বাগদাদ থেকে প্লেনে করে কুয়েতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । এর আগে বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে এসে এয়ারপোর্টে সাফির হোটেলে এক রাত ছিলাম। কুয়েেতর ভেতরে ঢোকা হয়নি । পারস্য উপসাগরের উত্তর পশ্চিম উপকুলে মরুভূমির বুকে ছোট্ট দেশ কুয়েত । এর উত্তরে ইরাক ও দক্ষিণে সৌদিআরব।১৯৩০ সালের দিকে কুয়েতে বড় বড় তেলক্ষেত্র গুলো আবিষ্কার হয়। মাত্র ২.৭ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত কুয়েত তেলক্ষেত্রের কারণে এখন পৃথিবীর অন্যতম ধনী একটা দেশ। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে কুয়েত স্বাধীনতা লাভ করে এবং তারপর থেকেই এর অর্থনৈতিক অগ্রগতি চলমান। ১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েতে আগ্রাসন চালায় এবং দখল করে। পরবর্তীতে ইরাকী বাহিনী কুয়েত ছেড়ে যাওয়ার সময় শত শত তেলক্ষেত্রে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। হঠাৎ করেই সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত আগ্রাসনের ফলে দেশটা পৃথিবীর সব মানুষের সহানুভুতি কাড়ে । কুয়েত একটা সমৃদ্ধশালী দেশ । ছোট্ট দেশ অল্প মানুষ । তেল সম্পদের প্রাচুর্য । কুয়েত এয়ারপোর্ট বেশ সুন্দর, অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা আছে । অনেক বাংলাদেশীকে দেখা যায় এখানে। এর দুটো কারণ, একটা হলো কুয়েতে ইউ এন মিশনে বাংলাদেশীরা কর্মরত এবং এরা সময় সময় দেশে যাওয়া আসা করে । এছাড়াও শ্রমিক বিশেষত ক্লিনার, ওয়েটার হিসেবে অনেক বাংলাদেশী তাদের ঘাম ঝরায় এই কুয়েতে । গাড়ী করে এয়ারপোর্ট থেকে রওয়ানা হলাম শহরের দিকে। আমাদের গন্তব্য কুয়েত সিটির ওল্ড খাইতান এলাকা। আরব পেনিন সুলার উত্তর পূর্ব কোনের এই দেশটা ভূমির আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর একটা অন্যতম প্রধান ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। কুয়েত সিটি হলো কুয়েতের রাজধানী। জাহরা আরেকটা অন্যতম প্রধান শহর। প্রধান আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা গুলো হলো সালমিয়া ও হাওয়ালী। বাগদাদ থেকে প্লেনে কুয়েত আসতে প্রায় দেড় ঘন্টা লাগে । নীচে মরুভূমি, সবুজ শ্যামলিমা মোটেই নেই । মাঝে মাঝে মরুভূমির বুকে যুদ্ধের ক্ষতের কাল কাল দাগ দেখা যাচ্ছিল । এখানে যুদ্ধকালীন ফেলে যাওয়া সরঞ্জাম মরুভূমির বুকে পড়ে আছে ।
কুয়েত শহর
কুয়েত শহরটা রুক্ষ মরুভূমি । এর মধ্য দিয়ে বিশাল বিশাল ওয়ান ওয়ে রাস্তা । রাস্তার মাঝে মাঝে ক্যামেরা ফিট করা আছে । বেশী স্পীডে গাড়ী চালালে ক্যামেরায় ছবি উঠে যায় । পরে যখন গাড়ীর কাগজপত্র নবায়ন করার জন্য যায় তখন এই ফটো দেখে জরিমানা করা হয় । সুন্দর ব্যবস্থা ফাঁকি দেয়ার কোন উপায় নেই । কুয়েতের আবহাওয়া বেশ গরম , সময়টা ছিল আগস্ট মাস । আমরা শুনছিলাম যে কুয়েতে ধুলিঝড় হয় । তবে ভাগ্য ভাল প্রথম দিন কোন ধুলিঝড় দেখিনি। থাকার ব্যবস্থা ভাল । এসি রুম তবে বাথরুমের পানি প্রচন্ড গরম । বালতিতে পানি ভরে রেখে দিলেও দুইদিন পর্যন্ত ঠান্ডা হয় না, তবে ব্যবহার করা যায় তখন । পানিতে বেশ আয়রণ, মাটির নীচ থেকেই পানি উঠায় এখানে ।
