বাগদাদে আসলেই বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (র) এর মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ার চেষ্টা করতাম। বড়পীর (র) সাহেবের মাজারে যাওয়ার কথা শুনলেই মনটা আনন্দে ভরে যেত। হোটেল থেকে টেক্সি নিয়ে চলে আসতাম এখানে। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে আব্দুল কাদের জিলানী (র) বললেই জায়গামত পৌছে যেতাম। টেক্সি ভাড়া ৫০০ দিনার লাগত আমাদের টাকায় ১২ টাকা, বেশ সস্তা। মাজারের পাশেই মসজিদ। মসজিদে ঢোকার পথে ফেরীওয়ালারা আতর, তসবিহ, তবারক ইত্যাদি নানা জিনিষপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছে। একটু এগিয়ে গেলে মসজিদের মূল পথ ও ওযু করার জায়গা। মসজিদের মধ্যে ভেতরে বিশাল চত্বর, জুম্মার দিনে মানুষে ভরে যায়। চত্বরের পেছনে আবাসিক এলাকা, ছাত্রদের থাকার জন্য। সেখানে যাওয়া হয়নি।
বড়পীর (র) মাজার মসজিদের একপার্শ্বে, বিশেষ বিশেষ সময়ে তা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা হয়। তখন দর্শনার্থীরা ভেতরে গিয়ে মাজারের চারপাশ ঘুরে আসে ও রুহের মাগফেরাত কামনা করে। অতি আবেগ প্রবণ মানুষ মাঝে মাঝে রওযায় চুমু খায় ও বেষ্টনী ধরে দাড়িয়ে গিয়ে কান্নাকাটি করে। পুলিশ বেশ কড়া ভাবে তাদের সরিয়ে দেয়। সাধারণত জুম্মার নামাজের পর কিছুক্ষণের জন্য মাজার খোলা হয়। আগে থেকে দাঁড়িয়ে না থাকলে ভিতরে মানুষের চাপে ঢোকা বেশ কষ্টকর হয়। বাগদাদে থাকাকালিন মোটামুটি প্রায় সব জুম্মার নামাজ এই মসজিদে পড়ার সুযোগ আল্লাহ দিয়েছিলেন। জুম্মাবারে ১২ টার আগেই মসজিদ ও তার আশপাশের এলাকা মুসল্লীতে ভরে যায়। তাই ট্যাক্সি নিয়ে আমরা আগেই চলে এসেছি। এতক্ষনে মসজিদ ভরে গিয়ে বাইরের বিশাল চত্বরে মানুষ ঢুকছে কিছু কিছু মসল্লী ওজুর জন্য দাড়িয়ে আছে। এই মসজিদের একজন খাদেম বাংলাদেশী। বেশ বয়স্ক, প্রায় ৪০ বৎসর ধরে এই মসজিদে খিদমত করে আসছেন। আমরা দলে কয়েকজন হওয়াতে ও বাংলা কথা শুনে তিনি এগিয়ে এসেছেন। তিনি আরবী ভাষায় সুন্দর ভাবে কথা বলেন তবে বাংলা ভুলে যাননি। সালাম দিয়ে তার খোজ খবর জিজ্ঞাসা করলাম। এদেশের করুন অবস্থাতেও তিনি মোটামুটি ভালোভাবেই জীবনযাপন করছেন। স্ত্রী ও বেশ কয়েকজন সন্তান আছে তাঁর। দেশে যাওয়া আর হয়ে উঠেনি। মেয়েদেরকে স্থানীয় ছেলেদের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরাও এদেশীয় মেয়েকে বিয়ে করেছে। দিন কেটে যাচ্ছে। আমাদেরকে উপহার দিতে চাইলেন। আমরাও তাঁকে কিছু উপহার দিলাম। তিনি আতর দিলেন ও দোকান গুলোতে নিয়ে গিয়ে ভাল দামে আমাদের পছন্দের জিনিষ কিনতে সাহায্য করলেন। জুম্মার নামাজ শেষে আমরা মসজিদের ভেতরে ঢুকি এতক্ষনে কিছু জায়গা ফাঁকা হয়েছে। তবে অনেক আগ্রহী মুসল্লী মাজার যেয়ারতের জন্য অপেক্ষা করছে। মসজিদের ভিতর কার্পেট বিছানো কোরান শরীফ আছে কেউ কেউ কোরান পড়ছে। খাদেম দরজা খুলে দেয়ার সাথে সাথেই ভিড় উপচে পড়ছে মাজারের ভেতরে যাওয়ার জন্য। ভীড়ের মধ্যে ভেতরে ঢুকতেই চোখে আপনা আপনি পানি চলে এলো। এটা ভক্তি না ভালবাসায় বুঝতে পারলাম না। ছোট বেলা থেকে বড়পীর (র) নাম শুনেছি আজ তাঁর রওজা মোবারক দেখার সৌভাগ্য আল্লাহ দিলেন। আল্লাহর কাছে অশেষ শোকর, আমিন। ইরাকে থাকাকালীন মাজারের ভিতর ২ বার যেতে পেরে ছিলাম বলে নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান মনে করেছি। আল্লার কাছে সৌভাগ্যের জন্য দোয়া চাইলাম মনটা ভরে গেল।
