তারপর একটা জোনাকি পোঁকা এলো আমার পাশে এসে বললো টিওটাও টিওটাও। আমি বললাম টিওটাও টিওটাও কি, সে উত্তরে বললো ছাগল, টিওটাও কি চিনোস না। টিওটাও হইলো মন্ত্র, বাত্তি জ্বলার মন্ত্র! বাত্তি কি এমনি এমনি জ্বলে! মন্ত্র লাগে না , দুনিয়ার তাবৎ জিনিষ মন্ত্রে চলে। তুই এইবার বল টিওটাও টিওটাও। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে বললাম টিওটাও টিওটাও সাথে সাথে আমার পিঠের দিকে বাত্তি জ্বলে উঠলো মোটামোটি ৪০ পাওয়ার এর বাল্ব। আমি ভীষণ ভয় পেলাম। জোনাকি পোঁকা আমার চারিদিকে একটা চক্কর দিলো দিয়ে বললো, আমার তোর মতোন হাত নাই, থাকলে তোর গালে ঠাস কইরা এখন একটা চড় দিতাম! বাত্তি জ্বলছে দেইখা তুই ডরাইলি এই দুনিয়ায় কয় বেটার নিজস্ব বাত্তি সিস্টেম আছে বল। শোন, তুই এক কাজ কর, তুই বাত্তি বাবা হইয়া যা, টিওটাও টিওটাও!
এরপরে রোজ রাতে ঘুমালেই জোনাকিটা চলে আসতো, সে বলতো টিওটাও আর আমার বাত্তি জ্বলে উঠতো। নানান কথা হতো তার সাথে। নানান কথার মাঝে জোনাকি একদিন আমাকে বললো তোর শিক্ষা-দীক্ষার দরকার, বাত্তি বাবা হইলেই তো হবে না, সব বাত্তির আলো তো কামে লাগে না। তোর বাত্তির আলো কামে লাগাইতে হবে। বাত্তির আলো কামে লাগাইতো গেলে সৎ হওয়া দরকার। আমি মনে মনে ভাবলাম সামান্য জোনাকি পোঁকা বাত্তি জ্বালিয়ে দিলো বলে তুই তুকারী করে। দাঁড়া শিক্ষা-দীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আর পরিপূর্ণ বাত্তি বাবা হয়ে গেলে পোঁকাটারে কাঁচের বোয়ামে ভরে রাখবো। তখন আমার টিওটাও এ তোর বাত্তি জ্বলবে হারামজাদা!
আমি রাজি হয়ে যাওয়াতে জোনাকি পোঁকা আমার শিক্ষাদীক্ষার কাজ শুরু করলো। প্রথম দিনের শিক্ষা
১.না বলা শিখো!
আমি উত্তর দিলাম, এটা আর এমন কি। না বলা তো অতি সহজ। বললাম না, শেষ খতম। মনে মনে ভাবলাম সামান্য না বলা শিখার জন্য জোনাকি পোঁকা আমার সাথে তুই তোকারি করে। সামান্য পোঁকা জ্ঞানী হইলেও সামান্য! আমিও তার সাথে তুই তোকারী করেই কথা বলি। সামান্য পোঁকা আমারে তুই বলবে আর আমি তারে বলবো আপনি, জ্বি না আমার জাগতিক জ্ঞান তো নিম্নমানের না।
জোনাকি পোঁকা জ্ঞানী হলেও ঈশ্বর তো আর না, সে মনের কথা বুঝে না। তবু সে একটা হাসি দিলো বিদ্রুপের হাসি। পোঁকার আবার হাসি কান্না কি? কিন্তু দীর্ঘদিন পোঁকা সঙ্গ করায় আমার আলাদা একটা পাওয়ার তৈরী হয়েছে, আমি এই জোনাকির হাসি কান্না বুঝি, আবার আমি বাত্তি বাবা হবার পথে তারও কিছুটা আছর আছে।