প্রথম রাতে এক বাংলাদেশী বাসায় দাওয়াত ছিল । সপরিবারে থাকে এখানে । বাংলাদেশী আতিথেয়তা মুগ্ধ হওয়ার মত । বিরিয়ানী চিকেন ইত্যাদি খেলাম । রাতের বেলায় গাড়ীতে করে কুয়েত শহর দেখতে বের হলাম । রাতেও সারা শহর আলোয় ঝলমল করছে । বিশাল ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর সমৃদ্ধ মার্কেট । সুলতান সেন্টার এ এলাম । এটা সারারাত খোলা থাকে । এখানে দেশী বিদেশী সবাই একা কিংবা পরিবার নিয়ে কেনাকাটা, ঘোরাফেরা ও খাওয়া দাওয়া করছে । সব ব্র্যান্ডের দোকান, সাধারণ পন্য তেমন একটা নেই বললেই চলে । এখানে সাধারণত বাংলাদেশী লোকজন কেনাকাটা করে না।তবে বেড়ানোর জন্য এটা বেশ ভাল জায়গা বলে প্রায় সবাই এখানে এসে বেড়িয়ে যায়।
কুয়েত শহর
বিদেশী এবং কুয়েতীরা সব লেটেষ্ট মডেলের গাড়ী নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। কুয়েতে বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তা মহিলাদের থাকার জন্য সুন্দর সুরক্ষিত আবাসিক এলাকা আছে। এগুলো দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ভেতরে অনেক বিলাস বহুল এপার্টমেন্ট, গেইটে সশস্ত্র প্রহরী। প্রত্যেকটা এপার্টমেন্ট ব্লকের উপর অজস্র ডিস,এন্টেনা বুঝিয়ে দেয় প্রাচুর্যের কোন কমতি নেই এখানে। হরদম লেটেষ্ট মডেলের গাড়ী আসা যাওয়া করছে গেইট দিয়ে। মরুভূমির সীমাবদ্ধতা এরা প্রাচুর্য দিয়ে একদম ঢেকে দিয়েছে । এর বিশালতা ও সৌন্দর্য মুগ্ধ হওয়ার মত ।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে অলস সময় কাটালাম । কুয়েতে শিয়া ও সুন্নী উভয় সম্প্রদায়ের লোক আছে তবে সুন্নীরা সংখ্যায় বেশী। দুপুর বেলা মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গেলাম । প্রচন্ড গরম কিন্তু আর্দ্রতা নেই তাই ঘাম তেমন হয় না । কিন্তু শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায় । রুমে এসে রেষ্ট নিলাম কিছুক্ষণ । সন্ধ্যা বেলায় কিছু কেনাকাটা করার জন্য মার্কেটে গেলাম । এখানে ইলেক্ট্রনিক্স জিনিষের কোয়ালিটি বেশ ভাল । রাতের বেলা গল্প গুজব করেও সময় কেটে গেল ।
কুয়েত শহর
কুয়েতে চাকুরীরত অনেক কর্মকর্তা ছুটিতে বিভিন্ন সময় ইউরোপের দেশ গুলো ভ্রমন করে এসেছে । কুয়েত থেকে ইউরোপের সানজেন ভিসা পাওয়া যায় । সেটা নিয়ে যে কোন দেশে বিমানে করে বাকী দেশ গুলো ট্রেনে কিংবা বাসে ঘুরে দেখা যায়। ভ্রমণকারীরা দিনের বেলা শহরটা দেখে ফেলে রাতের বেলা ট্রেনে কিংবা বাসে ঘুমিয়ে পরবর্তী দেশে পৌছে যায় । সেখানে ট্রেনে ফ্রেশআপ করে একই নিয়মে দেশ ঘুরে দেখা ।