ইরাকে এই মাজারকে আল কাদেরিয়া মাজার বলে। এটা আল রুসাফা এলাকার বাব আল শেখ এ অবস্থিত। বাব আল শেখ,শেখ আব্দুল কাদের আল জিলানী (র) এর নামানুসারে রাখা হয়েছে। এই জায়গাটা একসময় হাম্বলী ইসলামী ব্যক্তিত্ব শেখ মুবারক বিন আলী বিন আল দু সাইন আবু সাইদ আল মাখরুমী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটা স্কুল ( ইসলামিক জ্ঞান অর্জনের ) ছিল। পরবর্তীতে এই স্কুলটার কলেবর বৃদ্ধি ও এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন প্রসিদ্ধ ইমাম বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র) । ১০৭৭ সালে তিনি কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণের জিলান নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। যুবক বয়সে তিনি বাগদাদে আসেন এবং বাগদাদের ধনী গরীব নির্বিশেষে সবাই তাকে সাদরে গ্রহন করে। পরবর্তীতে তিনি একজন খ্যাতিমান শিক্ষক ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব হয়ে সুনামের সাথে তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বিতরণ করেন। ১১৬৬ সালে হিজরী ৫৬১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং স্কুলের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে এটা একটা মসজিদে রুপান্তরিত হয় এবং বাগদাদের অন্যতম বৃহৎ মসজিদগুলোর একটাতে পরিণত হয়।
এই মসজিদের উন্নয়ন বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে হয়েছে। সবচেয়ে বড় ধরণের সংযোজন হয় ১৫৩৪ সালে । এ সময় সুন্দর ও বিশাল গম্বুজ নির্মান করা হয়। এটা ইট ও জিপসাম দ্বারা নির্মিত ইরাকের সর্ববৃহত গম্বুজ। এটা এখন ও বর্তমান। ১৮৯৮ সালে এই মসজিদে একটা বিশাল টাওয়ার তৈরী করে একটা ঘড়ি লাগানো হয়েছিল। টাওয়ারটা ইরাকের প্রথম প্রধানমন্ত্রী আব্দুর রহমান আল নাকিব নির্মাণ করেছিলেন এবং ঘড়িটা বোম্বের বিখ্যাত পুনা ওয়ার্কশপে নির্মাণ করা হয়েছিল। এটা ৩০ মিটার উচু এবং এখন পর্যন্ত একনাগাড়ে সময় দিয়ে চলছে। ১৯৭০ সালে এই মসজিদের আরো উন্নয়ন হয়েছে এবং নীল ও সাদা গম্বুজ দুটো আরো সুন্দর করে এটাকে দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক স্থাপত্যে রুপান্তর করা হয়েছে। নিজেকে ভাগ্যমান মনে করি আল্লাহতায়ালা এই মাজার ও মসজিদ দেখার ও এতে নামাজ পড়ার তৌফিক দেয়ার জন্য।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) মাজার ও মসজিদ
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর মাজার ও মসজিদ
আমাদের হানাফী মাজহাবের শ্রদ্ধেয় ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর মাজার ও মসজিদ বাগদাদে আল ইমাম আল আদহাম মসজিদ হিসেবে সুপরিচিত। যখনই জানতে পারলাম তাঁর মাজার বাগদাদে তখনই আর দেরী না করে মাজার যেয়ারতের জন্য মনটা আকুল হলো। বিকেল বেলা আছরের পর সময় করে একদিন টেক্সি নিয়ে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) মাজার ও মসজিদ এলাকায় পৌঁছে গেলাম। বিশাল এলাকা নিয়ে দৃষ্টি নন্দন মসজিদ। শেষ বিকেলে আমরা