ডাউন টাউন সোলেমানিয়া
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ডাউন টাউন সোলেমানিয়া
শীতের বরফ গলে যাওয়ার সাথে সাথে কুর্দিস্থানের পাহাড়ের গায়ের কালো কালো দাগ গুলো থেকে সবুজ কুড়ি বের হওয়া শুরু হয়। আস্তে আস্তে তা সবুজ গাছের বাগান হয়ে যায়, অপূর্ব দৃশ্য। যেন ছোপ ছোপ সবুজ কার্পেট পাহাড়ের গায়ে বিছানো হয়েছে। এখানে প্রচুর ফলের গাছ হয়। আংগুর ,কমলা, পীচ,ফিগ, এপ্রিকট, কি হয় না। ফলের দাম একদম কমে যায় তখন। ৫ দিনার দিয়ে ১ কিলো আপেল কিংবা কমলা কেনা তখন মামুলী ব্যপার। পিচ,চেরি এগুলোর একটু দাম বেশী এবং খুব অল্প কদিন এগুলো বাজারে থাকে। তখন ফল খাওয়ার ধুম পড়ে যায় সারা কুর্দিস্থানে। সোলেমানিয়া ডাউন টাউনের জুসের দোকানগুলোর তখন রমরমা অবস্থা। কালো আংগুর, আনার,কমলা,আপেল এর ফ্রেস জুস বড় বড় গ্লাসে দেদারসে বিক্রি হয়। ১০ দিনার দিয়ে বিশাল এক গ্লাস ঠান্ডা জুস খেলে প্রান ভরে উঠে। অনেক বর্ণের জুসই পাওয়া যায় তখন তবে সবচেয়ে দামী হলো বানানা মিল্ক সেক। এটা ধনীদের খাবার। বাংলাদেশে কলা সহজেই পাওয়া যায় তাই এর মর্ম আমরা বুঝি না। কুর্দিস্থানে এর এত দাম দেখে একটু কৌতুহলি হলাম। খোজ নিয়ে জানলাম কলা স্থানীয় ফল না এটা ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে আমদানী করে আনতে হয়। বহু ঘাটের জল খেয়ে সবশেষে বাজারে আসে তাই এই অগ্নিমূল্য। প্রতিটি কলার সাথে ষ্টিকার লাগানো। ওয়েষ্ট ইন্ডিজ থেকে আমদানী করা। সাধারণ অন্যান্য ফলের দ্বিগুন তিনগুন দাম দিয়ে মিল্ক বানানা সেক খেতে হয়। কুর্দিস্থানে পাকা চেরীফল খেতে সবচেয়ে বেশী মজা লেগেছিল। আংগুর তো আমাদের বাসার মাচাতেই থরে থরে সাজানো ছিল। আর নাসপাতি ঝরে পড়ে থাকত বাগানে। সকালে মাঝে মাঝে দুর থেকে আসা গরীব বাচ্চারা কুড়িয়ে নিয়ে যেত কেউ বাধা দিত না।
ডাউন টাউন এর বাজার আমাদের বাজার গুলোর মতই, হরেক রকমের কাপড় চোপড় পড়ে বুড়ো বুড়ি, তরুন তরুনীরা বাজার করতে এসেছে। দোকানের সামনে বৃদ্ধরা গুটি দিয়ে পাশা খেলে অলস সময় কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝে কাঁচের গ্লাসে লাল চা বা শায়ে খাচ্ছে। অনেক দোকান বন্ধ এবং মালামাল কম। বেশীর ভাগ কাপড় চোপড় ইরাণ থেকে স্মাগলিং হয়ে আসে এবং ইরানী ফ্যাশন ই এখানে বেশ চলে । রাস্তা গুলোতে মোটামুটি ভীড় আছে গাড়ী ও ট্যাক্সি ক্যাবের সাথে ঘোড়া গাধায় টানা ঠেলা ও আছে। ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা তেমন একটা নেই এবং এ জন্য কেউ গা করে বলে মনে হয় না। পুলিশ আছে, তারা যা পারছে করছে, মোটামুটি প্রায় স্বাধীন অবস্থা । কাঁচা বাজারে গেলে শুধু লুঙ্গি পড়া মানুষের দেখা পাওয়া যাবে না। বাকী সব কিছুই প্রায় বাংলাদেশের কাঁচা বাজারের মত।
