ইরাকের কুর্দিস্থানে প্রবাস জীবন কাটাবার সুবাদে প্রায়ই সোলেমানিয়া শহর থেকে ইরবিল শহরে আসা যাওয়া করতে হতো। ঠিক পর্যটকের মত ভ্রমণ ছিল না এটা। তাই প্রকৃতির নিখুত সৌন্দর্য ঠিকমত দেখা হতো না। তবে মাঝে মাঝে থমকে যে যেতাম না তা বলি কি করে। হঠাৎ করে আমাদের জীপের উইন্ড সিল্ড দিয়ে দেখলাম সামনের রাস্তায় দুপারে কেউ যেন লাল কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে। থামতেই হবে ঠিক করলাম। থেমে দেখি, না এটা তো কার্পেট না। শীত শেষের বরফগলা পানির সুধায় রাস্তা দুপাশে ঘাস ফুলের মত তীব্র লাল ঘন ছোট ছোট ফুলে ভরে গেছে। দুর থেকে লাল কার্পেট মনে হয়। ইরবিল থেকে সোলেমানিয়া যাবার পথে রাস্তায় পার্শ্বে ছোট একটা জনপদের দৃশ্য এটা। যথারীতি জীপ থামিয়ে ফুলের মাঝে ছবি তুলতে বসলাম। এই রাস্তা দিয়ে কতদিন যাতায়াত করেছি এভাবে থেমে কখনো প্রকৃতিকে দেখিনি। দুর থেকে দেখলে দুই চারটা ঘর। কিছু গৃহপালিত পশু, ধুষর আশপাশ ও দুরের পাহাড়ের গায়ে কালো কালো দাগগুলোই দেখা যেত। এই রুপ যে বদলে এত সুন্দর হতে পারে আজ তা দেখলাম। প্রকৃতির টান গতিকেও থামিয়ে দেয়।
মালভূমির উপর দিয়ে বানানো দুইশত কিলোমিটার পথ - প্রশস্থ , মসৃণ, পিচঢালা ও পাহাড়ী, তবে মাঝে মাঝে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গর্ত। ওয়ানওয়ে রাস্তা, জায়গার তো কোন অভাব নেই। ইরবিল শহরের মধ্যে রাস্তা ডিভাইডার দিয়ে ভাগ করা , শহর ছেড়ে বাইরে গেলেই ওয়ানওয়ে। শহর ছাড়লেই ধূষর মাটি খোলা দিগন্ত,উপরে নীল আকাশ। মাঝে মাঝে দুরে ছোট ছোট লোকালয়। জনপদের ধোয়া দেখা যায়, দৈনন্দিন জীবনযাপনের ইংগিত। রাস্তাগুলো আশে পাশের এলাকা থেকে উচু এবং পিচ ঢালা। পাথরের জন্য বেশী দুরে যেতে হয়নি। মাটিতে নুড়ি ও পাথরের মিশেল, পাথরের পাহাড় ও আশে পাশেই আছে। মাঝে মাঝে ছোট পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে কেটে রাস্তা বের হয়ে গেছে। ইরবিল থেকে কাসনাজান -মাইদান- দিঘালা- কোইসিনজাক - কালাকান - দোখান- পিরামাগরান হয়ে সুলেমানিয়া। পথে আরো ছোট ছোট জনপদ যেগুলো পার হয়ে যাওয়ার সময় তেমন মনোযোগ দেইনি কখনো। মাইদান দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ের একটা আজব দৃশ্য দেখা যেত। পাহাড় কেটে রাস্তা তাই পাহাড়ের ভেতর দেখা যায়, সেখানে পাথর বা মাটির এক স্তর , তারপর নুড়ি পাথরের স্তর এরপর আবার মাটি এবং আবার নুড়ি পাথরের পুরো স্তর এবং সবশেষে আবার কঠিন মাটি বা পাথর। মনে হতো সমতলে পাথর বর্ষণ হয়েছে কয়েকবার পরে এ ধরনের পাহাড়ের আকৃতি পেয়েছে এলাকাটা। গাড়ী গুলোতে এসি থাকাতে গরমের সময় টের পেতাম না। তবে প্রচুর পানি খেতে হতো। খুবই শুষ্ক আবহাওয়া, গাড়ীর চাকা পাংচার হলে কষ্টটা বুঝতে পারতাম। সোলেমানিয়া যেতে প্রায় এগারশ মিটার উচু একটা পাহাড় পার হতে হতো এটাকে স্থানীয়রা খাইবার সুলতান পাহাড় বলত। পাহাড়ের নীচ থেকে বিপজ্জনক বাঁক নিয়ে আস্তে আস্তে চুড়া পার হয়ে ওপারে যেতে হতো। পাহাড়ের পাদদেশে পৌছার আগে দুটো শহর পার হতে হতো, দিঘালা ও কোইসিনজাক। দিঘালাতে ঢোকার মুখে ওয়ানওয়ে রাস্তা একসাথে মিশে ডিভাইডার দিয়ে বিভক্ত হয়ে যায়। ডিভাইডারে বড় বড় গাছ লাগানো ছায়া ঢাকা পথ, রাস্তার পাশেও বেশ ঝোপ, গাছ পথিককে একটু ছায়া দেয়ার জন্য।। ইরবিল প্রদেশ পি ডি কের নিয়ন্ত্রনে আর সোলেমানিয়া পি ইউ কের নিয়ন্ত্রনে তাই দুটো প্রদেশের সীমান্ত বরাবর নো ম্যান্স ল্যান্ড বাদ দিয়ে দুই দলের পেশমারগারদের চেকপোষ্ট।
