গেন্টিং- মালয়েশিয়া
কুয়ালালামপুরে আসার পর ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ বললো গেন্টিং ঘুরে আসা যাক, আগের দিন এক ফাঁকে বাসের টিকিট কেনা হয়ে গেল । গেন্টিংকে মালয়েশিয়ার মন্টিকার্লো বলা হয় । রাতের বেলা গেন্টিং যেন এক উজ্জল ঝলমলে জগৎ। এটা সমুদ্র সমতল থেকে দুই হাজার মিটার উচুতে অবস্থিত । কুয়ালালামপুর থেকে অতি অল্প সময়ে ড্রাইভ করে গেন্টিং যাওয়া যায় । এটা শুধু ক্যাসিনোর জন্য বিখ্যাত এ কথা বলা যাবে না। এখানে একটা পুর্ণাংগ গলফ কোর্স,পরিবার নিয়ে আনন্দ করার মত আন্তর্জাতিক মানের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থাও রয়েছে । নভেম্বরের শেষে কুয়ালালামপুরে আবহাওয়া একটু গরম লাগছিল । পরদিন সকাল ০৮ টার দিকে বাসে করে রওয়ানা হলাম । চিরাচরিত শহর, ট্রাফিক জ্যাম ছেড়ে হাইওয়েতে এসে পরলাম। কিছুক্ষণ চলার পর বাস গেন্টিং এর পিচ ঢালা পাহাড়ী পথে চলে এল । পাহাড়ী পথ বেয়ে বাস আস্তে আস্তে এঁকে বেকে উপরে উঠছিল । উপরে মেঘের কাছাকাছি বৃষ্টিও হচ্ছিল, অল্প অল্প ঠান্ডা লাগছিল,নির্মল প্রকৃতি আমার মনকে টানছিল । গেন্টিং বাস ষ্টপেজে আসার পর কেবলকারে করে শৈলশিখরে যাওয়ার জন্য টিকেট কেনা হলো । সুন্দর ভাবে সাজানো গোছানো ষ্টেশন,একটা করে ক্যাব আসছে ভ্রমণ পিপাষুরা উঠছে, কার চলছে যেন অনন্তের পথে উর্ধ্বাকাশে শৈলচুড়ার দিকে, নীচে পাহাড় ও বন। কৃত্রিম জীব জন্তুর রেকর্ড করা হুংকারের শব্দ বাজছে,নানা রকম জীব জন্তুর মূর্তি বানানো রয়েছে । ক্যাবল কারে যেতে যেতে দেখছি আর অনুভব করছি । নীচে ঘন বন তার মাঝ দিয়ে রাস্তা রয়েছে । এই রাস্তা দিয়েও উপরে উঠা যায় । বেশ লম্বা জার্নি ,ক্যাবল কারে চলার পথে বাতাসের হিস হিস শব্দ রোমাঞ্চকর অনুভুতির সৃষ্টি করে। উপর থেকে আশে পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায় । একসময় গন্তব্যে চলে এলাম ।
জেন্টিং যেন আরেক জগৎ যা মানুষকে মোহাবিষ্ট করে। সব বয়সের মানুষের জন্য সব ব্যবস্থা রয়েছে । অনেক মানুষের মেলা। এসেই ফিরতি টিকেট কেনার জন্য লাইনে দাড়ালাম। ৪টার দিকে ফেরার টিকেট নিলাম এর আগের ফেরার টিকেট ছিল না। জেন্টিং এক আনন্দময় জগত। মেঘের দেশে পাহাড়ের এই চুড়াতে মানুষকে নানা ভাবে তার আনন্দ দেবার সামগ্রী দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে । এখানে আছে হোটেল,ক্যাসিনো,দোকানপাট,ভিডিও গেম ও অন্যান্য নানা রকম খেলা ধুলা ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা । প্রথমে এলাকাটা একটু ঘুরে দেখলাম,পথ হারানো খুব সোজা,এটা যেন গোলক ধাঁধা তবে একটু বুদ্ধি করে আরোমার্ক করা সাইনগুলো দেখে সহজেই জায়গামত যাওয়া যায়। অনেক ভিডিও গেম লাগানো আছে,বাচ্চা কাচ্চাদের চিৎকার ,গেমের শব্দে এলাকা বেশ গরম। আরো আছে বোট, ট্রেন ভ্রমন, কর্ক স্ক্র ,গ্রান্ড প্রিক্স গোকার্ট ও বাচ্চাদের নানা ধরনের খেলার ব্যবস্থা। একটা চক্কর দিয়ে আমরা ক্যাসিনোতে যাওয়ার প্লান করলাম। ক্যাসিনোতে ঢুকতে হলে টাই কিংবা বাটিকের শার্ট পরতে হয়। পাশেই বাটিকের শার্ট ভাড়া পাওয়া যায়। নির্ধারিত ফি দিয়ে শার্ট ভাড়া করে ভিতরে গেলাম। এ এক বিশাল ব্যাপার । একটা বিশাল এলাকা জুড়ে বিভিন্ন রকমের আয়োজন। কিছু কয়েন সংগ্রহ করে আমরাও বসে পড়লাম একটা