তখনো ক্যারিয়ারে বসতে পারতাম না। সাইকেলের সামনে বসে কত পথ পেরিয়ে অচেনা মঞ্চের উদ্দেশে বেড়িয়েছি মনে নেই। ব্যাথা লাগত বলে বাবা লুঙ্গি পেঁচিয়ে বেধে দিত সাইকেলের রডটায়।
বাবা উপস্থাপনা করত, আমাকে হাতেখড়ি দিয়েছিল সেই সময় থেকেই। কিভাবে কথার পিঠে কথা বুনতে হয়, তা শিখেছি বাবার কাছেই। সেই সুমিষ্ট স্বরধ্বনির ছিটেফোটাও অবশেষ নেই আজ আর আমার মাঝে। আজ আমি কর্কষ, তিক্ত, রসকষহীন।
আজ আমি নিজেকেই উপস্থাপন করতে ভুলে গেছি।
পা ঝিমঝিম করলে বাবা সাইকেল থামিয়ে দিত, একটু হেটে আসতে বলত। রাস্তার ধারের সেই বুনো 'ভাটি'ফুল দেখবো বলে কতবার অল্প ব্যাথাতেই আব্দার করেছি যে আর পারছি না, একটু নামবো। বাবা বলতো, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে, এইতো আরেকটু সামনেই, এসে পড়েছি প্রায়।
আজ বাবা চলে গেল।
তোমার নিথর মুখ আমি স্মৃতিতে জড়াতে চাই না বাবা। আমার স্মৃতিতে তুমি সদা চঞ্চল, হাস্যোজ্বল, প্রাণবন্ত হয়ে আছ।
তোমার রাগি স্বভাবের পুরোটাই পেয়েছি আমি। আবেগ, অনুভূতি, উদারতা, চিরটাকাল মানুষের উপকার করার ভাবনা, সব। কতবার রাস্তার ধারে সাইকেল থামিয়ে তুমি অন্যের জমিতে পড়া গরু কিংবা ছাগলকে তাড়িয়ে দিয়েছ যেন ফসল বিনষ্ট না হয়, বলো এমনটা কতজন করে এ জামানায়! মানুষ একসিডেন্ট হয়ে পড়ে থাকলেও অনেকেই পাশ কেটে চলে যায় এখন।
আজকালের বাবারা মটরসাইকেল কিংবা কারে ঘোরে। আমার স্মৃতিতে সেই দুচাকার সাইকেল, আর তোমার রোদপোড়া দৃঢ় চিবুকের সান্নিধ্য। চাঁদনী রাতের আকাশ যেমন দেখছি সেই চিবুকের সাথে চোখ লাগিয়ে, অমাবশ্যায় সপ্তর্ষিমন্ডল খুঁজেছি সেই চিবুকেরই পাশে মাথা ঘেঁষে। কত যে অভেদ্য জোনাক পোকার বুক চিড়ে বাড়ি ফিরেছি নিশুতি রাতে তোমার সাথে- আজ সব স্মৃতি।
ডিজিটাল যুগের কম্পিউটার তখন ছিল না। তোমার হাতের লেখা সুন্দর ছিল বলে কত লেখাই পৌঁছে গেছে ছোট-বড় অধিদপ্তরে। কত মানপত্র মানুষ টানিয়ে রেখেছে স্মৃতি করে। মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে কাপড়ের উপর কাগজ কেটে ক্লাবের কত ব্যানার তুমি আমি বানিয়েছি, হিসেব নেই। কত 'মা সমাবেশ' 'সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান' কত স্টেজ আর মাউথপিস তার সাক্ষ্য কেউ জানে না। আজ স্টেজ আছে, বড় বড় স্পিকার আছে, প্যানা কিংবা ডিজিটাল আর্টে ভরপুর স্টেজের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সামনের উত্তাল জনতা স্টেজে আসন অলংকৃতকারী সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, ব্যান্ড শো, রাজনৈতিক ভাষণ, আলোচনা সভা, কিংবা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের অংশ। এসবে এখন আর তুমি নেই, সেই কবে থেকে নেই মনে পড়ে না। তোমার সরে আসাটা কেন যে এত নীরব ছিল আমি জানি না। এই নীরবে সরে আসার গুনটাও তুমি আমাকে দিয়ে গেলে আজ।
আকাশের খসে পড়া তারা দেখলেই তুমি ডেকে নিতে আমায়, কতবার বলেছ, লাল নীল আলো জ্বেলে যেগুলো যায়, ওরা তারা নয়, ওগুলো এয়ারপ্লেন। মিটিমিটি জ্বলে থাকা তারাগুলোকে বলে নক্ষত্র। বলতাম, নক্ষত্র মরে গেলে কী হয়?তুমি বলতে, নক্ষত্র মারার আগে ঘটে মহাবিষ্ফোরণ, তৈরি হয় সুপারনোভা, তারপর নিভে যায় একসময়। সেই নক্ষত্রের রাতের কোন এক তারা নিভে গেল আজ আমার কাছে। নিভে গেলে জ্যোতির্ময় তুমি। সুপারনোভা, তছনছ করে দিল আমার সব।
তুমি মরে গিয়ে বেঁচে গেলে, জানতে হলনা সব।
এতটা কাল কোনো এক কৃষ্ণগহ্বরের খাদে ঘুরপাক খাচ্ছি আমি। আশাহীন, আলোহীন। তোমার দেয়া সব আলো গড়ে পড়ছে সেই নিকষ কালো কৃষ্ণগহ্বরে। দ্যূতিহীনতাই আজ আমার অস্তিত্ব। নিবিড় কোন টান আজ আর আমি টের পাইনা। সব নির্ধারিত হয়ে গেছে। আঁধারের মুখে দাঁড়িয়ে আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু অবশেষ নেই আর।