যাই হোক জোনাকি পোঁকা বিদ্রুপের হাসি শেষ করে বললো, চিন্তা কইরা দেখ, এই জীবনে কয়বার তুই না বলার জায়গায় না বলছিস। ধর, স্কুলে স্যার এর কথা মনে ধরে নাই তুই কি উঠে বলেছিস জ্বি না স্যার এমনে না এমনে, বলিস নাই , তুই বলেছিস জ্বি স্যার। ইয়েস স্যার, উই স্যার। আবার ধর তোর বন্ধুরা মিলে কু-কথার আসর বসাইছে তোর কু-কথা বলা বা শুনার মোড নাই, তুই কি বলেছিস না কু-কথা শুনবো না বলবো না, বলিস নাই, না না করেও তুই হা করে তাদের কথা শুনেছিস নিজেও দুই চারটা কু-কথা বলেছিস। যখন তোর স্বার্থ ছিলো সেই কাজে কোন দিন না বলিস নাই সত্য হোক মিথ্যা হোক তুই বলেছিস হ্যা হ্যা। আবার মানুষরে কথা দেবার বেলায়, কাজটা করা যাক বা না যাক, তুই না বলিস নাই, মাইনষের দুই মিনিট এর মুখের ঝিলিক মারা হাসি দেখার জন্য হোক আর যা কিছুর জন্য হোক তুই বলেছিস হ্যা।
আমি মানলাম জোনাকি পোঁকার কথা সত্য, আমি এখনও না বলা শিখিনি। আমি ঘাড় দুলিয়ে খালি বলি হ্যা হ্যা।
যাই হোক রোজ রাতে না হলেও জোনাকি পোঁকা বেশ ক’রাত না বলার প্রয়োজনীয়তার উপর প্রজেক্টর এ দেখিয়ে দেখিয়ে বিভিন্ন স্লাইডের লেকচার দিলো। আমি নিরবে জোনাকি পোঁকার ক্লাস করলাম, বিরক্ত হলেও সহ্য করে গেলাম , কারণ সে না এলে আমার বাত্তি জ্বলে না, আমি এখনো একলা একলা বাত্তি জ্বালানো শিখিনি। আমি একলা একলা হাজার বার টিওটাও টিওটাও বললেও কোন কাজ হয় না ৪০ পাওয়ার তো দুরের কথা ৪ পাওয়ারের একটা লীড বাত্তি ও জ্বলে না।
এই লীড বাত্তির কথা মাথায় আসতেই অবশেষে একরাতে আমার স্বয়ং বুদ্ধি আবির্ভূত হলো। বাত্তি বাবা হতে গেলে আমার জোনাকি পোঁকার লেসন নেয়ার দরকার নাই। এই টেকনোলজির যুগে এই সামান্য বাত্তি জ্বালানো কোন ব্যাপার হবে না। আমি আমার পিঠে লীড লাইট সেট করবো। সাউন্ড সেন্সর সুইচ থাকবে, একমাত্র আমার গলায় বলা বিশেষ রকমের টিওটাও টিওটাও শব্দে বাত্তি জ্বলে উঠবে আবার নিভবে। বাত্তি বাবার ঘর থাকবে অন্ধকার, রোগীর যাবতীয় বিষয় আশয় শোনার পরে আমি ডিসিশন নিবো বাত্তি জ্বলবে কিনা। বাত্তি জ্বলার পরে আমার পিঠের বাত্তির সাথে একটা চল্লিশ পাওয়ারের বাত্তি ছুয়ে দেবো। সেই বাত্তি রোগী তার ঘরে লাগাবে, সাত দিন সাত রাত সেই বাত্তি অবিরত জ্বলবে রোগী ঘর থেকে বের হবে না। সাথে থাকবে ফুল ফ্রুট চিকিৎসা। রোগীর অবস্থা বুঝে মধু, কালিজিরা, লাল ডাবের পানি খাওয়ার পরামর্শ থাকবে। এক ঘরে সাতদিন কাজ কর্ম ছাড়া ভালো খাওয়া দাওয়া করলে যে কোন মানুষই আরাম অনুভব করবে। বাকিটা আল্লার ইচ্ছা। সাথে হুমায়ুন আহমেদের আমেরিকান ডাক্তারের মতো দিবো ভাবের বাণী। দেখছি মরে যাবে এমন কোন রোগী এসে যদি বলে আমি কি মরে যাবো। উত্তর দিবো অতি অবশ্য তুমি মরে যাবে!! সাথে সাথে রোগীর মুখ শুকনো হয়ে যাবে, সাথে যারা থাকবে তারা কান্নাকাটি শুরু করবে। কান্নাকাটি শেষ হলে বলবো আমি বলেছি তুমি মরে যাবে কারণ আমরা সবাই অতি অবশ্য একদিন মরে যাবো। এই রোগী দুইদিন পরে মারা গেলেও দোষ নেই। উল্টা আমার বাত্তির ইস্তেমাল নিয়ে কথা উঠবে। সবাই বলবে নিশ্চয়ই বাত্তি জ্বলে নাই নিভিয়ে দিয়েছিলো মাঝ রাতে শত্রুতা করে। যে মারা যাবে তার স্বামী অথবা স্ত্রী কেইস খাবে। কোর্টে দৌড়াবে কান্নাকাটির সময় পাবে না। কিছু মানুষ বলবেন বাত্তি বাবা তো বলেই দিয়েছিলেন মারা যাবে। সবাই মারা যাবে। হাহাকার লেগে যাবে চারিদিকে, সবাই মারা যাবে, বাত্তি বাবা বলেছেন। সুস্থ মানুষ দোয়া দুরুদ এর জন্য পাগল হয়ে উঠবে। মৃত্যুতেও ব্যবসা বৃদ্ধি।