স্লট মেশিনের কাছে। খেলার উত্তেজনায় ২/৩ ঘন্টা যে কিভাবে কেটে গেল টেরই পাইনি। এই ফাঁকে কয়েন কেনার টাকা কেমনে যেন ফেরৎ এসেছে। বাইরে এলাম ক্যাসিনো থেকে । শার্ট ফেরৎ দিয়ে জামানত ফেরত পেলাম। বের হওয়ার সময় দেখলাম অনেকে ক্যাসিনোর বাহিরে বসে ঝিমুচ্ছে,কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হয়তো আবার ক্যাসিনোতে ঢুকবে। কেন যেন মনে হচ্ছিল এটা একটা বেশ ভাল ব্যবস্থা। হাতের সময়টুকু কাজে লাগাতে আশে পাশের দৃশ্যগুলো দেখতে বের হলাম। হু হু বাতাস বইছিল। ভেতরে এয়ার কন্ডিশনের বাতাস, বাইরে প্রকৃতির উদার নির্মল হাওয়া । বিশাল নির্মাণ কাজ দেখছিলাম ,কিছু ছবি তুললাম। সুন্দর ভাবে বাগান করা,বিভিন্ন রকম পতাকা দিয়ে সাজানো এলাকা । আকাশে তখন সূর্য্য মেঘের লুকোচুরি চলছিল । মেঘগুলো হাতের উপর দিয়ে উড়ছিল । চারিদিকের পাহাড় ও বন নিস্তব্দ প্রকৃতি, অনেক মানুষের কোলাহলও নিস্তব্ধতা ম্লান করতে পারছিল না । সবার জন্যই যেন ব্যক্তিগত সময় সুযোগ এখানে রয়েছে। জেন্টিং সম্বন্ধে একটা প্রচলিত গল্প শুনলাম । একজন লোক একটা বাতি নিয়ে রাতে জুয়া খেলতো এই পাহাড়ে , তার সাথে খেলতে অন্যান্য লোকজন এসে জমা হত এবং সে প্রায়ই জিতে যেত। এধরনের একটা ধারণা থেকে আজ এই বিশাল স্থাপনা। একজন মানুষকে অনায়াসে ব্যস্ত সময় থেকে জেন্টিং দুরে ছুড়ে দিতে পারে । ভুলিয়ে দিতে পারে ব্যস্ততা । কেউ জেন্টিং এ এলে যেন হাতে সময় নিয়ে আসে, তা না হলে পরে মনে দুঃখ বোধ থাকতে পারে যে সব দেখা হলো না। আর একটু থাকলে কি বা ক্ষতি হত। এবার ফেরার পালা যথানিয়মে ক্যাবল কারে চড়লাম জেন্টিং পিছনে ফেলে নীচের ষ্টেশনের উদ্দ্যেশে। ষ্টেশনে এসে বাসে বসলাম। সময়মত বাস ছাড়ে। ওদের সময় জ্ঞান মুগ্ধ হওয়ার মত। এখানেও সুন্দর করে সব সাজানো গোছানো। ফুলের বাগানে বসার ব্যবস্থা রয়েছে, কাছে দিয়ে ক্যাবল কারের রং বেরং এর কারগুলো যাচ্ছে আসছে। কেউ যায় কেউ আসে এভাবেই সময় চলে যায়। আর গেন্টিং মানুষকে হাতছানি দেয়। এখানে যেমন রয়েছে কৃত্রিম আনন্দ তেমনি রয়েছে অনাবিল প্রকৃতি, সব যেন মিলে মিশে এক হয়ে জীবনকে জাগিয়ে তোলে । সার্থক এর পরিকল্পনাকারীর মনোবাসনার বহিঃ প্রকাশ । মানুষকে নির্মল আনন্দ দিতে পেরেছে তার প্রচেষ্টা । কুয়ালালামপুর এলে অবশ্যই পাঠক একবার এখানে বেড়াতে যাবেন। ভাল লাগলে আনন্দ পাবো । এই ভেবে যে আমার আনন্দ আমি আপনাদের মাঝে বিলিয়ে দিতে পেরেছি।
জেটিং থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । হোটেলে এসে ফ্রেস হয়ে একটু আশেপাশে মার্কেটে ঘুরতে গেলাম ২/১টা জিনিস কিনলাম । জিনিষ পত্রের দাম ডলার দিয়ে কিনলে একটু কম লাগছিল । রাতে কাপড় চোপড় গোছালাম । পরদিন ভোরে সিংগাপুরের বাস ছাড়বে । আব্দুল্লাহকে টাকা দিয়েছিলাম বাসের টিকেট কেনার জন্য সেই টিকেট কিনে আনলো । ওর আন্তরিকতা ভোলার মত না । তাই বার বছর পরও ওর আতিথেয়তা মনে আছে । কুয়ালালামপুরে অবস্থান কালীন আমরা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে আব্দুল্লাহর সাথে শহর দেখতে বের হয়েছিলাম । মালয়েশিয়ার জন্য সেই সময়টা ছিল মিশ্র সময় একদিকে উন্নতি হচ্ছিল অন্যদিকে মন্দার ধাক্কা সামলাতে হচ্ছিল । মহাথীর মোহাম্মদ তখন মালেয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তিনি