আমার ছোটবেলা কেটেছে বড্ড বেশী অসুখে ভুগে ভুগে। বেশীর ভাগ ক্লাস মিস, পরীক্ষার সময় জ্বর। এলেবেলে নানান অসুখ। সিলেটিরা বলে এট এটি, ফেট ফেটি, মানে হচ্ছে, কিছু না কিছু লেগেই আছে। সুতরাং শেষাবদি এমন হলো, ডক্টর এর কাছে গেলে উনারা আর বুকে স্টেথস্কোপ না বসিয়েই জিজ্ঞেস করতেন, এখন কি হইছে বল? আমি একা একা ডক্টর দেখাতে যেতাম না, এমনকি বড়ো হয়েও না, সুতরাং মা আমার এট এটি, ফেট ফেটির বর্ণনা দিতেন, ডক্টর দামী ভিটামিন লিখে দিতেন! আমি খেতাম, সুস্থ হতাম, আবার অসুস্থ হতাম, গলায় তাবিজ বাধতাম, মাটি কাটতাম সারাদিন, আর মাছ ধরতাম। মাছ ধরাটা আমাদের দুই ভাইয়ের চরম নেশা ছিলো, আমরা প্রায় আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলাম এই শিল্প কে! বাড়ীর ভেতরে আমাদের নিজস্ব প্রায় ৪/৫ টা ৪ফুট বাই ৫ ফুট এর গর্ত ছিলো। এমনকি পুকুরের ভেতরেও আমাদের আলাদা দুটো পুকুর এবং এইসব মাঠি কাঠার কাজ আমরা নিষ্টার সাথে করতাম। সে এক সময় ছিলো, বালতি ভরে মাছ নিয়ে কাঁদা মাখা মাখি দুই ভাই ঘরে ফিরতাম রোজ! আমাদের প্রাইভেট টিউটর এসে গর্তের পাড়ে বসে থাকতেন! আমরা কাঁদা মাখা হাতে সালাম দিয়ে বলতাম, স্যার দুইটা মিনিট! কোন কোন দিন মাছ দ্যাখে স্যার তার প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়তেন আমাদের সাথে! সে যাই হোক, এই এট এটি ফেট ফেটি লাগনেঅয়ালা আমি বড়ো হতে গিয়েও নিস্তার দিলাম না কাউকে, এস এস সি অবদি মা সাথে করে নিয়ে যেতেন, পরে তিনি ত্যাক্ত বিরক্ত হুয়ে বলতেন, এসো নিজে করি, এখন থেকে নিজে নিজে গিয়ে ডক্টর দেখাবি, এতো বড়ো হইছিস। আমি কিউ কিউ করে অসুখে ভোগে তার পাশেই পড়ে থাকতাম, দায় ছিলো তারই।
তো এই সকল সমস্যার সমাধান হিসাবে এক অলৌকিক আবিস্কার নিয়ে আমাদের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন আমাদের সবথেকে ছোট মাসী, অপ্সরী মাসি। তিনি তার সব থেকে ছোট মেয়েকে নিয়েও নানান ঝামেলার মাঝে আছেন, এবং ঝামেলা মেটাতে তাকে বিক্রি করে দিয়েছেন ৫০১ টাকায়। বিক্রি করতে হবে এমন কাউকে, যার জাত ব্যবসা হলো মাছ বিক্রি করা। এক দামে বিক্রি হবে, দাবী দাওয়া ছেড়ে দিয়ে, কিন্তু এই বাচ্চা থাকবে খাবে এই ঘরেই, মানে ঠিক যেনো আপনার বাচ্চা ,আপনি ফেলে দিয়ে কুড়িয়ে আনলেন, এর পরে আলস্য ভরে তাকে আবার পেলে পুষে বড়ো করছেন। মায়া দয়া একটু কম দেখিয়ে, বিকিয়ে দেওয়া বাচ্চা তো! সুতরাং এই অব্যর্থ ঔষধি যে কাজে লেগে গেছে, তার প্রমাণ হিসাবে তিনি তার জিরে খাওরা (মানে হচ্ছে একেবারে হার জিরজিরে) মেয়েকে এখন বেশ নাদুশ নুদুশ করতে পেরেছেন। সুতরাং আমার বেলায় নয় কেনো?