স্যুভেনির শপ ও আছে এবং এ সব দোকানে পুরানো জিনিষের ছড়াছড়ি। এক সময়কার ধনী ও সৌখিন মানুষ গুলো তাদের নিজস্ব শখের জিনিষ টাকার প্রয়োজনে কমদামে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে এবং এগুলো পরে হাত বদল হচ্ছে এসব দোকানে। বাজারে আসলে ঘুরে ফিরে কেনাকাটা করতে করতে আশপাশের অবস্থা দেখতাম। ট্যাক্সি ক্যাবে করেই বাজারে আসতাম। বাসা থেকে বের হয়ে দক্ষিণে ঢালু নুড়ি বিছানো রাস্তা মুল রাস্তায় এসে মিলেছে। দুই ব্লক পার হলেই রাস্তা তাই হেটেই এ পথটুকু পার হতাম। রাস্তায় ট্যাক্সি ক্যাব গুলো সব ভক্স ওয়াগন পাসাত, ট্যাক্সিগুলো সাদা ও কমলা রং করা। জনশ্র“তি ছিলো এগুলো সাদ্দাম ব্রাজিল থেকে ট্যাংক কেনার সময় প্রতি ট্যাংকের সাথে দুটো করে পেয়েছিল। কুর্দিস্থান এবং বাগদাদের প্রায় ট্যাক্সি ক্যাব গুলোই ব্রাজিলের তৈরী এই ভক্স ওয়াগন পাসাত। গাড়ীগুলো বেশ মজবুত।
সোলেমানিয়াতে এক হাজার ডলার দিয়ে মোটামুটি এ ধরনের একটা কারের মালিক হওয়া যেত। একটা সুবিধা ছিল এই গাড়ীর, যে কোন ওয়ার্কশপে বা গ্যারেজে মেরামত করা যেত অতি সহজে। স্থানীয় ভাবে অনেক পার্টস ও বানাতে পারত কারিগররা। হাত বাড়ালেই প্রায় সময় টেক্সি পাওয়া যেত। ডাউন টাউন যেতে ২৫/৩০ দিনার লাগত। রাস্তার দুপাশের দৃশ্য তেমন আকর্ষণীয় নয়। মাঝে মাঝে থেমে যাওয়া নির্মাণ কাজ দেখা যেত। কিছুটা পশ্চিমে গেলে পাহাড়ের উপর আরেকটা সুন্দর আবাসিক এলাকা, সেখানে বিভিন্ন সরকারী অফিস। এই এলাকার আশে পাশেই কিছু মার্কেট আছে। চুল কাটার জন্য নাপিত সামান এর এসি সেলুন এখানেই। এই সেলুনের মালিক সামানের সাথে চুল কাটার সময় গল্প করে সময় কাটতাম। আরো এগিয়ে গেলে বিধ্বস্থ ৫ তারা হোটেল সোলেমানিয়ার ভগ্নদশা দেখতে দেখতে ডাউন টাউন সোলেমানিয়ার চৌরাস্তার মোড়ে পৌছে যেতাম। হোটেল সোলেমানিয়া যুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে ও আগুন লেগে বিধ্বস্থ হয়েছিল অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে তখনও এটার কার্যক্রম নতুন করে শুরু হয়নি। এর পাশেও আরেকটা দামী হোটেল ছিল সেটারও একই অবস্থা। হোটেল সোলেমানিয়া ছাড়িয়ে মোড় পার হয়ে বাজারের মুখেই ট্যাক্সি আমাদের নামিয়ে দিত। বাজারের ভেতরের রাস্তায় গেলে একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে পরে ঘোরার ব্যবস্থা, তাই মোড়ে নেমে হেটেই বাজারে চলে আসতাম। বাজারে আসার পর প্রায় সময় আইসক্রিমের দোকানে গিয়ে কোন আইসক্রিম খেতাম। বেশ মজার আইসক্রিম একেবারে খাঁটী দুধ দিয়ে বানানো। ইউরোপিয়ানরা কুর্দিস্থানে দুধের কোন জিনিষই খেত না। তাদেরকে দুধের মধ্যে এক ধরণের জীবানু ্আছে বলে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল। কুর্দিরাও বেশ আইসক্রিম খায় এবং বরফের ও ভক্ত। আমরা বাজারে ঘুরে ঘুরে দেখে শুনে বাজার করে ট্যাক্সিতে বোঝা চাপিয়ে প্রায় সময়ই সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরে আসতাম। তখন সন্ধ্যা হতো ৯টার দিকে। ধুধু খোলা প্রান্তরের মত জেলখানার জীবনে এটাও ছিল এক ধরনের আউটিং। প্রবাস জীবনের দিন পঞ্জীর পাতাগুলো এভাবে সুখ দুঃখ, দেখা না দেখার আনন্দ বেদনা নিয়ে এগিয়ে যেত।
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন