত্বা, তেমনি শিল্প নিজেও একটি বিমূর্ত সত্ত্বা।আর এই শিল্প সত্ত্বার ধারক ও বাহক যেহেতু সমাজ, তাই সমাজের প্রতি শিল্প তথা শিল্পীর দ্বায়-বদ্ধতা অনস্বীকার্য।এই দ্বায়-বদ্ধতা সমাজ জাগরনের, ঘূণে ধরা সমাজ বদলানোর।হতাশাগ্রস্ত হবার জন্য কোন অনুরণনের প্রয়োজন হয়না, কিন্তু আশাগ্রস্ত হবার জন্য উপলক্ষের প্রয়োজন হয়।সমাজে (বৃহদার্থে, মানুষের মাঝে) যদি সেই উপলক্ষ অনুপস্থিত থাকে, তবে সমাজের প্রতি শিল্পীর দ্বায়-বদ্ধতাটা আরও প্রগাঢ় হয়।অবশ্যই শিল্পীর মনের স্বতষ্ফূর্ত অনুরণনের বহি:প্রকাশে আরোপিত নিয়ন্ত্রণের কথা আমি বলছিনা।আমি বলতে চাইছি, সমাজের দ্বায়-বদ্ধতাটা শিল্পীর অনুভব করতে হবে আর সে অনুভব অনুভূত হতে পারে একমাত্র তখনই যখন শিল্পী নিজে হতাশার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসবেন।তবেই তার উৎসারিত শিল্পকর্মের মাধ্যমে সমাজের দ্বায়-বদ্ধতাটা পালিত হবে।
আজ আমরা ব্যক্তিগত ভাবে হতাশ, রাজনৈতিক ভাবে হতাশ, কর্ম ক্ষেত্রে হতাশ, প্রেমে হতাশ, সব কিছুর হতাশা সমষ্টিকভাবে আমাদের এক হতাশাগ্রস্ত জাতি হিসেবে তৈরী করেছে।যার প্রভাব পড়ছে আমাদের জীবন বোধে, শিল্পে তথা শিল্পীর শিল্পকর্মে।এর থেকে পরিত্রাণ দরকার। জানি বলবেন, আশাগ্রস্ত হবার মতো কিছুতো ঘটেনি, কিন্তু তবু চেষ্টাতো করে যেতে হবে।যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণতো অন্তত: আশটাকে রাখতে হবে।মার্কেজের ‘গু’ খাবার মতো করে, শেষ মূহূর্তটি পর্যন্ত।
আমাদের প্রবাদে বলে ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়’।কেন? কেন ঠিক বাঘের ভয়ের জায়গাটাতেই সন্ধ্যা হবে? অথবা ‘যখন বিপদ আসে তখন চতুর্দিক থেকেই আসে’, কেন?সব বিপদ কেন এক সঙ্গেই আসতে হবে? বাংলা ভাষার সমৃদ্ধশীল এই প্রবাদ গুলো খুব সহজ ভাষায় ভীষণ জটীল মনোবিজ্ঞানের প্রতিফলন। আমরা যখন কোন কিছু নিয়ে শঙ্কিত থাকি ওই ঘটনাটিই আমাদের জীবনে দ্রুত ঘটে, কারন, আমরা আমাদের মনকে ‘বিপত্তি’র দিকে আকর্ষিত করি।অর্থ্যাৎ, আমাদের মন দ্বারা আমরা শঙ্কার দিকে ধাবিত হই এবং সিকোয়েন্স অনুযায়ী একটার একটার পর একটা বিপত্তি ঘটতে থাকে।আপনি যদি একটা সাইকেল চালাতে থাকেন, পাশে যদি একটা খাল থাকে, যখনই আপনি খালে পড়ার বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত হবেন, আপনি দেখবেন আপনি খালে পড়ে গেছেন।অর্থ্যাৎ, মনের শঙ্কা আপনাকে ধাবিত করেছে।অন্য কথায় আপনি আপনাকে শঙ্কার দিকে আকর্ষিত করেছেন এবং তার তাতেই পতিত হয়েছেন।ঠিক তেমনি জাতিগত ভাবে হতাশার চর্চার মাধ্যমে আমরা হতাশার দিকে আকর্ষিত হচ্ছি।সামগ্রিকভাবে এক হতাশার মিছিলে আমরা সবাই সামিল হয়েছি।আমাদের প্ল্যাকার্ডে, ফ্যাষ্টুনে লিখা আছে ‘নৈরাজ্য’, ‘নৈরাশ্য’ নামক শব্দগুলি।নির্জীব পায়ে সেই মিছিলটিকে আমরা সবাই এগিয়ে নিয়ে চলছি।যার ফলে একটার পর একটা সিকোয়েন্সিয়াল হতাশার উপলক্ষের অভাব আমাদের জাতিগত জীবনে হয়না।আর এই জাতীয় নির্জীবতায় তাই হামাও সামাজিক দ্বায়-বদ্ধতার ব্যর্থটাতা অবলীলায় মেনে নিতে চান।
আমাদের দেশটার এখন যা অবস্থা আমাদের একটি জাতীয় পরিবর্তন দরকার।সশস্ত্র বিপ্লবে কিছু হবে এ বিশ্বাস আমার নেই।বরং বর্তমানের প্রেক্ষাপটে দু’ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে।এক, সাংস্কৃতিক বিপ্লব, দুই অর্থনৈতিক বিপ্লব।অর্থনৈতিক বিপ্লবের রূপরেখাটা কিরকম হতে পারে সময় পেলে সে বিষয়ে একদিন লিখার ইচ্ছে আছে।কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য শিল্পীদের সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।যে যেখানে যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকেই শুরু করতে হবে।হতাশার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আশার দিকে ধাবিত হতে হবে, আশার প্রতি আকর্ষিত হতে হবে।তবেই জাতিগত ভাবে একটি সজীব মিছিলে আমরা নেতৃত্ব দিতে পারবো।একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, ৭১ এর নেতৃত্বের প্রজন্ম আর দশ-পনেরো বছর পর থাকবেনা।বর্তমানের এই প্রজন্মটাই এগিয়ে যাবে তখনকার প্লাটফর্মে।তাই প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।আজকের হতাশা নয়, আর একযুগ পরের আশা নিয়েওতো আমরা আশান্বিত হতে পারি।হামা, আপনাদের থেকে আমরা একটা ‘আশ-বিপ্লব’ চাই।সবাই ভালো থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১০ রাত ২:৫৪