মায়ের ব্যাপারটা পচন্দ হলো, আমার বেশ অপচন্দ হলো, কারণ ছোট বেলা থেকেই আমাদের সব বাচ্চা দের এক ধরনের মানষিক টর্চার করা হয় , বলা হয়, সে যাকে মা বাবা বলে জানে তারা আসলে তার মা বাবা না। তাকে কুড়িয়ে পাওয়া গেছে য়ই বনের মাঝে, অথবা রাস্তার ধারের য়ই ঝুপে। আমার ক্ষেত্রে তিনটে গল্প চালু ছিলো। এক হচ্ছে আমি আমাদের বাড়ির রাস্তার অপর পাশে থাকা একজন ডিভোর্সি মহিলার ছেলে। সেই মহিলা ছেলে পালতে পারবেন না বলে মাকে দিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয় গল্প হলো, এক বেদেনী আমাকে আমাদের বাড়ীর পাশের রামার নামক ঢোবার পাড়ে রেখে হাওয়া হয়ে গেছিলো, মা সেখান থেকে আমাকে কুড়িয়ে এনেছেন। তৃতীয় গল্প অলৌকিক, আমি আর আমার পাশের বাড়ীর মাসতুতো ভাই পরশ, আমরা একই সপ্তাহে দুই জনের জন্ম। সুতরাং গল্পটা এমন, আমরা দুইজন আকাশ থেকে নেমে এসে, এই দুই বাড়ীর সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে, দুইজনে ডিসাইড করলাম, আমি এই বাড়ি যাবো, আর সে য়ই বাড়ী। এই তিন গল্পের মাঝে শেষের টা আমার প্রিয়। বাকি দুটো এতো বেশী অপ্রিয় যে, এই গল্প বলে বলে সবাই আমাকে কাঁদাতো।
যাই হোক, আমাকে বিক্রি করে দেওয়া প্রায় ফাইনাল হয়ে গেলো। আমাকে যার কাছে বিক্রি করা হবে তাকে খবর দিয়ে আনানো হলো। সেই মহিলা সারাদিন দেবতা ঘরেই থাকেন, নিরামিষ ভোজী। নারায়ণের পদতলেই তার সংসার। এ ছাড়া উনার তিন ছেলে দুই মেয়ে। বিক্রি করার আগে রিহারসেল স্বরুপ মা বলে রাখলেন যেনো তিনি বেশি দামে না কিনেন! গরীব মানুষ শুধু শুধু পয়শা নষ্টো। পঞ্চাশ একশো হলেই আমার মতো মাল দিয়ে দেওয়া যায়! মহিলা এক দামের একান্নো টাকা হাকিয়ে বসলেন, মা রাজী। মৌখিক ভাবে আমি বিক্রি হয়ে গেলাম! মায়ের হাতে একান্নো টাকা চলে এলো, আমার মা হয়তো হয়ে গেলেন আমার মাসী, আরেক জন মহিলা হয়ে গেলেন আমার মা। বেশ ফুর্তি টুরতি করে তারা এই বিকি কিনি পর্ব শেষ করলেন।
বিক্রি হয়ে গিয়ে আমার অনুভুতি হলো শুন্য, আমি এই ঘরে খাই দাই। মাঝে মাঝে আমার নতুন মায়ের বাড়ী যাই, তাকে আমি মা বলে ডাকি না, মাসী বলে ডাকি। তারা আমাকে খুব আদর করেন। মাঝে মাঝে নিমন্ত্রন করে খাওয়াতে চায়, আমি গাই গুই করি। লস হলো আমার মায়ের। আমাকে ৫০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে গিয়ে তারা তো আমার দাবীদার। কিন্তু মাঝে মাঝে মা তাদের বাঁশ দেন! মানে দিতে বাধ্য হোন! তাদের দরকার লাগলেই মাসী একটা বাঁশ দেন বলে বাঁশ ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে যায়! মা বেজার হয়ে বলেন, আগেও জ্বালাইলি, তোরে বিক্রি করে দিয়েও লসের মাঝে আছি!
আমার লস লাভ নাই। আমি আমার ঘরেই থাকি অসুস্থ কম হই, ক্লাস করি, খাই দাই ঘুমাই, নাদাই এর গীত গাই। টিভি তে হেনো প্রোগ্রাম নাই যা আমি দেখি না। একেবারে গনশিক্ষার আসর থেকে শুরু করে পরিবার পরিকল্পনা, আমি সব কিছুর একনিষ্ট দর্শক! বেশ কিছুদিন ভালো আছি দ্যাখে সবাই ভাবলেন, যাহ বিক্রি করে দিয়ে দেখি সত্যি কাজ হইছে।
