কারবালা
রাজধানী বাগদাদে বেড়াতে আসলে আমরা কোন না কোন জায়গা দেখতে বের হয়ে পড়তাম । বাগদাদ ও তার আশেপাশের এলাকায় প্রচুর ঐতিহাসিক স্থাপনা ও এলাকা আছে । এবার যখন বাগদাদে এলাম তখন ঠিক করলাম নাজাফ,কারবালা ও কুফা দেখব । প্রথমে ট্যাক্সি স্টেশনে এলাম । সেখানে বড় ও মজবুত ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। মরুভূমির পথ। ট্যাক্সিতে এসি ভাল কাজ করে না । সাথে পানি নিলাম । বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা হয়ে গেলাম । বাগদাদের সীমানা পার হলেই মরুভূমির মত এলাকা, বেশ উত্তপ্ত । কারবালা বাগদাদ থেকে একশ’দুই কিলোমিটার দূরে, কারবালা যেতে দুইটা চেক পয়েন্ট আছে । সেখানে গাড়ী থামানোর পর কাগজপত্র দেখাতে হয় । মুসলমান ও বাংলাদেশী বলায় আমাদেরকে যেতে দিল । এর পরের চেক পয়েন্টে তেমন আর কোন চেক করল না । মধ্যবর্তী এলাকা মরুময় তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায় না।
কারবালা
প্রথমে কারাবালা এলাকায় গেলাম । কারবালা প্রদেশের রাজধানী কারবালা শহর। ইমাম হোসেন (রাঃ) এবং তার ভাই আব্বাসের (রাঃ) মাজার রয়েছে যেখানে সেটাই ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। শত শত বছরে মরুভূমি রুপ নিয়েছে আধুনিক নগরী হিসাবে। এগুলো শিয়া প্রধান অঞ্চল । হযরত হোসেন (রাঃ) ও হযরত আব্বাস ( রাঃ ) এর মাজার দুটো একরকম দেখতে, বিশাল এলাকা জুড়ে মসজিদ। এই মসজিদ গুলোর বৈশিষ্ট্য একটু অন্য রকম। মসজিদের মুল ভবন এ ঢুকতে হলে গেইটের মত আছে তারপর চারপাশ দিয়ে করিডোরের মত লেন বানানো এবং এরপর বিশাল ফাঁকা জায়গা, এখানে অনেক লোকজন বসতে পারে । রোদের তাপ অত্যন্ত বেশী বলে সবাই পাশের ছায়া জায়গাতে বসে । লোকজনকে দেখলে মনে হয় এরা অনেক দিনের জন্য এখানে এসেছে । মসজিদ অনেক কারুকাজ করা কিছু কিছু জায়গা সোনা কিংবা পেতলে মোড়ানো মনে হলো । মসজিদের ভেতরটাও অনেক কারুকার্য খচিত যা সাধারণত সুন্নি মসজিদগুলোতে দেখা যায় না । সবাই একটা মাটির টুকরা সেজদার জায়গায় রেখে সেখানে সেজদা দেয়। এটা নাকি কারবালার মাটি। মসজিদেও এধরনের টুকরা পাওয়া যায়। কেনাও যায় বাইরের দোকানে। আমরা কিছুক্ষণ ঘুরে বাইরে এলাম। হযরত আব্বাস ( রাঃ ) এর মাজারও একই রকম। শিয়ারা দুজনকেই সমান সম্মান করে বলে মনে হলো। ইনিও হযরত আলী ( রাঃ ) এর আর একজন সন্তান । বাইরে প্রচুর গরম, সরবত, পানিপুর্ণ ফল বিক্রি করছে বিক্রেতারা। আমরা ফল কিনে খেলাম। প্রায় এক ঘন্টা সেখানে ছিলাম। আমাদের চেহারা ও চালচলন দেখে লোকজন বুঝল আমরা ভারতীয় এবং অবশ্যই শিয়া না। আমাদেরকে দু একজন জিজ্ঞাসা করায় বললাম বাংলাদেশী মুসলমান ওরা এতেই খুশি। আমাদের দেশের শিয়া সুন্নী এরা তেমন পার্থক্য করে না। মুসলমান জেনেই খুশী। প্রায় এক ঘন্টা সময় কখন যেন কেটে গেল।
নাজাফ