পুত্রজায়াতে সরকারের সব অফিস আদালত স্থানান্তরের পক্ষে ছিলেন । বিশাল এলাকা নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক এই পুত্রজায়া শহর নির্মাণ করা হয়েছিল । তখন কাজ শেষ হয়েগিয়েছিল প্রায় তবে সব অফিস আসেনি তখনো । আমরা গাড়ীতে করে সুন্দর সুন্দর স্থাপনা গুলো দেখতে দেখতে চলছিলাম । তারপর আমাদের মনে হলো কুয়ালালামপুরের পেট্রোনাস টাওয়ার দেখার । ট্যাক্সি নিয়ে টাওয়ার এলাকায় এলাম । বেশ কড়া নিরাপত্তা । অনেক দুর পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয়, টিকেট লাগে উপরে উঠতে । নীচে থেকে টাওয়ার সহ ছবি তুলতে চেষ্টা করলাম । ক্যামেরার রেঞ্জে আসে না, বিশাল স্থাপনা সুবহানাল্লাহ । তখন আমেরিকায় টুইন টাওয়ার ছিল । এটা তার থেকেও উঁচু । দ্রুতগামী লিফটে করে আমরা এর রিভলারিং ডেকে চলে এলাম । এখান থেকে পুর্ ো কুয়ালালামপুর শহর দেখা যায় । অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য । তখন বিকাল হয় হয়। বাতি গুলো জ্বলেনি তখনো । সূর্যের শেষ আলো মালয়েশিয়ার রাজধানীর উপর পড়ছিল। এই টাওয়ারটা ঘুরে আস্তে আস্তে। উপরে থাকলে বুঝা যায় না । তবে চারদিকের দৃশ্য যে বদলে যাচ্ছে তা বুঝা যায় । কফি ও হালকা খাবার পাওয়া যায় । এছাড়া স্যুভেনিরের ও দোকান আছে এখানে। দাম একটু বেশী। আমরা কফি খেলাম এখান থেকে । নামতে ইচ্ছে করছিল না । বেশ কিছুক্ষণ টাওয়ারে থেকে গোটা রাজধানী শহর এর দৃশ্যাবলী দেখে নামার জন্য তৈরী হলাম । অতি অল্প সময়ে লিফট আমাদের নীচে নিয়ে এলো । শূন্য থেকে আবার মাটির মানুষ মাটিতে ফিরে এলাম । তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে শহরের বুকে । আমরাও ট্যাক্সিতে চড়ে আমাদের গন্তব্য হোটেলে ফিরে এলাম । ভোরে ট্যাক্সির কথা হোটেল রিসেপশনে বলে রেখেছিলাম । ৫ টায় উঠে ট্যাক্সি নিয়ে মালয়েশিয়া - সিংগাপুর বাস ষ্ট্যান্ডে চলে এলাম । যথা সময়ে বাস ছাড়ল । এবারের বাস আরো আরামদায়ক এবং ভাড়াও কম । ১৭ রিংগিত মাত্র । সিংগাপুর ডলারে বেশ কম । খুশি লাগছিল এই ভেবে যে যাওয়ার পথে কুয়ালালামপুর থেকে সিংগাপুর দেখতে দেখতে যাব। বাস ছেড়ে দিল কুয়ালালামপুর শহর ছাড়িয়ে বাস হাইওয়েতে উঠল ।
রাস্তার দুপাশে সারি সারি পাম বাগান ও জংগল। একেবারে একঘেয়ে দৃশ্য তেমন কোন পরিবর্তন নাই । বেশ দীর্ঘ পাম গাছ গুলো । এগুলোর ফল থেকে উৎপাদিত পাম ওয়েল আমাদের দেশে আসে । অনেক দুর যাওয়ার পর ২/৪ জন মানুষ দেখা যায় । এরা দরিদ্র । হয়ত আশেপাশের গ্রামে থাকে । বাস সেই আগের মত বিরতী নিয়ে এগিয়ে চলল । বিরতীর জায়গা গুলো দিনের আলোতে দেখলাম । সুন্দর করে ফুলের বাগান দিয়ে সাজানো । হাত পা একটু ঝেড়ে আবার যাত্রা শুরু । জহুরবারুতে এসে শহর দেখলাম । রাস্তার দুপাশে একতলা দোতলা বাড়ী । মোটামুটি মধ্যবিত্ত উচ্চ মধ্যবিত্তদের আবাস দেখা যায় । অনেকক্ষণ পর দৃশ্যপট পরিবর্তন । যথাসময়ে মালাক্কা প্রনালীর নির্মিত ব্রিজের কাছে ইমিগ্রেশনে চলে এলাম, সিংগাপুর বাস ষ্ট্যান্ডে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেল । মালয়েশিয়ার আনন্দ ও অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে ফিরে এলাম সিংগাপুরে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:১২