প্রথমে আমি হোলসেল এ চল্লিশ পাওয়ারের বাত্তি কিনে নিয়ে আসবো, আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতিতে বাত্তির ফ্যাক্টরী দিবো, সেই সাথে বিশেষ মানের হারিকেন ও থাকবে, যে হারিকেনে শুধু চল্লিশ পাওয়ার সমান উজ্জলতার আলো জ্বলে, লোডশেডিংয়ের দেশে সব চিন্তা মাথায় রেখে আগানো উচিত। কালে কালে আমার বাত্তি’ই কাজ করা শুরু করবে, আমার পিঠে বাত্তি না লাগিয়ে দিলেও চলবে। বাত্তি বিদেশে রফতানি শুরু হবে। মন্ত্রী, এমপি’রা ভোটের আগে বক্তৃতায় বলবেন ভাইয়েরা আমি জিতলে ঘরে ঘরে টিওটাও বাত্তি জ্বলবে, বাত্তি কখনও নিভবে না, শত্রু পক্ষ চাইলেও বাত্তি নেভাতে পারবে না, আমি এমন ব্যবস্থা করবো। ইনশাল্লাহ। আপনাদের সকল মুশকিল আছান, আপনাদের মুশকিল মানে আমার মুশকিল আমি কোন মুশকিল আমার এলাকায় রাখতে দেবো না, আমি টিওটাও বাত্তি দিয়া মুশকিল তাড়াবো। অন্য পার্টি বলবে হার জিত পরে, আমরা আপনাদের সেবক, বাত্তি নির্বাচনের আগে লাগানো হবে, বাত্তি নিভানো যাবে না। আমার কোম্পানির সাথে কন্ট্রাক্ট হবে, বাত্তির নিচে বিশেষ পার্টির স্পন্সর থাকবে, আমার হাজার হাজার শ্রমিক বাত্তি বানিয়ে কূল পাবে না।
হয়তো অর্থনীতিতে আর না হলে শান্তিতে নোবেল একটা আসলেও আসতে পারে। অথবা এমনও হতে পারে নতুন একটা বিশেষ নোবেল ঘোষণা হবে, বাত্তি নোবেল। টমাস আলভা এডিসন পুরস্কার আসবে ঘরে।
চিন্তা ভাবনা যখন এভাবে ডানা মেলা শুরু করে তখন কেটে দিতে হয়। আমার চিন্তা কাটার দরকার পড়লো না, চিন্তা অতি ভালো তালে এগুনো শুরু করলো। আমার ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের এইম ইন লাইফ পর্যন্ত বাত্তি’ই ঠিক করে দিচ্ছে। ছেলের নাম হবে কবি বাবা, আর না হলে হাইকু বাবা। সে সকল কথার উত্তর দিবে তিন লাইনের হাইকু দিয়ে, হাইকুর মাঝে থাকবে মুস্কিল আসানের ফর্মূলা। কয়েক হাজার হাইকু অর্ডার দিয়ে বানিয়ে রাখলাম আগেই, এন্টিক হাইকু সংগ্রহ করিয়ে আনালাম জাপান থেকে। সরাসরি কোন কথার উত্তর নাই সব উত্তর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, ঘোরানো কথার মাজেজাই আলাদা।
যেমন, কোবায়িশি ইশার হাইকু: জোনাকি উড়ে যায়/এত দ্রুত এত নিঃশব্দে/আলোটুকু ফেলে যায়। কথার মাজেজা কি, বিভিন্ন অর্থ নিয়ে আসবে এই তিনটা লাইন, কেউ ভাববে সে মারা যাবে কিন্তু সে রয়ে যাবে কিছু না কিছুতে। কেউ ভাববে উড়ে যাওয়া টাই সব নয়, থেকে যাচ্ছে আলো তার মানে সে অতি দ্রুত কিছু করে ফেলতে সক্ষম। কোন দিকেই মার খাবার যুক্তি নেই সব কথাই সত্য আবার সব কথাই মিথ্যা। মেয়েরে এই লাইনে আনবো না, মেয়েদের মন নরম, ব্যবসায় নরম মনের স্থান নাই। টিওটাও টিওটাও।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৩:০৪