এবারের গন্তব্য নাজাফ । নাজাফ ইরাকের আঠারটি গভর্নরেটের একটি। নাজাফ কুফারই অংশ,কুফায় রয়েছে হজরত আলীর (রাঃ) বাড়ী। কারবালা থেকে নাজাফ প্রায় আশি কিলোমিটার , বাগদাদ থেকে কারবালা গেলে পথে পথে প্রচুর গাছপালা এবং সবুজ চোখে পড়ে। কিন্তু নাজাফ যেতে শুধু ধু-ধু মরুভূমি , এখানে হজরত আলীর (রাঃ) মাজার রয়েছে। কথিত আছে নাজাফ এ হযরত আলী ( রাঃ ) কে দাফন করা হয়েছে। এখানে হযরত আলী ( রাঃ ) মাজার ও মসজিদ আছে। প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল ট্যাক্সিতে নাজাফ আসতে । সূর্যের প্রচন্ড তাপে বোতলের পনি গরম হয়ে গেছে। সেই পানি খাচ্ছি। এক কেজি আলু বোখারা কিনলাম পানিযুক্ত ফল,টমাটোর মত মধ্যখানে বিচি খেতে খারাপ না। আমাদের দেশে শুকনা আলু বোখারা বিরিয়ানীতে দেয় । গরমের দেশ ও মরুভূমিতে এই ফল গুলো সঞ্জীবনীর মত কাজ করে। হযরত আলী (রাঃ) মসজিদেও সিয়াদের প্রাধান্য, সুন্নী কাউকে দেখিনি। যদিও দেখে বোঝার উপায় নাই। তবে এরা এখানে আসে না বলে মনে হলো । এখানে মানুষ জন বাইরের লোক সম্বন্ধে বেশ সজাগ ও নতুন কেউ এলাকায় ঢুকলে ফলো করে পরিচয় জেনে নেয়। ইরাকে শিয়া সুন্নীর মধ্যে পার্থক্য বেশ প্রকট এবং মারামারি হানাহানিও হয় মাঝে মাঝে । মসজিদের দেয়ালের গায়ে অঙ্কিত নকশা দেখার মতো, সূক্ষ্ম তার কারুকাজ। । সামনের পিছনের দুপাশের নারী-পুরুষেরা কেউ নামাজ পড়ছে,কেউ কুরআন শরীফ পড়ছে,কেউ মাজারে র ঘের জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে,কেউ বা কাঁদছে। বাইরে মাজার সংলগ্ন বাজারে বোরকা পরিহিত অসংখ্য নারী খুচরা দোকান নিয়ে বসেছে কেউ চায়ের দোকান সাজিয়ে বসেছে, কেউ টুপি তসবি, কেউবা অন্য কিছু।সুন্নী শাসিত সাদ্দাম সরকারের কাছে শিয়ারা নিরাপদ বোধ করে না ।
কুফা মসজিদ
এরপর কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম । এখানে যে মসজিদে হযরত আলী ( রাঃ ) কে হত্যা করা হয় সেখানে গেলাম । এটাও শিয়া কায়দায় বানানো বিশাল মসজিদ, মাঝখানে পাকা উঠোন, সেই উঠোনের মাঝখানে একটা জায়গা গোল করে ঘেরা । কথিত আছে এটা সেই জায়গা যেখানে হযরত আলী ( রাঃ )কে হত্যা করা হয়েছিল । মসজিদের ভেতরে গেলাম, অনেক শিয়া ভক্ত সেখানে দোয়া পড়ছে, কেউ নামাজ পড়ছে। এইসব মসজিদের লোকজন দীর্ঘদিন থাকে ভিক্ষুকও দেখা যায় । আমার একটা সাধারণ পর্যবেক্ষণ হলো যে মসজিদ গুলো কেন যেন পরিষ্কার না । একটা গুমট গন্ধ পাওয়া যায় । হয়তো পানির অভাব ঘাম ও গোসল কম করার সুযোগ থেকে এসব গন্ধ সৃষ্টি হতে পারে ।
মসজিদ থেকে বের হয়ে হযরত আলী (রাঃ )এর বাড়ীতে গেলাম । বাড়ীর চারপাশ দেয়াল ঘেরা । এর ভেতর সেই প্রাচীন কালের মাটির ঘর ছোট ছোট কামরা গাইড বলে এগুলোতে হযরত আলী ( রাঃ ) এর পরিবার থাকতেন । বাইরে থেকে বাড়ির ভিতরটা বোঝার উপায় নেই। বাড়ীটি দুইটি অংশে ভাগ করা। মাঝখানে ছাদহীন খোলা জায়গা। দুই অংশ মিলে ছোট বড় আট-দশটি কোঠা রয়েছে। একটি রুম দেখিয়ে গাইড বললেন, ওটাতে মৃত্যুর পরে হজরত আলীকে (রাঃ) এনে রাখা হয়েছিল। বাড়ীর ভেতর একটা পানির কুপ আছে । কথিত আছে এখান থেকে তাঁরা পানি তুলতেন। পানি তুলে পান করার জন্য দর্শনার্থীদের দেয়া হচ্ছে। ভক্তি ভরে সবাই পান করছে। এখন অবশ্য এই কুপ ব্যবহার হয় না । আজ শুক্রবার, কিন্তু এখানে জুম্মার নামাজ হয় না । আমরা কসরের নামাজ পড়লাম। হযরত আলী ( রাঃ ) বাড়ীর অনতিদুরে এজিদের প্রাসাদ। বিশাল বাড়ী এখন কেবল দেয়াল আছে বাকী সব মাটির নীচে দেবে গেছে । ময়লা নোংরা জলাভূমির মত এলাকা হয়ে আছে।
কুফা
কুফায় আল-ওমরা প্যালেস হজরত ওমরের (রাঃ) প্রতিষ্ঠিত। হযরত ওমর (রাঃ) তার খেলাফত পরিচালনার জন্য এই মূল ভবন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পুরো প্যালেস দুই পর্যায়ে চতুষ্কোণ দেয়াল পরিবেষ্টিত। বাইরের চার মিটার চওড়া দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটা যায়। এসব জিনিষ ও নিদর্শন না আসলে বোঝা যেত না । মনে মনে ভাবি সেই কত শত বছর আগে মানুষ উটের পিঠে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে এসব মরুময় অঞ্চলে তীব্র উত্তাপের মধ্যে যুদ্ধ করেছিল এবং শহীদ হয়েছে। আমরা টেক্সি করে ভাল পিচঢালা রাস্তা দিয়ে এসেও টায়ার্ড । এখন দোকান পাট খাবার পানি, সবই আছে । তখনতো কিছুই ছিল না এই মরু প্রান্তরে । আল্লার কাছে তাই হাজার শোকর করলাম ভাল আছি এজন্য । নাজাফ কারবালা ও কুফা দেখার পর আমরা ব্যাবিলনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম ।
ব্যাবিলন
মনে অনেক আগ্রহ কি না কি দেখব । ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছি ব্যাবিলনীয় প্রাচীন সভ্যতার কথা। পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি ব্যাবিলনের শূন্যদ্দ্যান । ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের কথা মনের মধ্যে একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাগদাদ থেকে নব্বই কিলোমিটার দক্ষিণে ব্যাবিলন। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০৫-৫৬৩ সময়কালে রাজা নেবুচাদ নেজার এর পুনঃনির্মাণ করেন। নেবুচাদ নেজারের আমলে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য শীর্ষে পৌঁছে। এক ঘন্টা চলার পর ব্যাবিলনের কাছে একটা হোটেলে লাঞ্চ করার জন্য থামলাম। ড্রাইভার সহ আমরা ভাত চিকেন ও ভেজিটেবল খেলাম। ইরাকী ষ্টাইলে রান্না। ভাজাভাত ও ঝোল মসলার অন্য এক স্বাদের মুরগীর মাংস । যাক খিদে পেটে সব হজম হয়ে যায় । প্রায় ৮২৫০ ইরাকী দিনার বিল দিলাম । ১০ ডলারের কম হবে তখনকার হিসেবে । খাওয়া শেষে আবার যাত্রা শুরু । পথে মরুভূমির মধ্য খানে বিশাল এক উটের পাল রাস্তা অতিক্রম করছে । আমরা ট্যাক্সি থেকে নেমে ছবি তুললাম । মরুভূমির চিরচেনা দৃশ্য সেই মরু জাহাজ উট । বিশাল কিন্তু শান্ত প্রাণী কোন দিকে না দেখে সোজা গন্তব্যে চলছে । বিশাল উটের বহর । ইরাক প্রাকৃতিক দিক থেকে আশ্চর্য এক মিশ্রণ। শত শত মাইল জুড়ে ধু-ধু খাঁখাঁ মরুভূমি যেমন আছে,তেমনই আছে চোখ জুড়ানো সবুজ। পথে পথে দেখলাম ভুট্টার ক্ষেত আর ফলের বাগান। ছোট ছোট গাছে জড়িয়ে আছে ডালিম আর পিয়ার। পিয়ার পেকে নরম হবার পূর্বে কচকচে খেতে মজা। আছে খেজুরের বাগান।
