আজ বাইশে শ্রাবণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭০তম মহাপ্রয়াণ দিবস। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণের এই দিনে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার হিসেবে ১৯৪১ খৃষ্টাব্দের ৬ আগষ্ট বাঙ্গালির মন ও মননের এ কবি পাড়ি জমান পরপারে। প্রয়াণের ৭০ বছর পরেও বাংলা ভাষাভাষি মানুষের চিন্তায়, অনুভবে সমানভাবে রবীন্দ্রনাথ সমুজ্জল রয়েছেন তার সৃষ্টিকর্মে।
বিশ্ব সভায় বাংলা ও বাঙ্গালিকে মর্যাদার আসনে পৌঁছে দিয়েছেন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ শে বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেন বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ব্যক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবগুলো শাখায় সমান বিচরণ ছিল বিশ্বকবির। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, সঙ্গীত ও শিল্পকলাসহ সাহিত্য ও শিল্পের সব শাখা সমৃদ্ধ হয়েছে তার লেখনিতে। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী ও দার্শনিক হিসেবেও খ্যাতি পান রবীন্দ্রনাথ। প্রথম কাব্য রচনা করেন মাত্র ৮ বছর বয়সে। ১৬ বছর বয়সে ১৮৮৭ সালে ভানুসিংহ ছদ্মনামে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের। একই বছর রচনা করেন প্রথম ছোটগল্প ও নাটক। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য প্রথম এশীয় হিসেবে ভূষিত হন নোবেল পুরস্কারে। বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে বিশ্বকবি, কবিগুরু ও গুরুদেব নামে পরিচিত রবীন্দ্রনাথ। তিনিই বিশ্বের একমাত্র কবি যিনি দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা এবং ভারতের জাতীয় সংগীত জনগণমন-অধিনায়ক হে-এর রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ।
পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই রবি ঠাকুরের মধ্যে জন্ম নেয় ভ্রমণের নেশা। এই ভ্রমণ পিপাসা তার সাহিত্য ও শিল্পে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে। পারিবারিক শিক্ষা, শিলাইদহের জীবন এবং প্রচুর ভ্রমণ তাকে প্রথাবিরুদ্ধ এবং প্রয়োগবাদী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। পরবর্তিতে তার বৈচিত্রময় ও বিপুল সৃষ্টিকর্ম এবং তার গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীর মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে তার মতাদর্শ ।
সহিত্যচর্চার পাশাপাশি মাতৃভূমি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনেও সক্রিয় ও সরব ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবিতা, গানে ও লেখনিতে বলেছেন পরাধীনতার জিঞ্জির ভাঙ্গার কথা। সমর্থন দিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া নাইট হুড উপাধি প্রত্যাখ্যান করে রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে দেন দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা, মনোভাবের কথা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বাংলা সাহিত্যে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। পরিবর্তনের এ ধারা অব্যাহত থাকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়ায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সূচিত হয়েছে নবযাত্রা।
বঙ্গীয় শিল্প-সাহিত্যের আধুনিকীকরণে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় রূপকল্পের দুর্বোধ্যতা ও কঠোরতাকে বর্জন করেন। নানা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয়কে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে তার উপন্যাস, ছোটগল্প, সংগীত, নৃত্যনাট্য ও প্রবন্ধসমূহ। কবিতায় এনেছেন নতুন মাত্রা, দিয়েছেন প্রাণের ছোঁয়া। এ কারণেই কালের পরিক্রমায় উত্তীর্ণ বিশ্বনন্দিত সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার বহু পরিচিত গ্রন্থগুলো হলো- গীতাঞ্জলি, গোরা, ঘরে বাইরে, রক্তকরবী, মানসী, বলাকা, সোনার তরী, পূরবী, শেষের কবিতা ইত্যাদি।
রবি ঠাকুরের কাব্য, ছোটগল্প ও উপন্যাস গীতিধর্মিতা, সহজবোধ্যতা, ধ্যানগম্ভীর প্রকৃতিবাদ ও দার্শনিক চিন্তাধারার জন্য প্রসিদ্ধ। বিশ্ববাসীর জন্য কবিগুরু উপহার দিয়ে গেছেন হৃদয়ে অনুরণন সৃষ্টিকারী কয়েক হাজার শ্রুতিমধুর গান। এভাবেই সাহিত্য ও শিল্পের মাধ্যমে শরীরী মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সাহিত্য ও শিল্পানুরাগী সর্বোপরি বাঙালির হৃদয়ের শেকড়ে বেঁচে আছেন রবীন্দ্রনাথ। থাকবেন অনন্তকাল ধরে।
টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন চ্যানেলের আয়োজনে উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে থাকছে নাটক, টকশো, কবিতা আবৃত্তি, সঙ্গীতানুষ্ঠান, প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এ ছাড়া কবিগুরুর মহাপ্রয়াণ দিবসে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তাকে স্মরণ করতে বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।