লালমনিরহাটের জেলা শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের তালবিকায় তোমার নাম সর্বপ্রথম। সালটা ছিল ১৯৯২। নেপ ময়মনসিংহ যাওয়ার আগে
মনে পড়ে তুমি আমাকে ঢাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছ। সেই আরিচায় লঞ্চে ডেকের উপর থেকে নিচ যমুনার উথাল ঢেউ অবাক বিশ্ময়ে দেখেছি সেদিন। স্মৃতি সৌধ, শহীদ মিনার, লালবাগ কেল্লা, জাতীয় জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, চীন বাংলা মৈত্রী সেতু, সোনারগাঁ জাদুঘর আর শিশুপার্ক, মনে আছে সব যেন সেদিনের স্মৃতি।আমাদের গাঁগ্রামে টাকাগুলো সব পুরোনো। ঢাকায় তুলনামূলক চকচকে নোটের ছড়াছড়ি। কত যে চকচকে ২ টাকার নোট বায়না করে নিয়েছি তার হিসেব নেই। ঢাকার বাসে কাঁচের বোতলে পেপসি আর স্প্রাইট বেঁচত ফেরিওলা। পেপসিতে ঝাঁঝ কম বলে সেটাই কিনে দিতে। তারপরও একটু খেয়েই আর খেতে পারতাম না। অযথা আব্দার জেনেও কোনোবার কিনে দিতে দ্বিধা করনি তুমি। মনে হয় সব বাবারাই এমন। এসব এখন স্মৃতি, পুরোদস্তুর স্মৃতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েও শিক্ষকতা পেশায় সারাজীবন পার করেছ স্কুলের প্রাঙ্গণে। তবু ঘুষ কিংবা উৎকোচের বিনিময়ে প্রমোশন নেওনি কোনদিন। প্রমোশন এসেছে নিজ গতিতে, হেলিয়ে দুলিয়ে। এব্যাপারে তোমার কোনো ক্ষোভ বা অভিমানও ছিলনা কোনদিন। তোমার এই নৈতিক আদর্শ প্রতিটি কর্মকর্তা কর্মচারীরা অনুপ্রেরণা হলে হয়তো বদলাবে অনেক কিছুই।
বড় ছেলে হিসেবে তোমার সান্নিধ্যের সবচে বেশি অংশই পেয়েছি আমি। অন্তরে যে বোধগুলো কাজ করে তা তোমারই কাছ থেকে পাওয়া। সেই বোধ থেকে বেড়িয়ে বোধোদয় হওয়াটা অবশ্যই চরম ধ্বংসাত্মক।
গত ঈদেও ঈদগাঁ মাঠে তোমার পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে একসাথে নামাজ পড়েছি। আর পাব না, ওটাই শেষ।
এখন আর সালাম করার পা দুটি রইল না। মাথার উপর রেখে দোয়া করার হাত দুটি রইল না। কত ঈদ -কত খুশি -কত ধুসর স্মৃতি, সব একাকার হয়ে মিশে যাচ্ছে আজ।
ছাদের বাগানে আর হয়তো ফুল ফোটানোর কেউ রইল না, গ্রামের বাড়ির ফসলি জমির হিসেবগুলো খাতায় কাঁপা হাতে লিখে রাখার কেউ রইল না। ডালে ডালে জোড়া দিয়ে আম্রপলির জোর কলম বানানোর কেউ রইল না। প্রদীপ্ত আগুন নিভে গেল আজ, ধোঁয়ার মতন হয়ত কিছদিনের মধ্যেই উবে যাবে একে একে বাকি সব।
যতটা পেয়েছ, দিয়ে গেছ তার অনেক বেশি। শিখিয়েছ, কিভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়, উপকার করার আগে উপকার করার ইচ্ছাটা থাকতে হয়। ধনী গরীব বিভেদ কোনদিন করতে দেখিনি যেমন, তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলে আপোসহীন। অপরাধবোধ কখনো ছুঁতে পারেনি তোমায়। সামর্থ্যের সবকিছু দিয়ে অন্যকে সাহায্য করতে চাওয়ার প্রবণতা ছিল বরাবর।
আজ তুমি এসবের অনেক ঊর্ধ্বে। দিগন্তরেখার পাশে দাঁড়িয়ে।সফেদ কাপড়ের মোড়া নিথর দেহের কোনো স্মৃতি আমার নেই। তোমার সদাহাস্য প্রশান্ত মুখ, সৌম্যতার জ্বলজ্বলে উপস্থিতির স্মৃতি আমার হৃদয়ে। ভাই, বোন, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন সবাইকে ছেড়ে চলে গেলে নাফেরার দেশে। আমি সেই সময়ের সাক্ষ্য নই, হতেও চাইনি। তাই নিজেকে সরিয়ে রাখার বিকল্পও আমার কাছে নেই।
আজন্ম লালিত ভালবাসার এই সংসারে তোমার বিচরণ আমি উপলব্ধি করি প্রতি মুহূর্তে। প্রতিটি সতেজ চারাগাছের পাশে তোমার পদধ্বণি খুঁজে পাই। প্রতিটি প্রহর বিভ্রান্ত করে, মেনে নিতে কষ্ট হয়,বাবা ডাকটাই আমার জন্য আজ থেকে আলাদা' হয়ে গেল। বাবা ডাকের অর্থটাই আজ আমার জন্য ভিন্ন।
১০ জুন ২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৪৭