হুট করে একদিন আবার অসুস্থ হয়ে গেলাম। দিনের বেলা ভালো ছিলাম, রাতে শুরু হলো শ্বাসকষ্ট, আমি আমার বিছানায় বসে আছি। মা বাবা কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে ধুর ডিস্টার্ব দিয়ে কি করবো এতো রাত্রি বেলা। ভোর রাতের দিকে অবস্থা বেগতিক হলো। আমার ফোন নিয়ে পাশের রুমে মাকে ফোন করা শুরু করলাম। ভোরের ফোন বেজেই যাচ্ছে, কেউ ধরছে না। আমি আমাকে কিনে নেওয়া নতুন ভাইকে ফোন করলাম। তারা ফোন ধরলো, বললাম তাড়াতাড়ি গাড়ী ম্যানেজ করে আসতে। এই সময়ে মা এলেন, দেখলেন আমার অবস্থা, গালী গালাজ করছেন এতোক্ষন ডাকিনি কেনো বলে। রেডী হলেন। মরিমরি আমাকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়া হলো। ইমারজেন্সির ডাক্তার পরিচিত, তিনি এই অবস্থা দ্যাখে বললে্ একটা শিক্ষিত ছেলে তুই তোর এই বোধ বুদ্ধি নেই। আরো এক দেড় ঘন্টা গেলে তোকে তো আর বাচাঁনো যেতো না। উল্টো করে এক গাধা ইঞ্জেকশন দিয়ে নাকে অক্সিজেন লাগিয়ে আমাকে শুইয়ে দেওয়া হলো হাসপাতাল ঘরে। হাসপাতালের হেড নার্স আবার আমার বন্ধু তুষারের মা, যত্ন আত্তির অভাব নেই। তিন চার ঘন্টা পরে পুরোপুরি সুস্থ, বললাম এখানে থাকবো না। ঘরে যাবো। ফিরে এলাম ঘরে। ডাক্তার কি জানি কি মেডিসিন দিলেন আমার আমুল সব বদলে গেলো, আমি থালা ভরে ভাত খাই, ভাত খাওয়ার এক ঘন্তা পরে এসে আবার বলি ভাত দাও! এক মাসের ভেতরেই একেবারে নাদুশ নুদুস হয়ে গেলাম। নাদুশ নুদুশ পর্ব বেশিদিন ঠিকলো না, আবার আগের জায়গায় যাওয়া শুরু হলো। তবে এট এটি, ফেট ফেটি বন্ধ হলো কিছুটা। হুট করে একদিন আমাকে কিনে নিয়ে যাওয়া মা অসুস্থ হলেন। সন্ধে বেলা তাকে নিয়ে যাওয়া হলো হসপিটালে, আমরা দৌড়ে গেলাম, দেখলাম, ঘন্টা দেড় ঘন্টা পরে কান্নার রোল শুরু হলো, তিনি মারা গেলেন। আমি তখন অবদি কোন মৃত মানুষ দেখিনি বিধায় লাশ দেখতে গেলাম না। সকাল বেলা তাকে জ্বালানোর সময় দূরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মাস পরে তার শ্রাদ্ধ হলো, কিন্তু সেখানে আমার কিছুই করার নেই। এমনকি এক থালাতে বসে ভাত খাবার জু নেই এই সামাজিকতার কারণে, জাতে উঠা মানুষ দের জন্য তারা আলাদা আরেক বাড়ীতে খাবারের আয়োজন করলো, সেখানে আমি খাওয়া দাওয়া করলাম। আমার ভেতরে কোন তীব্র দুঃখ বোধ টের পেলাম না।
সময় এলো গেলো , দেশ ছাড়লাম, যে দেশে আসা সেই দেশোও ছাড়লাম, নিজেকে ক্রিতদাসের লাইসেন্স নিজেই দিলাম। আজ ফ্রান্সে এতো গুলো বছর। সরকার ছাপা কাগজে লিখেই দিয়েছে আমি লাইসেন্স প্রাপ্ত কামলা মানুষ! হুট করে কদিন আগে মনে হলো, আমি আসলে যাদের, আমি তো তাদেরও নই। একেবারে লজিক এর ভেতরে থেকে অথবা বাইরে থেকে, আমি তো বিকিয়ে দেওয়া একজন। যে আমাকে কিনেছিলেন, তিনি এই জগতে আর নেই। আমি ফের আমাকে কিনতে চাইলে, তবে কার কাছ থেকে কিনবো? সেই অসুস্থ এলেবেলে আমি, এখন বেশ দু পয়শা কামাই। আবার আমাকে কিনতে গেলে, আমার তবে দাম কত হবে? আমি সেই পরিবার থেকে আবার নিজেকে কিনে, আমার পরিবারে আনতে গেলে, তারা আমার দাম কত হাকাবে? তারা যদি ডং করেও আমার এক বিশাল দাম হাকিয়ে বসে, আর আমি যদি সেই দাম না দিই, তাহলে আজীবন ধরে আমি তো বিকিয়ে যাওয়া এক জন ই থাকলাম! এই সব মনোজ্বর আমার নিজস্ব, এই সব আধিখ্যেতা ভাবনায় আমি পুড়ি, এইসব ই আমাকে জ্বালায়, এই সব কিছু হয়ে উঠে আমার জ্বালানি। বেশ কবছর ধরে আমার নিজেকে পাথর পাথর মনে হয়, আমি কাঁদতে ভুলে গেছি। তবে কি ক্রিতদাসের মন হলো? তবে কি বিকিয়ে দেওয়া মানুষ হবার কারণেই আমি এমন হলাম? তবে কি আমি সে ফেলে দেওয়া বেদেনীর ছেলে? তবে কি আমি আমাদের পাশের বাড়ীর সেই মহিলার সন্তান? তবে কি আমি আমার ঘরে মিথ্যে মিথ্যে থাকি? তবে কি নিতান্ত সহজাত জীবন আর হবে না? তবে কি? তবে কি ? তবে কি?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:৪৭