ব্যাচেলারদের জন্য এটা অপুর্ব এক সুযোগ । তাদের মুখে ভ্রমণের গল্প শুনে বেশ ভাল লাগল। এধরনের ভ্রমনে আনুমানিক ১৫০০ থেকে ২০০০ ডলার খরচ হয় । রাতের বেলায় এসি রুমে ঘুমাতে ঘুমাতে বেশ রাত হয়ে গেল । কুয়েতে মার্কেটগুলোতে টেলিফোন করার জন্য বেশ কিছু বুথ আছে । এখানে বিভিন্ন দেশের প্রবাসী লোকজন এসে ফোন করে । বাংলাদেশীও অনেক অপারেটর আছে । এখানে একটা বুথে দেখলাম কিছু বাংলাদেশী মহিলা তারা এখানে চাকুরী করে । এদের জীবন কাহিনী বেশ করুন । কুয়েতে অন্য কোন চাকুরী নিয়ে এসেছিল পরে সেখানে বিভিন্ন করনে চাকুরী করতে পারে নাই । দেশে ফেরার টাকা নেই । দেশ থেকে সব সহায় সম্পদ বিক্রি করে এসেছিল । এখানে অল্প বেতনে চাকুরী করে লুকিয়ে থাকে, ধরা পড়লে যে কোন সময় দেশে পাঠিয়ে দেবে । এছাড়াও কুয়েতে বাংলাদেশীরা অনেকে বলদিয়া বা মিউনিসিপালিটিতে চাকুরী করে। এধরনের এক ভাগ্যাহত যুবকের সাথেও কথা হয়েছিল। তার কাজ জুটেছিল মরুভূমিতে উটের রাখাল হিসেবে। মালিক একটা তাবুতে কিছু খেজুর ও পানি দিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ফেলে রেখে যেত। এর মধ্যে পানি বা অল্প খাবার শেষ হয়ে যেত, তাকে উপোষ থাকতে হতো এবং ভাগ্যের উপর নির্ভর করতে হতো ।
প্রবাস জীবন যে সবসময় আনন্দের না তা এদের দেখলে বুঝা যায় । তবে কেউ কেউ যে ভাল থাকত না তা নয়, ভালও ছিল অনেকে । তারা টাকা আয় করে দেশে পাঠাচ্ছে পরিবার পরিজনদের কাছে । এখানে ফিলিপিনো মহিলারা মনে হলো বেশ ভাল আছে । এরা বেশীর ভাগ দোকানে সেলস গার্ল হিসেবে কাজ করে । মালিকের সাথে বেশ ভাল সম্পর্ক এবং আয় উপার্জনও এদের বেশ ভাল । মার্কেট গুলো ঘুরেও প্রবাসী বাংলাদেশীদের সাথে কথা বলে এধরনের অনেক অজানা কথা জানতে পারলাম , অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে উঠলো আরো । কুয়েতে প্রথমে ভেবে ছিলাম প্রতিদিন রুটিন করে ঘুরতে বের হব । কিন্তু বিধি বাম । আসার পরদিন থেকেই ধুলিঝড়, ভাবতাম বিকেল বেলা ঝড় কেটে আকাশ পরিষ্কার হবে । দুর্ভাগ্য, তাই টানা দুই/তিন দিন একদম ঘোলা ও অন্ধকার পরিবেশ ছিল । তাই যত কম বাইরে যাওয়া যায় । অনেক গুলো মার্কেটে ঘোরা হলো । কুয়েতের আমির এর প্রাসাদ দেখলাম । কুয়েত সিটির সেই বিখ্যাত কমিউনিকেশন টাওয়ার এর ছবি তুললাম ।
কমিউনিকেশন টাওয়ার,কুয়েত
এই মরুভূমির দেশেও সাগরের পাড়ে পার্ক বানানো হয়েছে । সেখানে ঘুরতে গেলাম। কৃত্রিম ভাবে পানি দিয়ে ঘাস বাঁচানো হচ্ছে। ল্যান্ডস্কেপিং করে বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ লাগানো হচ্ছে । বেশ ভালই লাগে। ছবি তুলে মজা পেলাম না । ধুলায় ভরা বাতাসের কারণে ছবিগুলো কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার লাগে। কুয়েতের টেলিফোন ব্যবস্থা বেশ উন্নত। তিন কেডি দিয়ে কার্ড কিনলাম একটা । সরাসরি বাংলাদেশে কথা বললাম । বেশ পরিষ্কার শোনা যায় । সাগর ঘেষা পার্কে স্থানীয় কুয়েতীরাও