পেশমারগার
সাধারণ জনগন, তেলবাহী লরী কিংবা খাদ্যবাহী ট্রাক গুলোকে উপযুক্ত ট্যাক্স দিয়ে বা অনুমতি পত্র দেখিয়ে চেকপোষ্ট পার হতে হতো। এক কুর্দিস্থানেই কত সমস্যা। প্রথম বাধা ছিল ইরাক সরকারের চেকপোষ্ট তারপর নিজেদের দু দলের কোন্দলে সৃষ্ট চেকপোষ্ট। মাঝে মাঝে পি ডি কেও পি ইউ কের মধ্যে ছোটখাট কারণে যুদ্ধ বেধে যেত তখন দুই প্রদেশের নিরাপত্তা জোরদার করা হতো আর যাতায়াত বন্ধ হয়ে যেত। ইউ এন এর মধ্যস্থতায় তারা আবার সমঝোতায় পৌছাত। আলেকজান্ডারের কথায় বলতে হয় - সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ।
সোলেমানিয়ার পথে
ইরবিল থেকে সোলেমানিয়া যাওয়ার পথে রাস্তায় দুটো পাহাড়ী রেঞ্জ আছে। ইরবিলের দিকের পাহাড় সারিতে পি ডি কে স্থানীয় চেকপোষ্ট নির্মাণ করে রেখেছে। তেমনি সোলেমানিয়ার দিকেও একই অবস্থা। এই পাহাড় সারির মাঝে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা এটা নো ম্যান্স ল্যান্ড এবং অবৈধ ভাবে কেউ এটা পার হতে চাইলে পাহাড়ের উপর থেকে মেশিনগান দিয়ে হামলা করা যায়। দুই দলের বাধা পার হয়ে একটু এগিয়ে আসলেই দিঘালা শহর। বেশ শান্ত পরিবেশ রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালিয়ে এগিয়ে যেতাম থামা হতো না। একবার শহরটা একটু ঘুরে ফিরে দেখার ইচ্ছা হলো। মুল রাস্তা বাদ দিয়ে একটু ভেতরের দিকে গেলাম। এখানকার স্থানীয় লোকজনের সাথে বিদেশীদের তেমন যোগাযোগ হয়না। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ইউ এন এর গাড়িগুলো রাস্তা দিয়ে যায়। বাচ্চারা হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়, এতটুকুই। তাই বিদেশী দেখে তারা একটু অবাক হয়। সব বাড়ীই একতলা কিংবা দোতলা। সহজ সরল জীবন। দোকান গুলোতে উপচে পড়া জিনিষপত্র নেই তবে প্রয়োজনীয় জিনিষ আছে। শান্ত মনে চুপচাপ মানুষ জন হাঁটাহাটি করছে। দুই একটা বাসার অন্দর মহল থেকে আমাদের গাড়ী দেখছে। আমরা বয়স্ক লোকদের সালাম দিয়ে বললাম কাগা চোয়ানী ? অর্থাৎ কেমন আছেন ? বাসি চাখি উত্তর পেতাম অবাক দৃষ্টির সাথে। আজনবী কুর্দি ভাষায় কথা বলছে। কুর্দি ভাষায় সম্মান করে বয়স্কদের কাগা বলে। একটা চায়ের ষ্টলে বসলাম, লাল চা চিনি দিয়ে খায় এরা, খুশী মনে খেতে দিল। আমরা কিছুক্ষণ বসে আবার পথের মানুষ পথে ফিরে এলাম।
খাইবার সুলতান পাহাড় শ্রেণী
দিঘালা পার হয়ে কিছু দুর গেলেই কোইসিনজাক শহর। এটা দিঘালা থেকে একটু ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা। শহরের মধ্যে দিয়ে আমাদেরকে যেতে হতো, রাস্তার মোড় বাঁক তাই চেনা হয়ে গিয়েছিল। কোইসিনজাক শহরের শেষে বেশ বড় একটা কাচা বাজার, সে বাজারে পাহাড়ের নীচে বয়ে চলা নদীর তাজা মাছ বিক্রি হয়। পাহাড় থেকে নীচে নেমে আসলেই ছোট্ট পাহাড়ী নদী, সব সময় শীর্ণই থাকে তবে বৃষ্টি হলে বেইলি ব্রিজ ভেংগে একাকার অবস্থা হয়। আগের সেতুটা জীর্ণ হওয়াতে বেইলি ব্রিজ দিয়ে পার হতে হয়। ব্রিজ পার হয়ে আবার চড়াই, এবার সবচেয়ে বড় পাহাড় খাইবার সুলতান পার হতে হবে। খাইবার সুলতানের চুড়া প্রায় এগারো শ মিটার উচু , বিশাল পাহাড় শ্রেণী। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এঁকে বেকে চড়াইয়ের পথ। একদম চুড়ার কাছে পেশমারগারদের চেক পয়েন্ট। পথটা বেশ বিপজ্জনক বাঁকে ভর্তি। সব জায়গায় নিরাপত্তার জন্য রেলিং নেই। তাই আস্তে আস্তে গাড়ী নিয়ে উঠতে হয়। রাস্তা ভালই তবে মাঝে মাঝে পাহাড়ে ধ্বস নেমে সাময়িক ভাবে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। চূড়া পার হয়ে নামার সময় একটু এগিয়ে গেলেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। সাধারণত কোন জিনিষ ঢালুতে নীচে গড়িয়ে যায়। পাহাড়ের চূড়া পার হবার পর একটা জায়গা আছে সেখানে ঢালুতে নিচের দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে গড়িয়ে যায়। আমরা পানি ভর্তি বোতল দিয়ে এটা পরীক্ষা করতাম। হয়ত চুম্বকীয় ও মধ্যাকর্ষণ সংক্রান্ত কোন কারনে এ ধরনের ঘটনা ঘটত।
সোলেমানিয়া শহর
পাহাড়ের আঁকা বাকা পথ ধরে নামতেই নীচে একটা রেষ্টুরেন্ট। লোকজন বিশেষত ট্রাক ড্রাইভার ও যাত্রীরা পাহাড়ী পথে উঠার আগে এখানে বসে চা নাস্তা খেয়ে ফ্রেস হয়ে পুনরায় রওয়ানা হয়। আমরাও দু এক বার এই হোটেলের আতিথেয়তায় চা পান করেছি। সেই লাল চা চিনি দিয়ে বানানো। স্বাধ একটু আলাদা, কুর্দিস্থানে চা কে বলে শায়ে। চা বললেও বোঝে। এরপর অনেকদুর সমতল পথ পার হয়ে দোখান লেক এলাকা। এখানে একসময় সুন্দর প্রানবন্ত রিসোর্ট এরিয়া ছিল। মুলত দোখান লেককে ঘিরে তা গড়ে উঠেছিল এখন রিসোর্ট আছে পর্যটক ও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। দোখান লেকের বাঁধ থেকে ছেড়ে দেয়া পানি ছোট নদীর মত বয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছ ঠান্ডা পানি। এই পানি আশেপাশের এলাকার লোকজন খাবারের ও চাষের জন্য ব্যবহার করে। তারপর আবার চড়াই পথে। বেশ দুর পর্যন্ত সোজা রাস্তা পাহাড়ের উপরে উঠে গেছে। নামার সময়ও ঠিক তেমনি। নীচের গাড়ীগুলো ছোট ছোট মনে হয়। এখানে টু ওয়ে রাস্তা, সতর্কতার সাথে উঠা নামা করতে হয় এবং গাড়ীর ইঞ্জিনের অবস্থা ভাল না হলে বিপদ ও হতে পারে। চলতে চলতে সোলেমানিয়ার কাছাকাছি এসে গেলে ধু ধু এলাকা দেখা যায়। সেখানে দুরে বিশাল এক তলা দালান। এটা ছিল সাদ্দামের সময়কার জেলখানা। নির্জন নিস্তব্দ ধুষর এলাকা, মাঝে হঠাৎ বানানো জেলখানা, এখন পরিত্যক্ত কেউ সেখানে যায় না। আরেকটু এগিয়ে গেলে বিশাল সোলেমানিয়া সিমেন্ট ফ্যাক্টরী জানান দেয়, এক সময় গোটা সোলেমানিয়ায় ও পার্শ্ববর্তী অনেক এলাকার হাজার হাজার মানুষ এই বিশাল সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে কাজ করত। অবরোধের কারণে সিমেন্ট ফ্যাক্টরী বন্ধ ও লোকজন বেকার। মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ কেউ দেখার নেই। সিমেন্ট ফ্যাক্টরী পার হয়ে সোলেমানিয়া- চামচামাল রোড ডানে রেখে আমরা সোলেমানিয়াতে পৌছে যাই। শহরে ঢোকার মুখে ফ্লাই ওভার, আন্ডার পাস সবই আছে। বামে সাচনার যাওয়ার রাস্তা, ডানে ডব্লিউ এফ পির গোডাউন রেখে আমরা শহরে ঢুকে পড়ি। জনমানব কম। ভক্স ওয়াগন পাসাত ট্যাক্সি গুলো রাস্তায় চলছে। বেশ জীর্ণ তেলবাহী লরি গুলো আসা যাওয়া করছে। পেসমারগাররা কুর্দি পোষাক ও অস্ত্র হাতে হেটে বেড়াচ্ছে। দোকান পাট ও জনবসতিতে ঢুকে যেন মনে হয় নিজের ভেরায় ফিরে এসেছি। এক বছর কম সময় না। তাই সোলেমানিয়াকেই তখন মনে হতো নিজস্ব আবাস। ঘরে প্রিয়জন অপেক্ষা করে না
থাকলেও বিশ্রাম তো নেয়া যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৫