যখন মসজিদে যাই তখন লোকজন একেবারেই ছিল না। প্রবেশ করার জন্য গেইট খুলে নিজেরাই ভিতরে যাই। প্রথমেই বিশাল খোলা চত্বর এবং এরপর মূল মসজিদ। একজন খাদেমকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। আমরা সালাম দিয়ে বললাম বাংলাদেশ থেকে এসেছি। হাসিমুখে তিনি আমাদের ভেতরে যেতে বললেন। সুন্দর সাজানো মসজিদ,কার্পেট মোড়া সাথে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) মাজার। এই মসজিদ ও মাজার বাগদাদের আবু হানিফা এবং আল আদহামিয়া জেলায় অবস্থিত। কথিত আছে ৭৬৭ খৃষ্টাব্দে (১৫০ হিজরী ) যখন ইমাম আদহাম আবু হানিফা আল নুমান বিন থাবিত আল কুফী মৃত্যুবরণ করেন তখন তাঁকে এখানে দাফন করা হয় এবং তারপর থেকে জায়গাটার এই নামকরণ করা হয়।
আমরা নিজেদের হানাফী মাযহাবের অনুসারী হিসেবে জানি তাই আমাদের ইমাম এর মাজার যিয়ারত করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। মনটা আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠে। ইমাম আবু হানিফা ৭০১ সালে কুফা নগরে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি রসুল (সঃ) এর কতিপয় বয়জেষ্ঠ সাহাবীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পান এবং তাদের নিকট হতে সরাসরি জ্ঞান লাভ করেন পরবর্তীতে তিনি কুফাতে ইসলামের শিক্ষা বিস্তার শুরু করেন এবং ইসলামের একজন জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব হিসেবে হানাফী মাজহাবের প্রবর্তন করেন। ইমাম আবু হানিফা (রঃ) মাজার বর্তমান অবস্থায় আসার আগে নানা ধরনের স্থাপত্যের ধাপ অতিক্রম করে এসেছে। ১০৬৬ সালে সুলতান আরসালান এর সময় এর কিছু সংস্কার করা হয় এবং একটা বিশাল গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৬৩৮ সালে বর্তমান মসজিদের গম্বুজটি নির্মিত হয়। মাজার সংলগ্ন এলাকাতে ১৮৭১ সালে বর্তমান মসজিদটি নির্মিত হয় এবং ১৯০৩ সালে এটাকে সংস্কার করা হয়। ১৯৪৮ সালে এর বাইরের আচ্ছাদিত পথ তৈরী করা হয় যা পেছনে মসজিদটিকে বেষ্টন করে আছে। এই মসজিদের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিনন্দন দিক হলো এর বিশাল ঘড়ি। এই ঘড়িটা ১৯২১-২৯ সাল নাগাদ নির্মিত এবং ১৯৫৮ সালে বর্তমান অবস্থানে এটাকে স্থাপন করা হয়। এটা প্রয়াত আব্দুল রাজ্জাক মাসুব আল আদহামি তাঁর নিজস্ব ওয়ার্কশপে নির্মান করেন এবং এর নির্মাণ স্থানীয় কাঁচামাল ও শ্রমিক দ্বারাই হয়েছিল। বর্তমানে এটা বাগদাদের অন্যতম প্রধান মসজিদ ও মাজার। বর্তমানে ইরাকের অবস্থা এবং বিভিন্ন বিধিনিষেধ থাকায় পর্যটক অনেক কম আসাতে জন সমাগম কম। তবে এখানে সবসময় পর্যটকের আনাগোনা চলছেই। আছরের নামাজ শেষে আমরা এক মনে মাজারের পবিত্র জায়গায় দাড়িয়ে দোয়া করলাম। মসজিদ বিশাল এলাকা নিয়ে তাই আস্তে আস্তে আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সুন্দর ভাবে সাজানো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং ভীষণ নিঃস্তব্দ। এখানেই শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন হানাফী মাজহাবের প্রবক্তা ইমাম আবু হানিফা (রঃ) । আল্লাহ তাঁর বিদেহী আত্মাকে শান্তিতে রাখুক আমিন। মাজার, মসজিদ দেখে ও যিয়ারত করে প্রশান্তিতে ভরে উঠা মন নিয়ে হোটেলে ফিরে আসি।