ব্যাবিলনের গেইট
এরপর ব্যাবিলনের গেইটে এলাম, কোথায় উদ্যান, কিছুই দেখি না। বিশাল দুর্গের গেইটের মত দুটো পিলার ইটের তৈরী মধ্যে মাটি দিয়ে বিভিন্ন প্রাণীর নক্সা আঁকা, গাইড আছে। গাইড বই নিলাম একটা । আস্তে আস্তে ভেতরে গেলাম। ব্যাবিলন পরিখা এবং দেয়াল দ্বারা দুই পর্যায়ে পরিবেষ্ঠিত ছিল বলে জানা যায়। বাইরের দিকের দেয়াল ষোল কি.মি এবং ভিতরের দিকের দেয়াল আট কি.মি.লম্বা ছিল। আমরা এলাকায় ঢুকে ডাইনে-বাঁয়ে কোথায় কী প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি। গাইড প্রাচীন কালের কথা গুলো বর্ণনা করে যাচ্ছিল । এটাকে শুন্যদ্যান বলা হয় , কারন এর অনেক উঁচু উঁচু প্রাচীরের উপর তখনকার সময় ফুলের গাছ লাগানো থাকত । নীচ থেকে ধাপে ধাপে প্রাচীর উপরে উঠে গিয়েছিল এবং সেই সব ধাপে ফুলের গাছ গুলোকে দুর থেকে মনে হতো যেন শুন্যে বাগান সাজানো রয়েছে । এখন সে সব কিছু নেই । তবে পুরু দেয়াল গুলোর কিছু কিছু পুনঃ নির্মান করা হয়েছে । এলাকার উত্তর অংশে মূল প্যালেসে রয়েছে ‘লায়ন অব ব্যাবিলন’ দেবী ইশতার এর প্রতীক, পাথরের অর্ধেক সিংহ অর্ধেক মানুষ এর মূর্তি এটা ছিল এখানকার দেবতা ও রক্ষক। এখন মূর্তিটা কিছুটা ভেংগে গেছে । ভেতরে অনেক গুলো কক্ষ আছে । প্রসাদের কোথায় যুদ্ধ হতো মানুষকে ফাঁসি দেয়া হতো এসব জায়গা গুলো গাইড আমাদের দেখালো । অনেকটা গোলক ধাধার মত লাগে । ঠিকমত গাইড না পেলে ভেতরে পথ হারানো অতি সোজা । সব বাঁক ও দেয়াল প্রায় একরকম মনে হয় ও একবার দিক হারালে অনেকক্ষণ এই রোদের তাপে ঘুরতে হয় দর্শকদের । গাইড আমাদের বের করে নিয়ে আসল ঠিক ভাবে । আজকের ঘটনা বহুল দিনটাতে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো । এই দুটো চোখ দিয়ে আল্লাহতায়ালা ধর্মীয় স্থান ও ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান গুলো দেখালেন, আমিন।
লায়ন অব ব্যাবিলন
এবারের বাগদাদের অবস্থান ঘটনা বহুল হলো । হোটেলে ফিরে এলাম ট্যাক্সিতে করে । বিকেলে ফ্রেস হয়ে রেষ্ট নিলাম । এরপর বাগদাদের আল রশিদ ষ্ট্রীটে হাটতে বের হলাম । আজকের দিনের তোলা ছবি গুলো ওয়াশ করলাম এখানকার ষ্টুডিওতে। খরচ প্রায় বাংলাদেশের মতই । একটা গানের ক্যাসেট কিনলাম । আরবী ভাষার গান । তখনকার সময়ের বেশ হিট ও ফেমাস গায়িকা ডায়ানা হাদ্দাদ এর, লে ইয়া হাবিবি তাফা হাই ফাই গানটা অনেক শুনেছি এখানে । এখন নিজের কাছে সংগ্রহের জন্য ক্যাসেট কিনলাম । ঘটনা বহুল দিনটার সমাপ্তি রাতে নেমে এলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৩৪