আসে । আমাদের অবস্থান কালীন দুইটা ল্যান্ড রোভার এসে থামল । বিশাল এক কুয়েতী সাথে ২/৩ জন মহিলা ও অনেক গুলো বাচ্চা কাচ্চা গাড়ী থেকে নামল । এরা বেদুইন, দুর মরুভূমিতে তাবু খাটিয়ে থাকে । এখন এরা ড্রিল করে মাটি থেকে পানি তোলে । জেনারেটর আছে সেখানে বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থা করা হয় । শুধুমাত্র একটু পরিবর্তনের ছোয়ার জন্য এই বিচের পাশে আসা । এছাড়া এখানে বীচ এর আনন্দ তেমন নেই । Ÿাচ্চাদের জন্য পার্ক আছে সেখানে বাচ্চারা তাপমাত্রা কমে এলে খেলাধুলা করে ।
সোনার জিনিষ এখানে বেশ ভাল । তবে আমাদের দেশের মেয়েদের মত এরা সুক্ষ্ম জিনিষের প্রতি তেমন আকৃষ্ট না । মোটা মোটা চেইন দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যায়, ওজন এখানে প্রাধান্য পায়। টাকার কোন অভাব নেই তো । আমিও সোনার দোকানে গেলাম রেট লেখা থাকে সব আইটেমে সেলসম্যানরা ভারতীয় । তবে অনেক মালিক এদেশী। ভারতীয় সেলসম্যানদেরকে এরা বেশ কদর করে । সোনার চুড়ি কিনলাম। কুয়েতে কোয়ালিটি গ্যারান্টেড। কোয়ালিটি জিনিষ কিনতে চাইলে কুয়েত অবশ্যই সঠিক জায়গা । তবে সস্তা জিনিষ যে নেই তা না। মার্কেট ভেদে জিনিষ পত্রের দাম উঠানামা করে। এখানে যে সব বাংলাদেশী পরিবার আছে তারাও বেশ আন্তরিক । মজার মজার খাবার ও নাস্তা খেলাম ওদের বাসায়। উপরিপাওনা হলো তাদের গাড়ীতে কুয়েত শহর ঘুরে দেখা । কুয়েতে ছবি তোলার অনেক ইচ্ছে ছিল, ধুলিঝড়ের কারনে সব ছবি ঘোলা উঠল । দুর্ভাগ্য বলা যায় । তবে দেশটাকে সাজানো হয়েছে মরুভূমির বুকে আলোর টুকরার মত । তেল সমৃদ্ধ এই দেশের তেল সম্পদ মানুষের জীবন যাত্রাকে অনেক উপরে তুলে দিয়েছে । অনেক দরিদ্র আরব দেশের লোকজন এখানে কাজ করে । তবে নাগরিকত্ব কেউ পায় না। মিশরীয়রা মোটামুটি ভাল কাজ করে। আরব হওয়াতে এরা কিছু কিছু সুবিধা পায়। মসজিদ আছে আশেপাশে মাঝে মাঝে নামাজ পড়তাম সে সব মসজিদে গিয়ে । কুয়েতে বাংলাদেশ, ভারত,পাকিস্তান,শ্রীলংকা ,ফিলিপাইন,ইন্দোনেশিয়ার বহু পুরুষ ও মহিলা শ্রমিক বাসায়,অফিসে,দোকানে ও নানা ধরনের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে । শুক্রবার ছুটির দিন সবাই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে একত্র হয় । বিভিন্ন মার্কেট এলাকায় নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় কেনা কাটা ইত্যাদি চলে রাত ৯ টা ১০ টা অবধি । তারপর আবার যে যার কর্মস্থলে ফিরে যায় । এরাই টাকা পাঠায় আমাদের দেশে । দেশে এদের টাকার কদর, অথচ প্রবাসে এরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সব আনন্দ বাদ দিয়ে টাকা উপার্জনের সংগ্রামেরত । আমি এদের শ্রদ্ধা জানাই। স্মৃতিতে অনেক ছবি ও মনের মনিকোঠায় অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে কুয়েত ছেড়ে আবার বাগদাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।